প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

আহমদ ছফা

প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০১৮, ১০:৪১

১.
বাঙালি মনীষার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্তের নাম আহমদ ছফা, তাঁর প্রিয়জনদের কাছে মহাত্মা আহমদ ছফা। সূচনাতেই তাই অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের ভাষা ধার করে বলি, ‘আমরা কয়েকজন আহমদ ছফার ছাত্রও আজ প্রাণধারণ করি। আমরা তাঁহাকে মাঝেমধ্যে যেমন এই নিবন্ধেও ‘মহাত্মা’ বলিয়া শান্তি পাই। খুব কম লোককেই আমরা ‘মহাত্মা’ বলি।’ বাংলার মনন ও সৃজনীশক্তির এক ব্যতিক্রমী এবং বিরল ব্যক্তিত্ব আহমদ ছফা। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক মানুষ, একাধারে কবি, উপন্যাসিক, গল্পকার, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী। জীবদ্দশায় আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধী, নিমোর্হ, অকপট নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য বুদ্ধিজীবি ও চিন্তকমহলে বিশেষভাবে আলোচিত, সমালোচিতও ছিলেন। ২০০১ সালের ২৮ জুলাই তিনি প্রয়াত হন। প্রিয় ভাবুকের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা তিরিশেরও অধিক। 

২.
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা মূলত ছিলেন দল-মতের ঊর্ধ্বে অবস্থানকারী একজন চিন্তক। তিনি মানবিক যুক্তিবোধ ছাড়া কাউকে তোয়াক্কা করতে না, তোষামদী তো নয়ই। সময়ের প্রচলিত ধারার বাইরে পা ফেলতে তিনি মোটেই দ্বিধা করতেন না। তাঁর ব্যক্তিত্ব এমনই আপন ধাতুতে গড়া ছিলো। আর তাই সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তাঁকে বিচার করলে ভুল হবে,তাঁর প্রতি অবিচার হবে। আহমদ ছফার অতি আপনজন ফরহাদ মজহার আস্থার সাথে সে কথাই জানান দেন এভাবে, ‘আহমদ ছফাকে নিছকই সাহিত্যিক বা বুদ্ধিজীবী হিশাবে গণনা করলে মারাত্মক গলতি হবার সম্ভাবনা। তার জীবনযাপন, সামাজিকতা, লেখালিখি, রাজনীতি, তরুণদের দুর্দান্ত প্রেরণায় উজ্জীবিত করার ক্ষমতা ইত্যাদি মিলিয়ে তার তাৎপর্য অন্যরকম। তার সাহিত্য ও অপরাপর চর্চা তার মহান ব্যক্তিত্বের গৌণ দিক, প্রধান দিক নয়। আহমদ ছফা অন্য জিনিস।’ ফরহাদ মজহার আরো লিখছেন, ‘সাহিত্য, সংস্কৃতি এমনকি রাজনীতিতেও যারা স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে ব্যক্তির মহিমা কীর্তন করেছেন তারা কেউই কিন্তু শহরের নাগরিক নন। তাদের অধিকাংশই ছফার মতো গ্রাম থেকে শহরে আসা। অনেকে নিজের জবানিতে লিখিতভাবে তাদের স্বেচ্ছাচারের বর্ণনাও দিয়েছেন। এই ধারার বিপরীতে বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে আরেকটি শক্তিশালী ধারা ছিল, আহমদ ছফা যার শিরোমণি। সেই ধারা ব্যক্তির মুক্তি আস্বাদন করতে চায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মুক্তির সঙ্গে ব্যক্তির মুক্তির সম্পর্ক বিচার করতে চায়, সেই সম্পর্কের মহিমা বুঝতে চায়, লক্ষ্য অর্জনে সক্রিয় হতে চায়। তরুণ বয়েসে তার সেই অন্বেষণ অধিকতর পরিণত বয়েসে এসে অসাধারণ প্রজ্ঞাবান হয়ে উঠেছিল। তার পুষ্প, বৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ নামক আত্মজৈবনিক বয়ানে ছফা লিখছে : ‘একমাত্র অন্যকে মুক্ত করেই মানুষ নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারে।’ এই জ্ঞানবাক্যটি সে পাখির কাছে শিখেছে, বিশেষত সেই পাখিটির কাছে যাকে যে নিজের পুত্রজ্ঞান করত। মাটির মানুষের জগতে হিংস্রতা ও হানাহানি দেখে ছফা আকাশের পাখির জগতে আশ্রয় নিয়ে আবিষ্কার করল সেখানেও হিংস্রতা এবং জাতিবৈরিতার প্রকোপ আছে। আহমদ ছফা লিখছে, ‘মানুষের মতো কর্তব্য পালন করার জন্য আমার মানুষের কাছে ফিরে না গিয়ে উপায় কি? আমি বৃক্ষ নই, মানুষ। ভালো হোক মন্দ হোক আনন্দের হোক, বেদনার হোক আমাকে মানুষের মতো মানুষের সমাজে মনুষ্যজীবনই যাপন করতে হবে। মনুষ্যলীলার করুণ রঙ্গভূমিতে আমাকে নেমে আসতে হবে।’ 

৩.
আহমদ ছফা (জন্ম : জুন ৩০, ১৯৪৩ – মৃত্যু : জুলাই ২৮, ২০০১) সারা জীবন আপন সমাজের কথা ভেবেছেন। আহমদ ছফা স্বপ্ন দেখেছিলেন, বাংলাদেশের গণসংগ্রামের উত্তাপ থেকে নতুন মানুষ জন্ম নেবে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, অন্তরের অমৃত বলে বুক বেঁধে আবার দাঁড়াবে বাংলাদেশ। আহমদ ছফার রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজ চিন্তা, বিশ্ববীক্ষা, মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদ এবং সমাজ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারার কথা বলেছেন অনেকেই। বাঙালি জাতি ছফার কাছে কৃতজ্ঞ। সাত হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতির মধ্যে নানান ধরনের যে বৈশিষ্ট্য জমা হয়েছে ছফা তা বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেভাবে সমাজ নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। আহমদ ছফার রাষ্ট্রচিন্তা কত যে প্রাসঙ্গিক তা বাংলাদেশের আজকের রাজনৈতিক সংকট দেখেই বুঝতে পারা যায়। ছফা কত পূর্বে এসব সংকট নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ লিখে যান। আহমদ ছফা বাঙালি জাতিরাষ্ট্র গঠনে তাঁর প্রখর ধী-শক্তির বিকাশ ও মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায় নিয়ে কথা বলেন। তাঁর লেখায় বাংলাদেশী জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে বলেও মন্তব্য করেন। আহমদ ছফার লেখায় রসবোধ, গদ্যের নির্মাণ শৈলী ও কবিতার গভীরতা ছিলো বলেই সমালোচকগণের অভিমত। আহমদ ছফার সারা জীবনের লক্ষ্য ছিল আপন সমাজের মানুষকে ন্যায়নীতি, বিজ্ঞানদৃষ্টি, মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার দিকে চালিত করা। কারণ, আমরা জানি, শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারার ক্ষমতা অর্জন। এখানেই সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন, ছফা এটা বুঝেছিলেন। 

৪.
বাংলাদেশের মনন ও সৃজনীশক্তির এক বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের কাছে অনন্য হয়ে আছেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফার তুলনা কেবলমাত্র আহমদ ছফা নিজেই। তাঁর লেখা যেমন অনন্য, বলাও তেমন অতুলনীয়। নানা লেখায় ও আলাপনে একটা জাতির নানা সংকটের ছবি অনিন্দ্যসত্য ভাষায় তুলে ধরেছেন তিনি । তিনি আমাদের সংকটের একেবারে মর্মমূলে গিয়ে হাজির হতে পারতেন। এক সাক্ষাৎকারে ছফা বলেছেন- ‘আমাদের জাতীয় সংকটের মূলে আছে আমাদের দেশি বুদ্ধিব্যবসায়ীদের অন্তর্গত সংকট–তাঁদেরই চরিত্র ও দায়িত্বহীনতা। সত্যের অনুরাগে তাঁরা অবিচল নন।’ আহমদ ছফার মতে, ‘লেখকের কাজ হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতা বিস্তৃত করা, চিন্তার সীমানাকে বিস্তৃত করা।’ তিনি মনে করেন সত্য উদঘাটনই লেখকের কাজ কারণ ‘সত্যই একমাত্র মানুষকে উদ্ধার করতে পারে।’ আর তাই বাংলাদেশে একমাত্র আহমদ ছফার পক্ষেই বলা সম্ভব ছিল, ‘আমি সত্যের প্রতি অবিচল একটি অনুরাগ নিয়ে চলতে চাই’। এক সাক্ষাৎকারপ্রার্থী ছফাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এত বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন আপনি। আসলে কী হতে চেয়েছিলেন?” জবাবে আহমদ ছফা বলেছিলেন, “ইচ্ছে ছিল লেখক, ব্যবসায়ী বা রাজনীতিক হব। রাজনীতিক হওয়া সম্ভব না এটা বুঝেছি অল্পদিনেই। কারণ রাজনীতি করতে গেলে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। যে ধরনের কৌশল করতে হয় সে সবের যোগ্য আমি নই।” আর তাই আহমদ ছফা (জুন ৩০, ১৯৪৩ - জুলাই ২৮, ২০০১) সুস্পষ্ট ভাষায়, সৎসাহসের সাথে লিখছেন, ‘আমার কাছে ঈশ্বর-চিন্তা আর মানুষের অমরতার চিন্তা সমার্থক। কেউ যদি আমাকে আস্তিক বলেন বিনা বাক্যে মেনে নেব। আমি আস্তিক। যদি কেউ বলেন নাস্তিক আপত্তি করব না। আস্তিক হোন, নাস্তিক হোন, ধর্মে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন,আমি কোন বিবাদের হেতু দেখতে পাইনে। আমার অভীষ্ট বিষয় মানুষ,শুধু মানুষ। মানুষই সমস্ত বিশ্বাস, সমস্ত মূল্যচিন্তা, সমস্ত বিজ্ঞানবুদ্ধির উৎস।’[নির্বাচিত প্রবন্ধ] 

৫.
আহমদ ছফা ছিলেন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ ও প্রগতিপন্থি একজন সংস্কৃতিকর্মী। প্রগতির সংঘশান্তিতে তিনি আস্থাবান ছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাও ছিল প্রচুর। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লেখক শিবির গড়ার মুখ্য ভূমিকাও পালন করেন তিনি। মুক্ত-স্বাধীন স্বদেশভূমিতে প্রগতির তরুণ সৈনিকদের অভ্যুদয় ছফার কাঙ্ক্ষিত ছিল। এজন্য বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজে আরও মানববাদী সংগঠন গড়ে তোলেন কিংবা প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল সংগঠকের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। সেই প্রতিবাদী লেখক, প্রগতিপন্থি সাহিত্যকর্মী ও সংগঠক আহমদ ছফা’র জীবনী নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক। চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। চট্টগ্রামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া সমাপ্ত করে ছফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। জন্মদিন পালন করা বিষয়ে কাছের মানুষদের কাছে আহমদ ছফা ভাই বলতেন, ‘জন্মদিন পালন আমাদের সংস্কৃতি নয়, এটা ইংরেজ সংস্কৃতি। আমাদের উচিত মৃত্যুদিন পালন করা, কেননা মৃত্যুর দ্বারাই প্রমাণিত হয়, মানুষটি আদৌ জন্মেছিলেন কি না।’

৬.
আহমদ ছফা ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী একজন সৃষ্টিশীল লেখক। ষাটের দশকে তাঁর সাহিত্য-জীবনের সূচনা হয়। সৃষ্টিধর্মী লেখক হিসেবে তিনি গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখান। তিনি বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য-সাময়িকপত্র সম্পাদনা করেন। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তিনি এক সফল লেখক। জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে তিনি গল্প-উপন্যাস রচনায় কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর আখ্যানমূলক রচনায় বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, মুক্তিকামনা ও স্বাধীনতাস্পৃহা এবং সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্যের চিত্র রূপায়িত হয়েছে। 

৭.
সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭), উদ্ধার (১৯৭৫), একজন আলী কেনানের উত্থান পতন (১৯৮৯), অলাতচক্র (১৯৯০), ওঙ্কার (১৯৯৩), গাভীবৃত্তান্ত (১৯৯৪), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ (১৯৯৬) আহমদ ছফার উপন্যাস এবং নিহত নক্ষত্র (১৯৬৯) তাঁর গল্পগ্রন্থ। কবিতায়ও আহমদ ছফার স্বতন্ত্রতা রয়েছে। জল্লাদ সময়, একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা, লেনিন ঘুমোবে এবার ইত্যাদি একাধিক কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা তিনি। অনুভূতির প্রত্যক্ষ প্রকাশ, লোকজ ভাষা, পুথিপুরাণের শব্দ ও বাকরীতির প্রকাশ তাঁর কবিতার ধরণ হয়ে উঠেছে। জার্মান কবি গ্যেটের বিখ্যাত কাব্য ফাউস্ট-এর অনুবাদ এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের সংশয়ী রচনার বাংলা রূপান্তর আহমদ ছফাকে অনুবাদক হিসেবেও খ্যাতি এনে দিয়েছে। অবশ্য গবেষক ও প্রাবন্ধিক হিসেবেই তাঁর পরিচিতি সর্বাধিক। আহমদ ছফার গবেষণার বিষয় ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজ। এ সমাজের গঠন, বিকাশ, জাগরণ ও প্রতিষ্ঠা এবং বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যা নিয়ে অন্যান্য চিন্তাবিদের মতো ছফাও গভীরভারে ভেবেছিলেন। ষাটের দশক থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে জাতির আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলেন। ছফার চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর দুটি উল্লেখযোগ্য রচনা বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭৩) ও বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৭৬)-এ। এ দুটি বিশেষ চিন্তামূলক রচনাসহ দেশ, সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক নিবন্ধাবলি ছফাকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী লেখকের মর্যাদাপূর্ণ আসন দিয়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস অনুসন্ধানে ছফার আগ্রহ সবসময় পরিলক্ষিত হয়েছে এবং সে আগ্রহ থেকে তিনি লিখেছেন সিপাহি যুদ্ধের ইতিহাস; কিংবা প্রাজ্ঞ ও বহুদ্রষ্টা ব্যক্তির মননে সমাজ-প্রবাহের ঘটনাপুঞ্জ যে তাৎপর্যমন্ডিত হয় তার ইতিবৃত্তান্ত যদ্যপি আমার গুরু। ছফার রাজনৈতিক প্রবন্ধ এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিষয়ে রচনাও আছে। সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে তিনি বিভিন্ন সময়ে কলাম লিখেছেন এবং শেষের দিকে বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির চলমান চিত্র ও সংবাদ বিষয়ে নানা নিবন্ধ লিখে সাহসী ও বিবেকী বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেন।
 
৮.
আহমদ ছফা বলতেন, ‘সকলে আমার মধ্যে আছে, আমি সকলের মধ্যে আছি।’ যেমনটি ছফার ঘনিষ্ঠজন প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার ‘আহমদ ছফা এবং ব্যক্তির মুক্তিতত্ত্ব’ স্মৃতিচারণায় অকপটে ছফার চরিত্র চিত্রণ করে জানাচ্ছেন, ‘ব্যক্তির নাম, রাজনীতি এবং ইতিহাস নিয়ে আমি এখানে লিখব। আহমদ ছফার ওপর নয়। কিন্তু তার নাম আসবে। তাকে নজির হিশাবে নেবো। ছফা বেঁচে থাকলে তাকে নজির হিশাবে ব্যবহার করছি দেখলে সে বিলকুল খেপত। খিস্তিখেউড়ের অভ্যাস ছিল তার। কী বলত তার এক ঘণ্টার একটা ফিরিস্তি আমি এখনই দিতে পারি। তার ঘনিষ্ঠজনরা একা থাকলে এই আনন্দটি সে পুরোমাত্রায় উপভোগ করত। তবে সত্যি যে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের ধোপদুরস্ত করে দেবার চর্চা করে সে নিজেকে প্রকট প্রতিকূলতার মধ্যে প্রকৃতিস্থ রাখার চেষ্টা করত। আগে কার সামনে কী বলত খুব একটা বাছবিচার করত না। কিন্তু এক সময় সে নিজেই বুঝত তুমুল অট্টহাসি ও অবিনাশী মশকরায় ছাদ ফাটিয়ে দেবার সমাজ এটা নয়। এই সমাজের আড্ডা পরচর্চার অধিক এগোয় না। বড়োজোর দলা পাকায় চক্রান্তে আর ষড়যন্ত্রে। বয়স যখন তার খানিকটা বাড়ল তখন প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে তার এই প্রতিভাটুকুর চর্চা করে সে নির্মল শিশুর আনন্দ উপভোগ করত। তেমনি বন্ধুদেরও ছাড় দিত খুব কম। ওতে আজ অবধি তার সত্যিকারের বন্ধুদের সঙ্গে কোনো মনোমালিন্য হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কেউ তার আড্ডার খিস্তিকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করছে টের পেলে তাকে তার ধারেকাছে ঘেঁষতে দিত না। ফরাসি দার্শনিক রঁলা বার্থ কোথায় বুঝি ক্রিয়েটিভ মানুষদের খিস্তিখেউড় সর্ম্পকে কিছু একটা মন্তব্য করেছিলেন। ওর দ্বারা ছফার উৎসাহিত হবার কোনো প্রমাণ পাইনি। ফরাসি দর্শন কেন, পশ্চিমের কোনো জ্ঞানকান্ডের প্রতি তার অভিভূত ভাব কখনোই ছিল না। নিজের জ্ঞানমন্ডল ও বিচারশক্তির ওপর তার ঈমান ছিল পাথরের মতো মজবুত। তবুও, চিন্তার নতুন দিগন্তের খিলগুলো সহজে না খুললে হাতুড়ি পিটিয়ে উন্মুক্ত করা যেমন, চিন্তাশীলের খিস্তি কি সেইরকমই? কে জঠনে? মগর কবরে উঠে বসে সে আমার সাতপুরুষ উদ্ধার করলেও আমি তাকে নজির হিসেবে গ্রহণ না করে উপায় দেখছি না।’

৯.
আহমদ ছফা বিশেষজ্ঞ সলিমুল্লাহ খান ( লেখক ও অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, বাংলাদেশ) বলছেন, ‘আহমদ ছফা জাতীয় রাষ্ট্র স্থাপনকে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মনে করিতেন? তিনি বিশ্বাস করিতেন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়াই কোনো জাতি বিশ্ব ইতিহাসে প্রবেশ করার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। সেই জন্যই তিনি শেখ মুজিবের স্থান কোথায় তাহা লইয়া সংশয়ে ভোগেন নাই। ১৯৭৭ সালের দিকে লেখা একটি প্রবন্ধে তিনি লিখিয়াছিলেন, শেখ মুজিব ইতিহাসের স্রষ্টা নহেন, বরং ইতিহাসই তাঁহাকে সৃষ্টি করিয়াছে। সেই বিশ্বাস হইতে তিনি এক পাও নড়েন নাই। তিনি শেখকে ‘বড় মানুষ’ মনে করিলেও কখনও ‘অতিমানুষ’ ভাবেন নাই। ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি দেওয়া একটি জবানবন্দীতে তিনি– সঙ্গত কারণেই– বলেন, “শেখকে আশ্রয় করে এ অঞ্চলের লোক একটি রাষ্ট্র পেয়েছে। এটা অস্বীকার করলে নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হবে। কিন্তু ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘জাতির পিতা’ ইত্যাদি বলে অতিশয়োক্তি করতে বিরক্ত লাগে।” সলিমুল্লাহ খান লিখছেন, ‘আর জাতীয় সমাজের পরাকাষ্ঠা কে না জানে স্বয়ং রাষ্ট্র আকারে দেখা দেয়। জার্মান তত্ত্বচিন্তাবিদ গেয়র্গ হেগেলের দোহাই পাড়িয়া আহমদ ছফা প্রায়ই বলিতেন, কোনো জাতির সবচেয়ে বড় সৃষ্টিকর্ম হইতেছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে এই গুরুত্ব দিতেন বলিয়াই তিনি জীবনের পাকাভাগে আসিয়া বুঝিতে পারিলেন, বাংলার গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবের তুলনা নাই। কারণ, “শেখকে আশ্রয় করে এ অঞ্চলের লোক একটি রাষ্ট্র পেয়েছে।’

১০.
ছফার মতামতের সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার বলছেন, ‘ছফা 'বাঙালি মুসলমানের মন' বইতে বাঙালি মুসলমানকে হীনমন্য বলে প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা বর্ণহিন্দুর ভাষ্য। তার এ মূল্যায়ন ভুল শুধু নয়, ক্ষতিকর। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল এ দেশের জনগণকে চাবুক মেরে জাগিয়ে তোলা। উদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু ধারণাটা মন্দ। তথ্য হিসেবেও ভুল। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা বর্ণহিন্দুর এ ভাষ্যকেই মাথায় তুলে নিয়েছে, কারণ এ দেশের সাধারণ মানুষের গণচেতনার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা চাপিয়ে দেয়ার জন্য ছফার এ থিসিস তাদের কাজে লেগেছে। এ বইটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা দরকার, কিন্তু এ সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন আপাতত যথেষ্ট। ভিন্ন পরিবেশে ভিন্নভাবে কথাগুলো বলা যেত। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা বাংলাদেশে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের ক্ষেত্রে যেভাবে আহমদ ছফাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে তাতে এ বিষয়গুলো বলে ফেলা দরকার। এ ব্যবহার অভূতপূর্বই বলা যায়। রীতিমতো একটা ছফা ইন্ড্রাস্টি গড়ে উঠেছে। দারুণ ব্যাপার। ছফা রাজনীতি নিয়ে লেখালিখি করেছে, কিন্তু রাষ্ট্র এবং তার সম্ভাব্য রূপান্তর সম্পর্কে কিছুই প্রায় লেখেনি। মাঝে-মধ্যে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নৈতিক সমালোচনা ছাড়া। সাহিত্যই তার প্রধান উপজীব্য ছিল, সাহিত্যের জায়গা থেকে তার আলোচনা-সমালোচনার মূল্য আছে, কিন্তু সেটা বড়োজোর আওয়ামী লীগ ভালো ও ভদ্র একটি দল হচ্ছে না কেন এ আকুতিতেই নিবিষ্ট। এর অধিক কোনো তাৎপর্য তারা বহন করে না। তার লেখার সাহিত্যিক মূল্য আলাদা।’

১১.
আহমদ ছফা ছিলেন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ ও প্রগতিপন্থি একজন সংস্কৃতিকর্মী। প্রগতির সংঘশান্তিতে তিনি আস্থাবান ছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাও ছিল প্রচুর। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লেখক শিবির গড়ার মুখ্য ভূমিকাও পালন করেন তিনি। মুক্ত-স্বাধীন স্বদেশভূমিতে প্রগতির তরুণ সৈনিকদের অভ্যুদয় ছফার কাঙ্ক্ষিত ছিল। এজন্য বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজে আরও মানববাদী সংগঠন গড়ে তোলেন কিংবা প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল সংগঠকের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। সাহিত্যকর্মে অনন্য অবদানের জন্য আহমদ ছফা ২০০২ সালে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন।

১২.
আহমদ ছফার মৃত্যু হয় ২০০১ সালের ২৮ জুলাই। ‘আহমদ ছফা প্রসঙ্গে কিছু কথা’য় ফরহাদ মজহার লিখেছেন, ‘ছফা ভরা বর্ষার মধ্যে আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন। ওর মৃত্যু আমাকে মুষড়ে দেয়। আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা ও গভীরতা এমন জায়গায় ছিল, যার অনুপস্থিতি মেনে নেয়া কঠিন ছিল বৈকি। নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল ছিল না ছফা। বন্ধুরা ধরেবেঁধে হাসপাতালে রাখলেও হাসপাতাল থেকে কিচ্ছু না বলে চলে আসত। আসার আগে হাসপাতালে না, বাসাতেই দেখা করে এসেছি। গল্প করেছি। হাসিঠাট্টা, রস-রসিকতা আর ছফার চিরপরিচিত খিস্তি-খেউড়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তুমুল তর্ক। ছফাকে আমি বলতাম এন্টেনা। কারণ অন্যদের নজরে বা বুদ্ধিতে কোনো কিছু ধরা পড়বার আগে ওর এন্টেনায় ধরা পড়ত আগে। ফলে বর্তমান মুহূর্তের সঠিক কাজ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে ও ছিল মান্য পুরুষ। অথচ আমরা একইরকম ভাবিনি, একই রাজনীতিও করিনি। সেই পার্থক্য সত্ত্বেও বন্ধুত্ব ও কাজের সম্পর্কে কোনো ছেদ পড়েছে মনে পড়ে না। সেই সম্পর্কের ধরনের মধ্যে যে মধুর ও ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলো ছিল, তা ছিল অসাধারণ।’

১৩.
প্রতিবাদী লেখক, প্রগতিপন্থি সাহিত্যকর্মী ও সংগঠক আহমদ ছফা, আমাদের সেই আলোকিত নক্ষত্র, যে নক্ষত্রের মৃত্যু নেই, আলো ছড়িয়ে যায় অনন্ত কাল। সেই ‘মহাত্মা’ ছফা অজানালোকে চলে গেছেন কিন্তু নতুন সাহিত্যিকদের এক অনুসরনীয় নানা রকম দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী সৃষ্টিশীল লেখক আহমদ ছফাকে আমাদের সবার আরো জানার চেষ্টা করা উচিত, মনোযোগ দিয়ে তাঁকে পাঠ করা জরুরি বিবেচনা করি। এমন মনের মানুষ কালেভ্রদ্রে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে মহাত্মা ছফা ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি আবারো জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, চিন্তা, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত