জন্মদিনের শুভেচ্ছাঞ্জলি

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০১৮, ১০:২৫

লেখক ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

১.
আমার, আমাদের অনেকেরই প্রিয় আবৃত্তিশিল্পী, অভিনেতা, মুক্তিযোদ্ধা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় (Jayanto Chattopadhyay )। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় কেবলমাত্র একটি নাম নয়; একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। আমাদের সকলের প্রিয় 'জয়ন্তদা'। কৃতিমান মানুষ 'দাদা'কে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারার যোগ্যতা আমার নেই কিন্তু এই অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে রয়েছে আমার মনের আকাশে অজস্র স্মৃতির মেঘমালা-রঙধনু। তিনি একইসাথে দুই বাংলার খ্যাত প্রবাদপ্রতিম বাচিকশিল্পী, নাট্যশিল্পী, চলচ্চিত্রাভিনেতা, সংগীত বোদ্ধা, কবি এবং চিত্রনাট্যকার- সবমিলিয়ে একজন পরিপূর্ণ শিল্পী। সর্বোপরি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আজন্ম শিল্পমগ্ন মানুষ জয়ন্তদার আজ জন্মদিন। সনদ অনুযায়ী ১৯৪৭ (প্রকৃত ১৯৪৬) সালের ২৮ জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শুভ জন্মদিন দাদা। এই সফল অভিনেতা, জনপ্রিয় আবৃত্তি শিল্পী এবং মননশীল মঞ্চকর্মী সব মহলেই সবিশেষ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন, জয় করেছেন শ্রোতা-দর্শকদের মন। শিল্প সাধনায় নিমগ্নতায় জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় যাপন করেন জীবনানন্দে, রসের আরাধনায় পরিপূর্ণতায় আপন সময়গুলি। ভালোলাগা থেকে, উপভোগের জায়গা থেকেই শিল্পজীবন যাপন করে যাচ্ছেন তিনি। নিজেকে অনেকটা কচুরিপানার সাথে তুলনা করতে পছন্দ করেন তিনি। কচুরিপানার মতোন শিল্পের জলে ভেসে বেড়ান, ক্রমাগত স্থানান্তর ঘটে, উপভোগ করেন নিত্য স্নাতক হওয়া সেই শিল্পকলার জলে। যার আবৃত্তি শুনতে বসলে আমার আর কোন কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না সেই প্রিয় শিল্পীর জন্মদিনে তাঁর সুস্থ ও সুন্দর এবং কর্মক্ষম আগামি দিনগুলি কাটবে, নিরন্তর এই শুভ কামনা করি। 

২.
আমাদের সংস্কৃতি শিল্পীগণ স্বীকার করেন, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরেই বাংলাদেশে বাচনিক শিল্প বা আবৃত্তিচর্চা দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে। আবার টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র শিল্পেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় যে শিল্প মাধ্যমেই হাত দিয়েছেন, তাতেই সাফল্য পেয়েছেন। এখনো তিনি অভিনয়শৈলীর গুণে একের পর এক সার্থক নাটক ও সফল চলচ্চিত্র দর্শকদের উপহার দিয়ে চলছেন। উভয় পর্দাতেই তাঁর জয়জয়কার আজো প্রবাহমান। তবে আবৃত্তির প্রতি তাঁর বিশেষ প্রীতি রয়েছে, বলেছেন, ‘আবৃত্তিটা আমার প্রাণের খোরাক। এই একটা কাজ, যা নিয়ে অনেক বেশি ভাবনা-চিন্তা বা পরিকল্পনা করি।’জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় নিজের কাজের বিষয়ে সন্তুষ্টি নিয়ে অকপটে বলেছেন, ‘ছোটপর্দা বা বড়পর্দা যেখানেই কাজ করি, সব সময় তা আত্মতৃপ্তি এনে দিতে পারে না। নিজ ইচ্ছায় সবকিছু করাও সম্ভব হয় না। কারণ নির্মাতা যে ধরনের গল্প বা চরিত্রে কাজ করতে বলেন, তার বাইরে গিয়ে কাজ করা হয়ে ওঠে না।’ স্ব-ভাবে কবিতার জারকরসে প্লাবিত, সাহিত্যপ্রাণ এই শিল্পী-লেখকের প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেও বেশ কয়েকটি কাব্য গ্রন্থও। সাম্প্রতিক সময়ে লেখালেখি নিয়ে জানিয়েছেন, ‘কবিতা লেখাও চলছে। সেন্ড্রু কবিতার সংকলন [চার লাইনের কবিতা] 'কবি ও তুমি' এবং 'আপনি' 'তুমি' 'তুই' কাব্য সংকলনের পর আরেকটি নতুন সংকলন প্রকাশের কথা ভাবছি। এবারের সংকলনের নাম রেখেছি 'আমি'।’ তাঁর একটি কবিতার স্বাদ শুরুতেই গ্রহণ করা যেতে পারে। কবি জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় লিখছেন-
‘একটি জীবন হারিয়ে গেছে
অগ্নিতে আর ধূপে
একটি জীবন ফেলেই দিলাম 
আবর্জনার স্তূপে।
একটি জীবন ধ'রে আছি
পদ্মপাতায় জল,
এ জীবনে কি প্রতিক্ষা আর
অশ্রুতে টলমল?’

৩.
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় একটি ধ্রুবতারার নাম। শিল্পকলার নানা শাখায় তাঁর পরিচয় ফুটে উঠেছে বিভিন্ন মাত্রায়। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে আবৃত্তিকার হিসেবে তাঁর স্থায়ী আসন পাতা রয়েছে হাজারো মানুষের মনের মণিকোঠায়। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব বলা যেতে পারে- যাঁর অনবদ্য অভিনয় ও আবৃত্তি আমাদের সংস্কৃতির ভুবনকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। একাধারে আবৃত্তি ও অভিনয়শিল্পী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি অর্জন করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। প্রায় দুই দশক পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে তাঁর একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান। ২৮ জুলাই, শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর সেগুনবাগিচাস্থ জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান। জন্মদিনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ১০০ মিনিট আবৃত্তি করবেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। ‘অরূপ তোমার বাণী’ শিরোনামে এই আয়োজন সাজিয়েছে আবৃত্তি সংগঠন ‘হরবোলা’। ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘হরবোলার এক কুড়ি’ শিরোনামে বছরব্যাপী নানা আয়োজন সাজিয়েছে সংগঠনটি। এরই অংশ হিসেবে ‘অরূপ তোমার বাণী’ শিরোনামে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ‘হরবোলা’র পরিচালক মজুমদার বিপ্লব আরটিভি অনলাইনকে জানান, ‘পুরো আয়োজনটি টিকিটের বিনিময়ে উপভোগ করতে পারবেন দর্শক-শ্রোতা। টিকিটের মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ ও ১০০ টাকা। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আবৃত্তি অনুষ্ঠানটি শুরু হবে।’ প্রবাদপ্রতিম শিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় জানান, ‘এক সময় তো সারাদেশে ঘুরে ঘুরে আবৃত্তি করেছি। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম টিকিটের বিনিময়ে আবৃত্তি অনুষ্ঠান করেছি। এছাড়া বিদেশে আমার ১২টির মতো একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান হয়েছে। নিয়মিতভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করার জন্য আমন্ত্রণ তো আসেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘হরবোলা থেকে বিপ্লব (মজুমদার বিপ্লব) আমাকে যখন বললো, শুরুতে রাজি হয়নি। এখন তাদের কথা দিয়েছি। অনেক দিন পর দীর্ঘ সময় ধরে আবৃত্তি করব। তা প্রায় ১৫/২০ বছর পর এমন একটি অনুষ্ঠানের মঞ্চে আসছি। আশা করছি, দেড় থেকে পৌনে দুই ঘন্টার মতো আবৃত্তি করবো। বলা চলে, প্রায় ১০০ মিনিট আবৃত্তি করব।’

৪.
আড্ডাবাজ জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় বেশ সৌখিন মানুষ, রসিক সুজন। তাঁর সাথে পরিচয় সেই ১৯৮৯ সালে, তাঁরই ছোটভাই জ্যোতি চট্টোপাধ্যায়, ছোট ভাইয়ের বউ কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় দম্পত্তির আমি ছিলাম ঘরের লোক, ছোট ভাই।ফলে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ও হয়ে ওঠেন আমার স্বজন। তাঁর সাথে রয়েছে অনেক আলোকিত স্মৃতি। তাঁর কাছেই জেনেছি, অভিনয়, আবৃত্তি, রান্না করা, আড্ডা দেয়া কিংবা বই পড়তে তাঁর বেশ ভালো লাগে। বিশেষ করে সব সময়ই তাঁর সঙ্গে বই থাকে। যখন অন্য কিছু করার সুযোগ পান না; তখন বই পড়েন। তাছাড়া মন খারাপ থাকলেও তিনি বই পড়েন। তাঁর বাসায় রয়েছে সুনির্বাচিত বইয়ের একটি সমৃদ্ধশালী গ্রন্থাগার। এছাড়া ভ্রমণ করা তার অন্যতম শখ বলে জেনেছি। দাদার একটা কথা খুব মনে পড়ে- বলে থাকেন, ‘যতক্ষণ না ভালো-নিমগ্ন শ্রোতা কিংবা পাঠক না হতে পারছো ততক্ষণ শিল্পকলার কোন মাধ্যমই তোমাকে ধরা দেবে না’। মহামতি কার্ল মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ তত্ত্ব থেকে লালন সাঁইজির সহজিয়া জীবন দর্শনের অনেক সহজ-সরল ব্যাখ্যা শুনে-জেনে সমৃদ্ধ হয়েছি সে কথা স্বীকার না করলেই নয়।

৫.
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম সাতক্ষীরায়। প্রখ্যাত শিল্প ব্যক্তিত্ব লেডি রানু মুখার্জির বংশের উত্তরাধিকার, রক্ত বহন করছেন তিনি। সেই ঐতিহ্যের সম্মান আরো সমৃদ্ধও করেছেন তিনি আপন সৃজনী শিল্পসেবার আলোর বৈভবময় উজ্জ্বলতা বিকাশে, প্রকাশের নিরন্তর ধারাবাহিকতায়। ফলে পরিবারের সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। ছোটবেলা থেকেই তিনি বেড়ে উঠেছেন এমন এক সংস্কৃতিপ্রেমি পারিবারিক পরিবেশে, যেখানে গানবাজনা আর অভিনয় ছিল আলোবাতাসের মতোই। তার বাবা ভালো আবৃত্তি আর পাঠ করতেন, বাড়িতে ছিল নিজস্ব থিয়েটারের দল। সেই দল বছরে কয়েকটি যাত্রা এবং নাটক মঞ্চস্থ করতো এবং তাতে পরিবারের সবাই অভিনয় করতেন। অনেক ছোটবেলায় এরকমই এক 'পালা'য় বিবেকের সহচর বালক বা 'এক-আনি'র ভূমিকায় জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম মঞ্চে ওঠা। এর পর একটু বড় হয়ে আবৃত্তি আর অভিনয়ের দিকে তার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। পাশাপাশি শিখেছেন গান আর তবলাবাদন।

৬.
কলেজে পড়তে কলকাতায় গিয়ে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় জড়িয়ে পড়েন বামপন্থী রাজনীতির দিকে এবং সেই সূত্রে একটি সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেন। সে সময়ই কলকাতাতে কল্যাণ হালদার এবং কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তি শুনে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় দারুণভাবে মুগ্ধ এবং অনুপ্রাণিত হন। কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তির দল অগ্নিবীণার সদস্য হন তিনি ১৯৬৬ সালে দিকে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আবৃত্তিচর্চাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। দেশের বাইরে সর্বপ্রথম কলকাতায় তিনি একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান করেন। ১৯৬৯ সালে লেনিন জন্মশতবার্ষিকীতে রঞ্জি ইনডোর স্টেডিয়ামে তিনি নজরুল-তনয় কাজী সব্যসাচীর সঙ্গে দ্বৈত ও একক আবৃত্তি করেন। তিনি ভারত-বাংলাদেশের পাশাপাশি ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আবৃত্তি অনুষ্ঠান করেছেন। তার 'আত্মপ্রকাশ', 'আগুনের ডালপালা', 'শুধুই রবীন্দ্রনাথ', 'দ্বিতীয়া', 'দোঁহে', 'লিলুয়া বাতাস' শিরোনামের আবৃত্তি অ্যালবামগুলো ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। 

৭.
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পাঠকালীন শুরু হয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ফলে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাঠ স্থগিত রেখে দুইভাই একসাথে যোগদান করেন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭০-এর দশকে ঢাকা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে একাধিক একক আবৃত্তির অনুষ্ঠান করে জনপ্রিয়তা পান তিনি। আবৃত্তিকার হিসেবে তার প্রতিষ্ঠার পেছনে শ্রোতাদের স্বীকৃতিই প্রধান ভুমিকা রেখেছে বলে মনে করেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। 'মূলত শ্রোতাদের প্রশংসা এবং স্বীকৃতিই আমাকে আবৃত্তিকার করে তুলেছে', বলছিলেন তিনি। এরই পাশাপাশি ১৯৭০-এর দশক থেকেই টিভি নাটকে অভিনয় করছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। কেবল শিল্পী নয়, একজন প্রখর সমাজসচেতন মানুষ হিসেবে চারপাশের নানা অস্থিরতা, অসংলগ্নতা তাঁর মননকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। স্বদেশ ভাবনায় তিনি জনসংখ্যার সংকটকেও বড় করে দেখেন। সামাজিক শৃংখলার বাস্তবতাকে স্বীকার করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট জাতিসত্ত্বার, আত্মপরিচয়ের বিকৃতি, সংকটকেও বড় করে দেখেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অন্তরে ধারণ করেন, আজন্ম বাঙালি সংস্কৃতিকে বহন করেন। সচেতন বাঙালি জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এর শিক্ষা ভাবনা আমাকে তাড়িত করে। এই মুক্তিযোদ্ধার মতে আমাদের চেতনার জাগরণে অসুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থার বদল চান। শিক্ষানীতিকে মৌলিক জায়গা হিসেবে দেখেন। ফলে একক শিক্ষানীতি প্রবর্তনের প্রতি জোর দেন। সুশিক্ষাই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন বলে বিশ্বাস করেন মনেপ্রাণে। বিভিন্ন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার উপর রাষ্ট্রযন্ত্রের কোন নিয়ন্ত্রণই নেই। তিনি বলেন, যে শিক্ষা ব্যবস্থার উপরে রাষ্ট্রের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই সেই শিক্ষা ব্যবস্থা অনুৎপাদনশীল বা ‘নন প্রোডাকটিভ’ বলে মনে করেন। শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশের অনেক কিছুই জানছে না, তাদের ধারণাগুলো অস্পষ্ট। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ নয় অনেকের। বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী এবং মানবিক বাংলাদেশ গড়ে উঠছে না। অব্যবস্থাপনার শিক্ষার কারণে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে উঠছে না, মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তাচর্চার বিকাশ-প্রকাশে সমাজ-রাষ্ট্র যথাযথ ভূমিকা রাখতে অসফল হচ্ছে। 

৮.
‘গুরু’ আলমগীর কবিরের সান্নিধ্যে এসে চলচ্চিত্র জগতের প্রেমে পড়েন, অভিনয়ের প্রতি নিমগ্ন সাধনার ব্রত গ্রহণ করেন। আশির দশকের মাঝামাঝি মোরশেদুল ইসলামের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি সূচনা-তে একটি চরিত্রে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে সিনেমায় তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ। এর পর তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না' আর 'রানওয়ে', হুমায়ুন আহমেদের 'ঘেঁটুপুত্র কমলা' সহ বেশ কয়েকটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং অসংখ্য টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় অভিনয়গুণে সমালোচক ও দর্শকের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে জয়াগা করে নিয়েছেন। তার অভিনীত অসংখ্য ছবি দেশ-বিদেশে পুরস্কার লাভ করেছে। এসব ছবির তালিকায় রয়েছে- 'মাটির ময়না', 'নিরন্তর', 'অন্তর্যাত্রা', 'রূপান্তর', 'বৃত্তের বাইরে', 'দূরত্ব', 'দ্য লাস্ট ঠাকুর', 'কীর্ত্তনখোলা', 'রানওয়ে', 'অপেক্ষা' ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি অভিনয় করেছেন, 'অন্ধ নিরঙ্গম', 'ওস্তাগারের দলিল', 'ফিরে এসো বেহুলা', 'আয়েশা', 'দ্বিতীয় মানুষ', শিরোনামের ছবিগুলোতে। তার অভিনীত ধারাবাহিক নাটক ‘বিশাখা’, টেলিছবি ‘মাউথ অরগান’, অভিনীত নাটক ‘মাটির তার। এখন পর্যন্ত তিনি প্রায় ৭০টিরও অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন বলেই জানতে পারি। এখন তিনি পুরোদস্তুর পেশাদার অভিনেতা। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন নানা সম্মাননা, পুরস্কারও।

৯.
হুমায়ূন আহমেদের নির্মাণগুলোতেও তাঁর প্রাণবন্ত অভিনয় কার না নজর কেড়েছে বলুন! হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে করা কাজগুলোর মধ্যে তাঁর প্রিয় চরিত্রগুলো নিয়ে বলছেন, ‘প্রিয় চরিত্রতো অনেক আছে। তবে সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র হলো ‘ঘেটুপুত্র কমলা’য় ঘেটুর বাবা আর ধারাবাহিক নাটক ‘কালা কইতর’র মজিদ কসাই। এ দুটি চরিত্রই অসাধারণ লেগেছে আমার কাছে। এ ছাড়াও পছন্দের আরও অনেক চরিত্র রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ চরিত্রগুলোকে এতটাই জীবন্ত করে তুলতেন যে, মনে হতো সবগুলো চরিত্রই প্রিয়।’ অভিনেতা জীবনের গল্প বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে নিজেই বলছেন, ‘এটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হুমায়ূন আহমেদ-তারেক মাসুদ আমায় একাকিত্বে ডুবিয়ে চলে গেছেন। ব্যক্তিগতভাবেও এখন আমি ভীষণ একাকিত্বে ভুগি। হুমায়ূন আহমেদের সাথে কাজ করলে যে প্রাণশক্তি পেতাম, যে আনন্দে কাজ করতাম তা কোথায় পাব। আর তারেকের কথা ভাবলে তো কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। ও সর্বশেষ 'কাগজের ফুল' নামে যে চলচ্চিত্রের কথা চিন্তা করছিল, এটা অনেক বড় বাজেটের চলচ্চিত্র- প্রায় ২ থেকে ৩ শত কোটি টাকা বাজেটের চলচ্চিত্র ছিল। ইয়াশ চোপড়ার সাথেও চুক্তি হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশি কোনো চলচ্চিত্রের অস্কার তারেকই আনতে পারত। আর সবচেয়ে বড় কথা তারেক কখনও ওই একটি-দুটি হলে মুক্তি দেওয়ার পক্ষে বা টিভিতে ছবি মুক্তির পক্ষে ছিল না। এ কারণে সারাদেশ চষে বেড়িয়েছে। ক্যাথরিন অবশিষ্ট কাজ করছে। কিন্তু ওদের দুজনার যে কম্বিনেশন ছিল। তা বলার না। আমরা বাংলাদেশি শোবিজ কর্মী হিসেবে অনেক অপূরণীয় ক্ষতিতে পড়েছি।’

১০.
সৃজনশীল শিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় লেখালেখিও করেন। ফেসবুকে প্রায় নিয়মিতই তাঁর কাব্যকলার রস আস্বাদনের সুযোগ পেয়ে থাকেন আমার মতোন আগ্রহীজনেরা। ২০১৬ সালের আলোচনায় জানিয়েছিলেন সুখবরটি, তাঁর ভাষায়, ‘আমি একটু লেখালিখি করি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গদ্য এবং পদ্য দুই মাধ্যমে। কিছুদিনের মধ্যে আমার চারটি বই প্রকাশিত হবে। একটি জাপানী অনুকবিতা 'সেনরু'র আদলে, একটি রোজনামচা, একটি আত্মজৈবনিক আর একটা মহাকাব্যিক চরিত্রের রম্য আলোচনা।’আমরা জয়ন্তদার বইয়ের পাঠের আনন্দ উপভোগের অপেক্ষায় থাকলাম। চলচ্চিত্রের ব্যস্ততার কারণেই ইদানিং তাঁকে ছোট পর্দায় কম দেখা যাচ্ছে। আর ২০১৮ সালের জুলাইতে এসে জানালেন, সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে বলছেন, ‘এ কথা ঠিক যে, গত দু-তিন বছর ধরে চলচ্চিত্রের কাজ নিয়েই বেশি ব্যস্ত। এ ছাড়া লেখালেখি ও আবৃত্তি নিয়েও খানিকটা ব্যস্ত ছিলাম। যেজন্য এ সময়ে নাটকে খুব একটা অভিনয়ের সুযোগ হয়নি।’ ইদানিং যে সব ছবির কাজ নিয়ে ব্যস্ততা, সে নিয়ে জানাচ্ছেন, ‘ক'দিন আগে রাশেদ চৌধুরীর 'চন্দ্রাবতী কথা' ছবির কাজ শেষ করেছি। এ ছবিতে দ্বিজ বংশীদাসের ভূমিকায় আমাকে দেখা যাবে। পাশাপাশি নিগার বানুর 'লোনাপানি' ছবিতে দেখা যাবে যাত্রাদলের অধিকারীর চরিত্রে। এর বাইরে চিত্রপরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করেছি এম সাখাওয়াতের 'আসমানী' ছবিতে। এ ছাড়াও জায়েদ সিদ্দিকীর 'পূর্ণগ্রাসের কাল', গাউসের 'ছেঁড়া জুতা'সহ আরও বেশকিছু ছবিতে অভিনয় করছি।’

১১.
সামাজিক যোগাযেগের মাধ্যম ফেসবেুকে তাঁর নিজের ওয়ালে পোস্ট করা কাব্য চরণের স্মরণ নিয়ে রস উপভোগ করা যেতেই পারে। যে কবিতায় প্রেমিক কবি জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় প্রিয়ার ছবি আঁকতে চেয়েছেন প্রেমময় ভাষায়। কবিতায় তিনি তুলে ধরেছেন ‘আকুল শরীর মোর-বেআকুল মন’ কেমন করা দুচোখের সর্বনাশা প্রেম চাহনি, দৃষ্টির কথা। কবি যেখানে প্রিয়তমার দেহ সৌষ্ঠবকে তুলনা করেছেন শিল্পের সঙ্গে। সেই সাথে রাধিকার প্রতিরূপ বলেও তুলনা করেছেন বলেই ধারণা করি ।‘মেয়েটি’ কবিতায় তিনি লিখছেন-
এই মেয়েটি ভাসছে যেনো তুলো
নীল আকাশে করছে যাওয়া-আসা,
এই মেয়েটি কেমন-কেমন যেনো
দুই চোখে তার দৃষ্টি সর্বনাশা।
এই মেয়েটি যেনো মেঘের মেয়ে
অন্ধ চোখে হঠাৎ ছড়ায় আলো,
এই মেয়েটি প্রাণের সকল আভা
উজাড় ক’রে বাসতে জানে ভালো।
এই মেয়েটির খোঁপায় সজল মেঘ
গলায় বাজে পাখীর গলার গান,
এই মেয়েটি ঝুম-বরষায় নাচে
পেখম মেলে আনন্দে আটখান।
এই মেয়েটির চোখে আগুন জ্বলে
কিন্তু হৃদয় নরম হিমের কণা,
এই মেয়েটি হাসিখুশীই, তবে –
অসম্মানে কেউটে সাপের ফণা।
এই মেয়েটি ভোরের নরম আলো
দুইটি ডানায় শঙ্খচিলের বেগ,
এই মেয়েটি অনাথ দেখে কাঁদে
মনের ভেতর কেঁপে ওঠে উদ্বেগ।
এই মেয়েটির অনেককিছুই আছে
আঁচলভরা আনন্দগান – সবি,
এই মেয়েটি স্থির ক্যামেরায় তোলা
সাদাকালোয় শিল্পিত এক ছবি।
এই মেয়েটি যখন ডাকে, ‘দাদা…’
আমার সকল ভালোলাগার তার,
এই মেয়েটিই বাজিয়ে দিয়ে যায়
এমন সুরে- মানতেই হয় হার।
ভালো থাকিস, পাগলী…

১২.
কবি জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় আবার ‘নওশাবা, পূনর্বার’ কবিতায় ভাব-অনুভবে জলছবি আঁকেন এভাবে-
নওশাবা তুই, আবার কখন এলি!
মাঠের মাঝেতে হঠাৎ দেখছি একা,
তুইতো কোনো ‘টেলি’র তারকা নোস
যেনো উর্বশী- ভাগ্যের গুণে দেখা।
নওশাবা তুই বাদলা-বাতাস মেখে
আছিস দাঁড়িয়ে নীরব- আপনমনে,
তোর সাথে তো ছিলোনা আর কেউ
একলা থাকার বিহ্বলতার ক্ষণে।
নওশাবা তুই কিভাবে দাঁড়ালি বল
তুলনা মানায় শুধু রম্ভার সাথে,
দেহ-কাব্যের বিচারে জিতলি তুই
শিল্প এবং মানুষের সংঘাতে।
নওশাবা তুই মুদ্রার প্রতি বাঁকে
সাজিয়ে রাখিস শিল্পিত ফুলদল,
যেনো ভাস্কর ছেনি-হাতুড়ির ঘায়ে
গড়েছে মেনকা- রূপেরসে টলমল।
নওশাবা তুই কি ক’রে জানলি বল
শরীরটা শুধু রক্ত-মাংস নয়,
তাতে আঁকা যায় শিল্পের নানা রঙ
যতোই থাকুক নিন্দুক-সংশয়।
নওশাবা তুই কাঁখের কলসী-ছাড়া !
ভেসে গেছে সেটা যমুনার কালোজলে?
সবকিছু ভুলে মুরলীর ডাক শুনে
কালার বিরহে মরলি গোধুলিকালে !
নওশাবা তুই দাঁড়িয়ে যমুনাকূলে
এ তো রাধিকার প্রতিরূপ নিশ্চয়,
তোর মতো ক’রে ভাবে যেনো সকলেই
শিল্পীরা যেনো এমনতরোই হয়।

১৩.
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছেন আমার আরেক প্রিয়জন রবি’দা (বাচিকশিল্পী, লেখক Ravisankar Maitree )। লেখাটার যৎসামান্য তাপ-উত্তাপ তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। শোনা যাক রবিদা’র ভাষ্যে ‘জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় : এক আধারে বিপুল তরঙ্গপ্রাণ’ (২৬ জুলাই, ২০১৮) রচনার কিছুটা, ‘হাতে লাঠি না থাকলে পণ্ডিতকে মানায় না। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় নিজেকে পণ্ডিত মানেন না, তাঁর হাতে তাই লাঠি নেই। কিন্তু আমরা যারা খুব কাছে গিয়ে জয়ন্তদাকে দেখি, তাঁর সঙ্গলাভ করি, আমরা জানি তিনি শুধু আবৃত্তি-টোলের পণ্ডিত নন, তিনি বিচিত্র বোধের গোপন অধ্যাপক। অধ্যাপকের হাতে লাঠি থাকে না, কিন্তু তাঁর কথার বেতটা আমারও বুকে পিঠে পড়ে ঠিকই। একটু অহম্ একটু শ্লেষ একটু ক্ষোভ একটু আক্ষেপ এবং মমতাবোধ তো আবৃত্তিগুরু জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের আচরণে ব্যবহারে রাগে অনুরাগে স্বাভাবিকভাবেই ধরা পড়ে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় আমাদের আবৃত্তির আগুনকে উস্কে দেন। তাঁর আবৃত্তি শ্রোতাদেরকে সমাহিত করে, আন্দোলিত করে ; কিন্তু আবৃত্তিকারকে তিনি তাড়িত করেন না। যদিও তাঁর প্রাথমিক আলাপে সংলাপে বিতাড়নী ভাব থাকে ; সেই বিতাড়ন ভঙ্গিটুকু পার হলেই জয়ন্তদার মতো সহজ মানুষগুরু খুব কমই মেলে।

১৩.২
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় সরাসরি আবৃত্তি শিক্ষকতা কমই করেন। তিনি আবৃত্তির শিক্ষকতাকে মানতেই চান না। কিন্তু তাঁর কাছে নত হয়ে বসলেই আমরা বিনীত শিক্ষার্থী হয়ে যাই। আমরা যারা জয়ন্তদার বাড়িতে বারবার পাত পাতার সুযোগ পেয়েছি, আমরাই তাঁর প্রকৃত শিক্ষার্থী হতে পেরেছি। প্রকৃত শিক্ষালাভ হয় গুরুগৃহ থেকে। আবৃত্তিগুরু জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় তাঁর গৃহে নিয়ে গিয়ে আপনি আচরি আমাদেরকে শিখিয়েছেন। আবৃত্তিগুরুর বাড়িতে আড্ডায় পানে আহারে গোপন কালিতে আমরা অনেক কিছুই লিখতে পড়তে শিখি ; কিন্তু সেই শিক্ষার আলোগুলো বড্ড দেরিতে জ্বলে বলে সলতে পাকানোর আয়োজনকথা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ভুলেও যাই। ঢাকায় তখন টেলিভিশনের তৃতীয় প্রজন্ম, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এনটিভি থেকে আবৃত্তি অনুষ্ঠান নির্মাণের আমন্ত্রণ পেয়েছেন। আমি তাঁর সহযোগী মনোনীত হয়ে সানন্দে ছুটে ছুটে কাজ করছি। প্রতিদিনি প্রচুর কবিতা জড়ো করছি। চলছে আবৃত্তিকার নির্বাচন এবং আমন্ত্রণ। একেক জন আবৃত্তিকারের কাছ থেকে জয়ন্তদা দীর্ঘ ধৈর্য ধরে কবিতা শুনছেন। মঞ্চ আর রেডিও টেলিভিশন এক নয় ; আবৃত্তির স্বরপ্রক্ষেপণেও মাধ্যমকে মনে রাখতে হয়। আমরা তখন নতুন করে টেলিভিশনে আবৃত্তির ধরন বরন বুঝে নিচ্ছি। তুমুল আড্ডা, চা সিঙাড়া সমানে চলছে আবৃত্তিনিবিড়প্রাণ আহসান দীপুর সৌজন্যে। আমাদের মধ্যে সর্ব অগ্রজ বেলায়েত হোসেন এবং খুব সম্ভব সর্বকনিষ্ঠ মজুমদার বিপ্লব। বেলায়েত ভাই থেকে বিপ্লব এবং আমরা কেউই জয়ন্তদার প্রকাশ্য স্নেহ এবং গোপন বেত্রাঘাত থেকে বঞ্চিত হচ্ছি না। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় একটি প্রাইভেট টেলিভিশনে ‘কবিতালাপ’ নামে নিয়মিত আবৃত্তির অনুষ্ঠান হবে ; আর সেই অনুষ্ঠানের আবৃত্তিমান-অপমানের দায় তিনি নেবেন না তা তো হবার নয়। কিন্তু শুধুই কি অনুষ্ঠানদায় ? আসলে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় কাউকে কাছে টেনে নিলে তাঁর অনেক দায়ই নিজের কাঁধে তুলে নেন। কপট কপাট পার হয়ে যারা জয়ন্তদার অন্তর্গৃহে প্রবেশ করে তারাই জানে- তিনি ভেতরে ভেতরে একজন নরম পরম আবৃত্তিগুরু, অভিভাবক। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান সামনে রেখে আমরা বেশ কজন কাঁচা-পাকা আবৃত্তিকার প্রায় দেড় যুগ আগে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যয়ের কাছ থেকে নিবিড় পাঠ নিয়েছিলাম। জয়ন্তদার কাছ থেকে শিখেছিলাম- কণ্ঠস্বরের উপরে অতিরিক্ত আবেগ ঢেলে দেওয়া যাবে না ; শব্দ নিয়ে খুব বেশি নাড়াচাড়া এবং ঘা মারার দরকার নেই ; অপ্রয়োজনে কণ্ঠস্বর উদাত্ত সপ্তকে নেওয়া যাবে না, ঠাঁই না পেয়েও মন্দ্র সপ্তকে কণ্ঠসাঁতার দেওয়া চলবে না, উচ্চারণসর্বস্ব আবৃত্তিপ্রবণতা থেকে মুক্ত হতে হবে।

১৩.৩
দূর থেকে আমরা একেকজন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়কে একেকভাবে দেখেছি। কাছে থেকেও কি তাঁর ভেতরের মানুষটাকে, তাঁর শিল্পীসত্তাকে চিনতে পেরেছি? কোনো শিল্পী কিংবা যে-কোনো ব্যক্তিকে চেনার জন্যে আমরা কিছু সহজ সূত্র প্রয়োগ করি। আমকে যেমন ল্যাংড়া গোপালভোগ হিমসাগর ফজলি নামে-ধামে চিনতে চাই, তার স্বাদ বিচার করতে চাই- ব্যক্তিকে চিনতে জানতে মানতে বুঝতেও আমরা কিছু অঙ্ক কষি। অর্থ মান যশ ক্ষমতা জাত-অভিজাত এবং রাজনীতির আদর্শ অনাদর্শ অপাদর্শ ইত্যাদি স্টিকার দেখে ব্যক্তিকে আমরা নিজের সুবিধামতো গ্রহণ বর্জন করি। ব্যক্তিত্বহীন সুবিধালোভী আবৃত্তিযশপ্রার্থীরা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়কে গোপনে মানেন ; কিন্তু এই গোপনভীরু ভক্তরা প্রকাশ্যে তাঁর সম্পর্কে সঠিক কথাটি বলেন না। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ও নিজেকে সহজে সবার কাছে ধরা দেন না। আমরাও ধরতে না পেরে পরিত্যক্ত পালক নিয়ে পাখির ডানা, পাখির আকাশ নিয়ে কথা বলি। আমাদের শরীরে কতোকগুলো ছিদ্র আছে। আমরা সবাই সঠিক করে জানিও না কোন্ ছিদ্রের কী কী কাজ? শরীরের সব ছিদ্রকেই ছিদ্রও বলা যায় না। দুটি ছিদ্রকে বলা যায় শ্বাস নিশ্বাসের পথ, আর দুটোকে বলা যায় শ্রবণ পথ, সবচেয়ে বড়ো ছিদ্রটাকে বলা যায় ভাবপ্রকাশের অমিয় পথ। কীটেরা সকল মানুষের সকল পথকেই ছিদ্র মনে করে। কিছু কিছু মানুষের মধ্যেও কীটের স্বভাবদোষ বর্তমান, তাঁরা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের মুখনিঃসৃত অমিয় আবৃত্তি শুনতে পান না; তাঁরা আসলে কানকানা অন্ধবন্ধ মানুষ। ওইসব কানকানারা ঝর্নাজলের কাছে গিয়েও পাহাড়ের ছিদ্র খুঁজে বেড়ায়।’ 

১৪.
প্রিয় শিল্পী জয়ন্তদার জন্মদিনে আবারো তাঁকে জানাই নিরন্তর শুভেচ্ছা। দাদা, আপনি ভালো থাকবেন, সবসময়, সবাইকে নিয়েই।

(তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ঢাকা টাইমস, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত