মহাপ্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০১৮, ১১:৩০

১.
আমার অসম্ভব প্রিয় মানুষ মানব দরদী মহান বাঙালি পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সর্ব অর্থেই প্রাতঃস্মরণীয় মনস্বী, মনীষীমানব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই প্রয়াত হন। ‘মানুষের কল্যাণে সতত নিবেদিত মানুষ’টির স্মৃতির প্রতি জানাই অন্তরের অন্তস্থল থেকে নিখাদ ভালোবাসা, বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর (১২ আশ্বিন, ১২২৭ বঙ্গাব্দ), মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন হুগলি জেলার (অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আমরা এমন এক অন্ধকার সময় যাপন করছি, এই নিশিযাপনকালে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোন মেরুদণ্ড সম্পন্ন মানুষদের, জীবন দার্শনিকদের উপস্থিতি প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি তীব্রভাবেই অনুভব করছি। কঠিন সত্যকে যুক্তিবাদে-বিবাদে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান নি:সন্দেহে স্মরণীয়।

২.
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে অনেক যুগ প্রবর্তক মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল; ঈশবরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম ও মহাপ্রয়াণের পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে কালের ধুলোয় বহু ব্যক্তিত্ব, বহু ঘটনা ঢাকা পড়েছে। কিন্তু বিদ্যাসাগর আজও আমাদের জীবনে ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল। বাঙালির জীবনলোক ও মননলোক জুড়ে তাঁর সজীব, আলোকিত উপস্থিতি। বাঙালির শিক্ষা, নারী জাগরণ, ভাষা ও সাহিত্যের নিরলস সাধক এই মানুষটি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন যুক্তিবাদী মন নিয়ে। সময়ের এই দীর্ঘ ব্যবধান সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরকে নিয়ে তাই আজো আমাদের ভাবনা-চিন্তায় ছেদ পড়েনি। প্রতিটি বাঙালির উচিত বিদ্যাসাগরের জন্ম ও প্রয়াণ দিবসকে স্মরণ করে তাঁর মননশীল মানবিক যুক্তিবাদী চেতনাকে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে অন্ধকারের সমাজকে আলোকিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে তাই কেবলি মনে পড়ছে কবিগুরুর মহান বাণী – ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’। 

৩.
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। সাদাসিদে পোশাকে গায়ে মোটা চাদর এবং চটিজুতা ছিল তাঁর একমাত্র পরিচ্ছদ। বিরল গুণের অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আমি যে দরিদ্র বাঙ্গালী ব্রাহ্মণকে শ্রদ্ধা করি তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’ বিদ্যাসাগর ছিলেন পরের দুঃখে অতি কাতর। মহকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রচুর অর্থ সাহায্য করেন। কবি নবীনচন্দ্র সেনও যৌবনে বিদ্যাসাগরের অর্থে লেখাপড়া করেছিলেন।

৪.
বিদ্যাসাগরের একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল সমাজ সংস্কারমূলক কাজ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনি দুঃস্থমহিলাদের সেবা সহায়তা দিয়ে বাঁচানোর জন্য জন্য “হিন্দু ফ্যামিলি গ্রাচুয়িটি ফাণ্ড” গঠন করেন। তিনি চিরদিন কুসংস্কার, গোড়ামি আর ধর্মন্ধতার বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে লড়াই করে গেছেন। বাঙালি জাতি সর্বপ্রথম বড় হবার, যোগ্য হবার, মানবিক হবার, আধুনিক প্রগতিশীল ও বিশ্বজনীন হবার সর্বপ্রথম দৃষ্টান্ত খুঁজে পেয়েছিল বিদ্যাসাগরের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন তিনি হিন্দু ছিলেন না, বাঙ্গালী বা ব্রাহ্মণ ছিলেন না, ছিলেন ‘মানুষ’। এই মন্তব্যের তাৎপর্য অতলস্পর্শী। কারণ কারো যথার্থ “মানুষ” হওয়া অত সহজ কথা নয়। তিনি আরো বলেছেন, ‘তাহার মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয় বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন, তাহার তলদেশে জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে।’

৫.
সংস্কৃত পন্ডিত, লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, জনহিতৈষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৮২০- ২৯ জুলাই, ১৮৯১) আক্ষরিক অর্থেই একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন, আদর্শ মানব ছিলেন। বিদ্যাসাগরের জীবন কেটেছে বাংলার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালে। দারিদ্র্য ও শোষণ বাঙালির সমাজজীবনকে ক্ষয় করে ফেলেছিল। শিক্ষা, ইংরেজ শাসন ও সামাজিক কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে রামমোহন রায় থেকে শুরু করে অনেকেই বাংলার নবজাগরণে ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন শহুরে বণিক পরিবারের। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সাত ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। মায়ের প্রতি ছিল বিদ্যাসাগরের অগাধ শ্রদ্ধা। মায়ের প্রতিটি ইচ্ছা অকাতরে পূরণ করতেন। তাঁর মাতৃভক্তি নিয়ে অনেক জনশ্রুতিও শোনা যায়। বাংলা গদ্য সাহিত্য যার হাতে পেল গতি ও শ্রুতি তিনিই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সাহিত্যিক হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রয়েছে যথেষ্ট অবদান। তিনি সাহিত্যে সৃজনী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি যখন অধ্যাপক ছিলেন, তখন বাংলায় উন্নত পাঠ্য পুস্তকের অভাব বোধ করেছেন। নিজের সাহিত্য প্রতিভাবলে বাংলা গদ্যের ভান্ডার শক্ত করেছেন তার জন্যই বাংলা গদ্যরীতি আপন পথ খুঁজে পায়। আর এ জন্যই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। এই তিনিই আবার বৃটিশ ভারতে বাঙালির সমস্যাসমূহ টের পেয়েছিলেন বলেই সেসব সমস্যা সমাধানে আমৃত্যু নিরন্তর কাজ করে গেছেন। জীবনে কম কষ্ট পাননি তিনি তাঁর আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। নিজ পরিবার, সমকালীন সমাজ এবং ওপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে। অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে অর্থনৈতিকভাবে বেশ সম্পদের অধিকারী হয়েও তিনি ব্যক্তিগত ভোগ বিলাসীতায় কখনো নিজেকে নিমজ্জিত রাখেননি। বিত্ত অর্জনে কষ্ট করেছেন কিন্তু চিত্তের উদারতায় মানব কল্যাণে ব্যয় করতে কখনো সংকোচ কিংবা দ্বিধা করেননি। ফলে সমকালেই তিনি জ্ঞানের বা বিদ্যার সাগরের পাশাপাশি করুণার সাগর হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। বিদ্যাসাগর উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি হিন্দু সমাজের বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করেন। তার প্রচেষ্টায় ২৬ জুলাই ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। নিজের ছেলের সাথে এক বিধবা কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে অন্য হিন্দুরাও উৎসাহ বোধ করে।

৬.
প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বিবিধ বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের পাণ্ডিত্যের জন্য 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেছিলেন।পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম ভগবতী দেবী। স্ত্রীর নাম দীনময়ী দেবী। তাঁর পিতামহের নাম রামজয় তর্কভূষণ। পণ্ডিত হিসাবে রামজয়ের সুনাম থাকলেও, তিনি অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন। ভাইদের সাথে মনমালিন্য হওয়ার জন্য রামজয় গৃহত্যাগ করলে, তাঁর স্ত্রী দুর্গাদেবী (বিদ্যাসাগরের পিতামহী) পুত্রকন্যা নিয়ে দুরবস্থায় পড়েন এবং তিনি তাঁর পিতার বাড়ি বীরসিংহ গ্রামে চলে আসেন। এই কারণে বীরসিংহ গ্রাম বিদ্যাসাগরের মামার বাড়ি হলেও পরে সেটাই তাঁর আপন গ্রামে পরিণত হয়। আর্থিক অসুবিধার কারণে দুর্গাদেবী জ্যেষ্ঠ সন্তান ঠাকুরদাস কৈশোরেই উপার্জনের জন্য কলকাতায় চলে আসেন এবং সেখানে তিনি অতি সামান্য বেতনে চাকুরি গ্রহণ করেন। পরে তেইশ-চব্বিশ বৎসর বয়সে তিনি গোঘাট নিবাসী রামকান্ত তর্কবাগীশের কন্যা ভগবতী দেবীকে বিবাহ করেন। আর্থিক অনটনের জন্য তাঁর পক্ষে সপরিবার শহরে বাস করা সাধ্যাতীত ছিল। তাই শৈশব ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামেই মা ভগবতী দেবী ও ঠাকুরমা দুর্গাদেবীর কাছেই প্রতিপালিত হন।

৭.
খুব দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হলেও বিদ্যাসাগর ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। গ্রামের পাঠশালায় শুরু হয় তার শিক্ষাজীবন। তিনি ছিলেন লেখাপড়ায় খুব মনোযোগী ও সচেতন। পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামের কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায় ভর্তি হন। এই পাঠশালায় তিনি সেকালের প্রচলিত বাংলা শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি তাঁর পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। কথিত আছে, পদব্রজে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে সংখ্যাচিহ্ন শিখেছিলেন। এই সময় ঠাকুরদাশ এবং বিদ্যাসাগর কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের বিখ্যাত সিংহ পরিবারে আশ্রয় নেন। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুন সোমবার, কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে তিনি ভর্তি হন। ঈশ্বর চন্দ্র সন্ধ্যার পর রাস্তার পাশে জ্বালানো বাতির নিচে দাঁড়িয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন ছাত্রাবস্থায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে। এই কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ ও নদিয়া নিবাসী মদনমোহন তর্কালঙ্কার। বিদ্যাসাগরের আত্মকথা থেকে জানা যায় মোট সাড়ে তিন বছর তিনি ওই শ্রেণীতে অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণীতেও ভর্তি হন। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি পান এবং 'আউট স্টুডেন্ট' হিসেবে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা উপহার পান। উল্লেখ্য তৎকালীন সংস্কৃত কলেজে মাসিক বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের 'পে স্টুডেন্ট' ও অন্য ছাত্রদের 'আউট স্টুডেন্ট' বলা হত। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কাব্য শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই সময় তিনি শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'পে স্টুডেন্ট' হিসেবে মাসিক ৫ টাকা পেতেন। ১৮৩৪-৩৫ খ্রিষ্টাব্দের বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য তিনি ৫ টাকা মূল্যের পুস্তক উপহার পান। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অলঙ্কার শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে তিনি শিক্ষক হিসাবে পান পণ্ডিত প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশকে। এই শ্রেণিতে তিনি এক বৎসর শিক্ষালাভ করেন। ১৯৩৫-৩৬ বৎসরের বাৎসরিক পরীক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ সংখ্যক নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এই কারণে তিনি কলেজ থেকে রঘুবংশম্, সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশ, রত্নাবলী, মালতী মাধব, উত্তর রামচরিত, মুদ্রারাক্ষস, বিক্রমোর্বশী ও মৃচ্ছকটিক গ্রন্থসমূহ উপহার পান। ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভর্তি হন বেদান্ত শ্রেণিতে। সেই যুগে স্মৃতি পড়তে হলে আগে বেদান্ত ও ন্যায়দর্শন পড়তে হত। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের মেধায় সন্তুষ্ট কর্তৃপক্ষ তাঁকে সরাসরি স্মৃতি শ্রেণীতে ভর্তি করে নেন। এই পরীক্ষাতেও তিনি অসামান্য কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন এবং ত্রিপুরায় জেলা জজ পণ্ডিতের পদ পেয়েও পিতার অনুরোধে, তা প্রত্যাখ্যান করে ভর্তি হন বেদান্ত শ্রেণীতে। ১৮৩৮ সালে সমাপ্ত করেন বেদান্ত পাঠ। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ এপ্রিল মাসে হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে, ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে 'বিদ্যাসাগর' উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। এরপর তিনি কৃতিত্বের সাথে 'ন্যায় শ্রেণী' ও 'জ্যোতিষ শ্রেণী'তে শিক্ষালাভ করেন। ১৮৪০-৪১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'ন্যায় শ্রেণী'তে পাঠ করেন। এই শ্রেণীতে দ্বিতীয় বার্ষিক পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে তিনি পারিতোষিক পান। ন্যায় পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ১০০ টাকা, পদ্য রচনার জন্য ১০০ টাকা, দেবনাগরী হস্তাক্ষরের জন্য ৮ টাকা ও বাংলায় কোম্পানির রেগুলেশন বিষয়ক পরীক্ষায় ২৫ টাকা – সর্বসাকুল্যে ২৩৩ টাকা পারিতোষিক পেয়েছিলেন।

৮.
ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র এবং ১৮৩৯ সালের মধ্যেই বিবিধ বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের পাণ্ডিত্যের জন্য 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করার পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। তাছাড়া প্রতি বছরই তিনি বৃত্তি এবং গ্রন্থ ও আর্থিক পুরস্কার পান। তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তিনি কেবল লেখাপড়া শেখানোর কৌশল হিসেবে এগুলি লেখেননি, বরং ছাত্রদের নীতিবোধ উন্নত করা এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানও তাঁর লক্ষ্য ছিল। যেমন চরিতমালায় তিনি প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিদের জীবনী লেখেননি, বরং ইউরোপের ষোলোজন বিখ্যাত ব্যক্তির পরিচিতি দিয়েছেন। তেমনি জীবনচরিতে তিনি কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন এবং হার্শেলের মতো বিজ্ঞানীদের এবং উইলিয়ম জোনসের মতো পন্ডিত ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচিতি লিখেছেন। নীতিবোধেও একই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। এতে তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্ম এবং আচার-অনুষ্ঠানের কোনো উল্লেখ করেননি, বরং যেসব নীতিবোধ সকল মানুষের থাকা উচিত, তার কথা লিখেছেন। কথামালায় তিনি নীতিমূলক গল্প সংগ্রহ করেছেন। আর তিন খন্ড আখ্যানমঞ্জরীতে সংগ্রহ করেছেন ইউরোপ-অ্যামেরিকার (এবং চারটি আরব দেশ ও পারস্যের) সত্যিকার এবং জনপ্রিয় গল্প। এসব গল্পের শিরোনাম—মাতৃভক্তি, পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃস্নেহ, গুরুভক্তি, আতিথেয়তা, পরোপকার এবং সাধুতার পুরস্কার—থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি কেবল ছাত্রদের নীতিবোধ উন্নত করতে চাননি, সেই সঙ্গে চেয়েছিলেন তাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে। তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি দীর্ঘদিন বঙ্গদেশের সর্বত্র পাঠ্য ছিল। এগুলোর মাধ্যমে তিনি একই সঙ্গে প্রামাণ্য ভাষা ও বানান যেমন শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন, তেমনি পেরেছিলেন নীতিবোধ উন্নত করতে।
 
৯.
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা সমাপ্ত শেষ করার পর, ২৯ ডিসেম্বর মাত্র একুশ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা বিভাগের সেরেস্তাদার বা প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত হন। সে সময় তাঁর বেতন ছিল মাসে ৫০ টাকা। সংস্কৃত কলেজের রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কারের মৃত্যুতে একটি পদ শূন্য হলে, তিনি ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন। কিন্তু কলেজ পরিচালনার ব্যাপারে সেক্রেটারি রসময় দত্তের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় তিনি ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই তারিখে সংস্কৃত কলেজের সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর এই বছরের ১ মার্চ পাঁচ হাজার টাকা জামিনে, মাসিক ৮০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেডরাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। এই বৎসরেই তিনি স্থাপন করেন সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি নামে একটি বইয়ের দোকান।

১০.
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে বন্ধু ও হিতৈষীদের সহযোগিতায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থাপনা করেন 'সর্ব্বশুভকরী সভা'। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় তিনি সর্ব্বশুভকরী নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কাজে ইস্তফা দেন এবং ৫ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি তারিখে তিনি সাহিত্যের অধ্যাপকের পদ ছাড়াও কলেজের অস্থায়ী সেক্রেটারির কার্যভারও গ্রহণ করেন। ২২ জানুয়ারি ১৫০ টাকা বেতনে কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এই সময় থেকেই সংস্কৃত কলেজে সেক্রেটারির পদটি বিলুপ্ত হয়। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার নিয়ে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেন। ৯ জুলাই, পূর্বতন রীতি বদলে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও কায়স্থদের সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেন। ২৬ জুলাই প্রবর্তিত হয় রবিবারের সাপ্তাহিক ছুটির প্রথা। উল্লেখ্য এর আগে প্রতি অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথিতে ছুটি থাকত। ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজকে সকল বর্ণের সম্ভ্রান্ত হিন্দু সন্তানদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে ২৬ অনুচ্ছেদ সম্বলিত নোটস অন দ্য সংস্কৃত কলেজ প্রস্তুত হয়। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর নিজের বেতন বৃদ্ধি পেয়ে তিনশো টাকা হয়। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভেঙে বোর্ড অফ একজামিনার্স গঠিত হয়। বিদ্যাসাগর এইবোর্ডের সদস্য মনোনীত হন।

১১.
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পাল্কিতে বসে তিনি বর্ণপরিচয়-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। ১লা মে-তে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ছাড়াও মাসিক অতিরিক্ত ২০০ টাকা বেতনে দক্ষিণবঙ্গে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে নিযুক্ত হন। ১৭ই জুলাইতে বাংলা শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সংস্কৃত কলেজের অধীনে, ওই কলেজের প্রাতঃকালীন বিভাগে নর্ম্যাল স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন অক্ষয়কুমার দত্ত। এই বছরেই দক্ষিণবঙ্গের চার জেলায় একাধিক মডেল স্কুল বা বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে নদিয়ায় পাঁচটি, আগস্ট-অক্টোবরে বর্ধমানে পাঁচটি, আগষ্ট-সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে হুগলিতে পাঁচটি এবং অক্টোবর-ডিসেম্বরে মেদিনীপুর জেলায় চারটি বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। অক্টোবর মাসে বিধবা বিবাহ বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করার পর্যাপ্ত শাস্ত্রীয় প্রমাণসহ 'বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' – দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশ করেন। বিধবা বিবাহ আইনসম্মত করতে ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ সরকারের নিকট বহুসাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্রও পাঠান। ২৭ ডিসেম্বর আরেকটি আবেদনপত্র পাঠান বহু বিবাহ নিবারণ বিধির জন্য। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি মেদিনীপুরে পঞ্চম বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রথম বিধবা বিবাহ আয়োজিত হয়— ১২, সুকিয়া স্ট্রিটে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পাত্র ছিলেন প্রসিদ্ধ কথক রামধন তর্কবাগীশের কণিষ্ঠ পুত্র তথা সংস্কৃত কলেজের কৃতি ছাত্র ও অধ্যাপক, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পাত্রী ছিলেন বর্ধমান জেলার পলাশডাঙা গ্রামের অধিবাসী ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দ্বাদশ বর্ষীয়া বিধবা কন্যা কালীমতী। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে জানুয়ারিতে স্থাপিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির অন্যতম সদস্য তথা ফেলো মনোনীত হন। এই বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে হুগলি জেলায় সাতটি ও বর্ধমান জেলায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরের বছর জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে হুগলিতে আরও তেরোটি, বর্ধমানে দশটি, মেদিনীপুরে তিনটি ও নদিয়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। মোট ১৩০০ ছাত্রীসম্বলিত এই বিদ্যালয়গুলির জন্য তাঁর খরচ হতো মাসে ৮৪৫ টাকা। এই ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ নভেম্বর শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তার সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করেন।

১২.
১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ নভেম্বর প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনার নেপথ্যে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম পত্রিকা, যাতে রাজনৈতিক বিষয় স্থান পেয়েছিল। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ১ এপ্রিল পাইকপাড়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মুর্শিদাবাদের কান্দিতে প্রতিষ্ঠা করেন ইংরেজি-বাংলা স্কুল। কিছুকাল এই প্রতিষ্ঠানের অবৈতনিক তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন তিনি। ২০ এপ্রিল মেট্রোপলিটান থিয়েটারে উমেশচন্দ্র মিত্র রচিত নাটক বিধবা বিবাহ প্রথম অভিনীত হয়। ২৩ এপ্রিল রামগোপাল মল্লিকের সিঁদুরিয়াপট্টির বাসভবনে সেই নাটকের অভিনয় দেখেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। মে মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে মিশে গেলে উক্ত সভার সভাপতির পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর গণশিক্ষার প্রসারে সরকারি অনুদানের জন্য বাংলার গভর্নরের নিকট আবেদন করেন। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে বোর্ড অফ একজামিনার্সের পদ থেকেও ইস্তফা দেন তিনি। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের সেক্রেটারি মনোনীত হন। এই বছর ডিসেম্বর মাসে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণে, তিনি তাঁর সম্পদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার পরিচালনভার গ্রহণ করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণদাস পালকে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেন। এই বছর তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাণভট্টের কাদম্বরী। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁকে উৎসর্গ করেন স্বরচিতবীরাঙ্গনা কাব্য।

১৩.
১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সরকার তাঁকে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। উল্লেখ্য, ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী নাবালক জমিদারদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এই ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের নাম পরিবর্তন করে কলিকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন রাখা হয়। ৪ জুলাই ইংল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে সাম্মানিক সদস্য নির্বাচিত করে। ২রা আগস্ট ফ্রান্সে ঋণগ্রস্থ মাইকেল মধুসূদনের সাহায্যার্থে ১৫০০ টাকা প্রেরণ করেন তিনি। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁর প্রথম রিপোর্টটি পেশ করেন।

১৪.
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি বহুবিবাহ রদের জন্য দ্বিতীয়বার ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার নিকট আবেদনপত্র পাঠান। ১৮৬৭ সালের জুলাই মাসে তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতার সঙ্গে গোপালচন্দ্র সমাজপতির বিবাহ হয়। এবছর অনাসৃষ্টির কারণে বাংলায় তীব্র অন্নসংকট দেখা দিলে তিনি বীরসিংহ গ্রামে নিজ ব্যয়ে একটি অন্নসত্র স্থাপন করেন। ছয় মাস দৈনিক চার-পাঁচশো নরনারী ও শিশু এই অন্নসত্র থেকে অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছিল। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারি মাসে তিনি বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারির পদ ত্যাগ করেন। এপ্রিল মাসে তাঁর সম্পাদনায় কালিদাসের মেঘদূতম্ প্রকাশিত হয়। এই বছরে বীরসিংহ গ্রামে তাঁর পৈত্রিক বাসভবনটি ভস্মীভূত হয়। এরপর তিনি চিরতরে জন্মগ্রাম বীরসিংহ ত্যাগ করেন। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞান সভায় এক হাজার টাকা দান করেন। ১১শে আগস্ট তাঁর বাইশ বছর বয়সী পুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণনগর নিবাসী শম্ভুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্দশবর্ষীয়া বিধবা কন্যা ভবসুন্দরীর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল কাশীতে তাঁর মা ভগবতী দেবী মৃত্যবরণ করেন।

১৫.
কঠিন পরিশ্রমজনিত কারণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। ১৮৭১-৭২ সাল নাগাদ তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। শেষজীবনে তিনি বিহারের অন্তর্গত কর্মাটারে কাটান। সাঁওতালদের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা তাঁকে মুগ্ধ করে।জলহাওয়া পরিবর্তনের জন্য তিনি কার্মাটারে (বর্তমানে ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অবস্থিত) একটি বাগানবাড়ি কেনেন। তিনি তাদের অবহেলিত অবস্থা দেখে তাদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন হিন্দু বিধবাদের সাহায্যার্থে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড নামে একটি জনহিতকর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। স্বল্প আয়ের সাধারণ বাঙালির মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী-পুত্র পরিবারবর্গ যাতে চরম অর্থকষ্টে না পড়েন, তার উদ্দেশ্যেই এই প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। বিদ্যাসাগর ছিলেন এর অন্যতম ট্রাস্টি। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে স্থাপিত হয় মেট্রোপলিটান কলেজ। সেযুগের এই বেসরকারি কলেজটিই বর্তমানে কলকাতার বিখ্যাত 'বিদ্যাসাগর কলেজ' নামে পরিচিত। ১৬ আগষ্ট মাইকেল মধুসূদনের নাটক শর্মিষ্ঠা অভিনয়ের মাধ্যমে উদ্বোধিত হয়েছিল বেঙ্গল থিয়েটার। বিদ্যাসাগর মহাশয় এই থিয়েটারের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র এক বছরেই ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় মেট্রোপলিটান কলেজ গুণানুসারে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল।

১৬.
১৮৭৫ সালের ৩১ মে তারিখে নিজের উইল প্রস্তুত করেন। পরের বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ডের ট্রাস্টি পদ থেকে ইস্তফা দেন। এপ্রিল মাসে কাশীতে পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। এই সময় তিনি কলকাতার বাদুড়বাগানে একটি বাড়ি তৈরি করেন। বর্তমানে এই বাড়ি সংলগ্ন রাস্তাটি বিদ্যাসাগর স্ট্রিট ও সমগ্র বিধানসভা কেন্দ্রটি বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত। ১-২ আগষ্ট আদালতে উপস্থিত থেকে চকদিঘির জমিদার সারদাপ্রসাদ রায়ের উইল মামলায় উইল প্রকৃত নয় বলে জমিদার পত্নী রাজেশ্বরী দেবীর স্বপক্ষে সাক্ষী দেন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারি থেকে বাদুড়বাগানে বাস করতে শুরু করেন। এপ্রিল মাসে গোপাললাল ঠাকুরের বাড়িতে উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেদের পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ছাত্রদের বেতন হয় মাসিক ৫০ টাকা। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মেট্রোপলিটান কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক দ্বিতীয় থেকে প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত হয়। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারিতে তিনি সিআইই উপাধি পান। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে ৫ই আগস্ট রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর বাদুড়বাগানের বাড়িতে আসেন। দুজনের মধ্যে ঐতিহাসিক এক আলাপ ঘটে। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন। মার্চে বাণভট্টের হর্ষচরিতম্ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে কানপুরে বেড়াতে যান এবং সেখানে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত করেন।

১৭.
১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ আগস্ট তাঁর পত্নী দীনময়ী দেবীর মৃত্যু হয়। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই এপ্রিল বীরসিংহ গ্রামে তাঁর মায়ের নামে স্থাপন করেন ভগবতী বিদ্যালয়। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ই জুলাই (১৩ শ্রাবণ, ১২৯৮ বঙ্গাব্দ) রাত্রি দুটো আঠারো মিনিটে তাঁর কলকাতার বাদুড়বাগানস্থ বাসভবনে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর ১০ মাস ৩ দিন। মৃত্যুর কারণ, ডাক্তারের মতে, লিভারের ক্যানসার। মৃত্যুর পর ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বিদ্যাসাগর চরিত প্রকাশ করেন তাঁর পুত্র নারায়ণচন্দ্র বিদ্যারত্ন। ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে ৪০৮টি শ্লোকবিশিষ্ট ভূগোল খগোল বর্ণনম্ গ্রন্থটিও প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, পশ্চিম ভারতের এক সিভিলিয়ন জন লিয়রের প্রস্তাবে বিদ্যাসাগর পুরাণ, সূর্যসিদ্ধান্ত ও ইউরোপীয় মত অনুসারে এই ভূগোল গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।

১৮.
বিদ্যাসাগর, সমকালে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি নিন্দুকদের উৎপীড়ন আর প্রতিরোধে কম অতিষ্ঠ হননি। কিন্তু তবু, মেধা ও পাণ্ডিত্যের সমন্বয়ে মানবিক গুণাবলির অতুলনীয় উদাহরণ তিনি। শিক্ষা-সমাজ সংস্কার এবং নেতৃত্বেও। এমন দৃঢ়চেতা, সাহসী ও মানবিক মানুষ অত্যন্ত বিরল। ফলে তাঁর জীবন ও ভাবনাসমুচ্চয় সময়-সমাজকে ছাড়িয়ে ভারতবর্ষের চিরকালীন সম্পদ। তৎকালীন সমাজে বিদ্যাসাগরের গুরুত্ব কেমন ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য থেকে সেটি অনুধাবন করা যায়, ‘তিনি বিজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ, দেশহিতৈষী এবং সুলেখক, ইহা আমরা বিস্মৃত হই নাই। বঙ্গদেশ তাঁহার নিকট অনেক ঋণে বদ্ধ। এ কথা যদি আমরা বিস্মৃত হই, তবে আমরা কৃতঘ্ন।’ কিন্তু দু শতক আগে, অনগ্রসর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগে একজন বিদ্যাসাগর যে মানবিক-সামাজিক-নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করলেন, স্বচেষ্টায় দেশকালকে ছাপিয়ে হয়ে উঠলেন অতুলনীয় ও কীর্তিমান—পুরো ব্যাপারটি ভাবলে বিস্ময় জাগে! আমাদের প্রযুক্তির ঝলমলে সময়ে, এখন বিদ্যাসাগরীয় দূরে থাকুক, তাঁর ছায়াতুল্য ব্যক্তিত্বের গড়ে ওঠাটুকুও দুর্লভ হয়ে পড়েছে। এই সমাজ ও সময়ে যথেষ্ট মননশীল, চিন্তাশীল, মুক্তমনের মানবিক, তাত্ত্বিক মানুষ কেন তৈরি হচ্ছে না! 

১৯.
ব্যক্তির কীর্তি ও মহত্ত্ব সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলে তাঁর প্রকৃত নামটি চাপা পড়ে যায়, উপাধির আলোকচ্ছটায়। বাঙালি সমাজেই নয়, সমগ্র পৃথিবীতে এমন নজির সত্য ও প্রমাণিত, যদিও আজকের দিনে তা বিরলও। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামের মানুষটি যেমন মহৎ ও বিদ্যান, উদার মনের নমস্য বাঙালিও। তাঁর নাম কে না জানে! তাঁর প্রকৃত নাম যে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধির আড়ালে সেটি ঢাকা পড়ে গেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্বান ও বিদ্যা বিতরণে নিবেদিত মানুষ হিসেবে এমনই খ্যাতিমান হয়েছেন যে এই উপাধি তাঁরই একচেটিয়া হয়ে উঠেছে। তিনি ছাড়া, আর দ্বিতীয় কোনো বিদ্যাসাগর উপাধিধারীর কথা শোনা যায় না। তাঁর প্রয়াণের সোয়া শ বছর পরেও এই পরিচয়টিই যথার্থ।এখানে আমি সংশয়হীনভাবে উল্লেখ করতে পারি, বিদ্যাসাগর-চর্চায় বহু-উল্লিখিত বিনয় ঘোষের ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ’ এবং ইন্দ্রমিত্রের ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ গ্রন্থ দু’টি আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত ও অনুপ্রাণিত করেছে। 

২০.
আমরা জানি, উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী বিদ্যাসাগর অকৃতজ্ঞ মনুষ্যসমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘স্বেচ্ছা নির্বাসন’-এ। কিন্তু কিছু রক্ষণশীল ও তথাকথিত শিক্ষিত মানুষই বিদ্যাসাগরের প্রতি চরম অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেছিল, সাধারণ মানুষ নয়। সাধারণ মানুষের মনে তিনি কীভাবে ‘উজ্জ্বলতর’ নক্ষত্র হয়েছিলেন, সেই ইন্দ্রপতন ঘিরে রচিত অসাধারণ ইতিহাসগ্রন্থ উদয়ন মিত্রের ‘ঈশ্বরচন্দ্র : এক নক্ষত্রের প্রয়াণ’। বিদ্যাসাগরের প্রয়াণকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে-আলোড়ন উঠেছিল, শোক-স্মরণ-শ্রদ্ধানিবেদনের আকুতিতে পূর্ণ সেই অভাবিত ঝঞ্ঝার বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে বইটিতে। বিদ্যাসাগরের জীবনী, কর্মকীর্তি বা সাহিত্যকৃতির আলোচনা নয়, এই বইটির বিষয়বস্তু অভিনব- তাঁর মহাপ্রয়াণকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যে-আলোড়ন উঠেছিল, শোক-স্মরণ-শ্রদ্ধানিবেদনের আকুতিতে পূর্ণ সেই অভাবিত ঝঞ্ঝার বিস্তৃত বিবরণ, এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের অনুপুঙ্খ ইতিহাস। বইটিতে সেই সময়ের ঐতিহাসিক তথ্য ও সত্য ব্যক্ত করেছে। সম্পূরক গ্রন্থরূপে ‘ঈশ্বরচন্দ্র: এক নক্ষত্রের প্রয়াণ’ বিবেচিত হতে পারে।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, অনুশীলন, দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ইত্তেফাক, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত