জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

রজনীকান্ত সেন

প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০১৮, ১১:০৯

১.
বিংশ শতকের বাংলা গানের যে সকল পথিকৃৎদের নাম আজও উচ্চারিত হয় তাঁদের মধ্যে অবিস্মরণীয় রজনীকান্ত সেন। কান্তকবি নামে খ্যাত বাঙালি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকা প্রখ্যাত কবি, গীতিকার এবং সুরকার রজনীকান্ত সেন। ঈশ্বরের আরাধনায় ভক্তিমূলক ও দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ বা স্বদেশ প্রেমই তাঁর গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও উপজীব্য বিষয়। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই । কবি, গীতিকার এবং সুরকার রজনীকান্ত সেনের জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, ক্ষণজন্মা এই অমর সঙ্গীতকার ও লেখক ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। দ্বিধাহীন অনুভূতির কবি রজনীকান্ত সেনের গানে আত্মধিক্কার এবং ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদনের যে-আকুলতা ফুটে ওঠে, তা বাংলা সংগীতের এক বিশিষ্ট ধারা। অর্থাৎ, এ গান যে রজনীকান্তেরই, এমন একটি স্পষ্টতা থেকে যায় গানগুলিতে এবং সুরের আন্তরিকতায়। এই স্বাতন্ত্র্য নিয়েই, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, কাজী নজরুলের সৃষ্টির পাশাপাশি রজনীকান্তও থাকবেন ঔজ্জ্বল্যে মহিমায়। তবুও সংশয় নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে, জন্মের সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে গেল অথচ স্মৃতির অতলেই রয়ে গেলেন কী রজনীকান্ত সেন?

২.
রজনীকান্ত সেনের নীতি কবিতাগুলো আমরা প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের বাংলা পাঠ্য পুস্তকে সবাই পড়েছি যেমন তাঁর বিখ্যাত কবিতা-‘স্বাধীনতার সুখ’- “বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, / কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই।” অথবা- ‘পরোপকার’ “নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল।” ইত্যাদি কবিতাগুলো এখনও পাঠ্য পুস্তকে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলেই জানি। তবে এখন ক’জনই বা আর মনে রেখেছি কবিতাগুলোর কবি রজনীকান্ত সেনের কথা? আবার সেই রজনীকান্ত সেন মানে সেই উদ্দীপক দেশাত্মবোধক গান ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই /দীন দুঃখিনী মা যে আমার এর বেশি আর সাধ্য নেই’ /ঐ মোটা সুতোর সঙ্গে মায়ের অপার স্নেহ দেখতে পাই/ আমরা এমনি পাষাণ, তাই ফেলে ঐ, পরের দোরে ভিক্ষে চাই” । রজনীকান্ত সেন মানেই স্নিগ্ধ প্রশান্তির আত্ম নিবেদনের গান ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করো মলিন মর্ম মুছায়ে’ । দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমসাময়িক এই গীতিকারের গানগুলো খুবই জনপ্রিয়। দুই বাংলায় পরিচিত পঞ্চকবির এক কবি তিনি। উল্লেখ্য, অপর চার জন হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুল প্রসাদ ও দ্বীজেন্দ্রলাল রায়। তাঁর রচিত গানগুলোকে বিষয়বস্তু অনুযায়ী চারটি ভাগে বিভাজিত করা হয়েছে যথা- দেশাত্মবোধক গান, ভক্তিমূলক গান, প্রীতিমূলক গান এবং হাস্যরসের গান। তবে রজনীকান্তের দেশাত্মবোধক গানের আবেদনই বিশাল ও ব্যাপক।১৯০৫ থেকে ১৯১১ সালে বৃটিশ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলন চলাকালে 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই' গানটি রচনা করে অভূতপূর্ব গণ আলোড়নের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। সে প্রসঙ্গে ‘কান্তকবি রজনীকান্ত’ গ্রন্থে সুরেশচন্দ সমাজপতি লিখেছিলেন, ‘কান্তকবির ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ প্রাণপূর্ণ গানটি স্বদেশি সংগীত-সাহিত্যের ভালে পবিত্র তিলকের ন্যায় বিরাজ করবে।’ আর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখেছিলেন, ‘এই উন্মাদক ধ্বনি প্রথম যেদিন আমার কানে প্রবেশ করিল, সেই দিন হইতেই গীত-রচয়িতার সঙ্গে পরিচিত হইবার ইচ্ছা মনোমধ্যে প্রবল হইয়া উঠিল’। রজনীকান্তের গান বাংলার মৌলিক সাঙ্গীতিক উপাদানে সমৃদ্ধ। তার গানে সহজ ভাবপূর্ণ কথার সাথে সুরের আবেদন শ্রোতাকে আকর্ষণ করে। পশ্চিমবঙ্গের প্রচারমাধ্যমগুলোতে তার গান নিয়মিত গীত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের পাঠ্যসূচিতেও কান্তগীতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

৩.
‘সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি, ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে
তুমি সদা যার হৃদে বিরাজ দুঃখ জ্বালা সেই পাশরে-
সব দুঃখ জ্বালা সেই পাশরে।’
পঁচিশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের লেখা এই ব্রহ্মসংগীতের অন্তর্গত সারাত্সার যিনি সারাজীবন হৃদয়ে গ্রহণ করে সবরকম মর্ত্যজ্বালাকে ভুলে থাকতেন, তিনি রজনীকান্ত সেন। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে রজনীকান্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। জীবনের মাঝ ভাগে আক্রান্ত হয়েছিলেন গলার ক্যানসারে। ১৯০৯ সালে রজনীকান্ত কণ্ঠনালীর ক্যান্সার শনাক্ত হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯১০ তারিখে ইংরেজ ডাক্তার ক্যাপ্টেন ডেনহ্যাম হুয়াইটের তত্ত্বাবধানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ট্রাকিওটোমি অপারেশন করান। এতে তিনি কিছুটা আরোগ্য লাভ করলেও চিরতরে তাঁর বাকশক্তি হারান। কথাও বলতে পারতেন না । অপারেশন পরবর্তী জীবনের বাকি দিনগুলোয় হাসপাতালের কটেজেই কাটাতে হয়। সেখানেই তার শেষ ঠিকানা ছিল ১২ নম্বর কটেজ। ১৯১০ সালের ১১ জুন তারিখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রজনীকান্ত সেনকে দেখার জন্য হাসপাতাল যান। রোগশয্যায় তাঁর পাশে বসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্য পরিচয় খুঁজে পেয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গে পরে লিখেছিলেন, “প্রীতিপূর্বক নমস্কারপূর্বক নিবেদন, সেদিন আপনার রোগশয্যার পাশে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই । পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই । আপনি যে গানটি পাঠাইয়াছেন, তাহা শিরোধার্য করিয়া লইলাম।” আর এ উপলক্ষে হাসপাতালে রোগ শয্যায় বসেই রজনীকান্ত এই গান-কবিতাটি রচনা করে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন-
‘আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে, গর্ব করিতে চূর,
তাই যশ ও অর্থ, মান ও স্বাস্থ্য, সকলি করেছে দূর?
ঐগুলো সব মায়াময় রূপে, ফেলেছিল মোরে অহমিকা-কূপে,
তাই সব বাধা সরায় দয়াল করেছে দীন আতুর’।

৪.
আমরা জানি, স্রষ্টার সাধনা চির-অতৃপ্তিকে আস্বাদন করা। একটি রচনার শেষে স্রষ্টা রজনীকান্ত কী সহজভাবে বলে গিয়েছেন, ‘দ্বিধাহীন অনুভূতি হৃদয়ে বহিয়া যায়’। আবার কারো কারো কাছে সামগ্রিক বিচারে মনে হতে পারে, হয়েছে, রজনীকান্তের জীবন বড় ঘটনাবিহীন। কারণ তাঁর আত্মজীবনীর খসড়ায় প্রথম বাক্যে লিখেছিলেন, ‘আমার জীবন ক্ষুদ্র, বৈচিত্র্যহীন, নীরস।’ তবে ভাবতে অবাক লাগে যখন তাঁর লেখনীতে পড়ি, ‘আমার একটা চেষ্টা ছিল যে, Poetry আর গানে সব class of reader-দের মনস্তুষ্টি করব। এইজন্য average reader-দের জন্য করেছিলাম, একটু higher circle-এর জন্য serious করেছিলাম, আর-এক বিশুদ্ধ আমোদের জন্য comic করেছিলাম।’ শোকে তাপে জর্জরিত, কর্কটরোগে বিধ্বস্ত ও বীতকণ্ঠ সেই রজনীকান্ত সেন ভাবতেন- “ভাবিতাম, ‘আমি লিখি বুঝি বেশ,/ আমার সঙ্গীত ভালবাসে দেশ,’/ তাই, বুঝিয়া দয়াল ব্যাধি দিল মোরে,/ বেদনা দিল প্রচুর;/ আমায়, কত না যতনে শিক্ষা দিতেছে/ গর্ব করিতে চূর!” এমন পরম আস্তিক্যবাদী উচ্চারণ পৃথিবীর খুব কম সারস্বত কর্মীর জীবনেই শোনা গেছে।তবে এখানে যে ঈশ্বর বা দৈবনির্ভরতার প্রসঙ্গ এসেছে, তার পাশে পড়ে নেওয়া যায় রজনীকান্তের কবিতায় এক ‘স্নেহ-বিহ্বল, করুণা-ছলছল’ বাস্তব জননীর সন্তানের শিয়রে-বসা অতন্দ্র প্রতিমার উপস্থিতির কথা, যাঁকে দেখে মনে হয়, ‘আপনি মঙ্গলা, মাতৃরূপে আসি’,/ শিয়রে দিল দেখা পুণ্য-স্নেহ-রাশি;/ নমো নমো নমঃ, জননী দেবি মম!/ অচলা মতি পদে মাগি রে!’

৫.
সমালোচকগণ বলেছেন, রজনীকান্তর গানের সুরে বাংলা গানের মৌলিক সাঙ্গীতিক উপাদান – কীর্তন, বাউল, পাঁচালি, রামপ্রসাদী গানের প্রভাব পাওয়া যায়। রজনীকান্তর সাঙ্গীতিক ভিত্তিভূমি নির্মিত হয়নি কোন প্রথাগত শাস্ত্রীয় সঙ্গীর শিক্ষায় কিংবা রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের মত পাশ্চাত্ত সঙ্গীতের রূপরস আত্মস্থ করেন নি । তাঁর গানে ভক্তিভাবের সহজ অভিব্যক্তি ও সুরের আবেদন হৃদয়গ্রাহী । তাই রজনীকান্তর পঁচাত্তর ভাগ গানেরই স্বরলিপি না থাকলেও যে সামান্য সংখ্যক গান এখনো গীত হয়, তার জোরেই রজনীকান্ত সেন বাংলার পঞ্চকবির একজন হয়ে আছেন , তাঁর গান আজও বাংলার সঙ্গীত ভান্ডারে অক্ষয় সম্পদ । পরমেশ্বরের পদতলে আশ্রিত এক প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণকারী রজনীকান্তর ঈশ্বরভক্তিই ছিল তাঁর গানের মুখ্য বিষয় । সরল শব্দের বুননে ভক্তিমূলক এই গানগুলি্তে রয়েছে হূদয় মথিত করা আবেগ । বহুশ্রুত ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’ গানটিতে ঈশ্বরের প্রতি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ভুল-ভ্রান্তি, শোক-তাপ এবং পাপ মোচনের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর আরও কয়েকটি ভক্তিরসের গান হলো: ‘আমিতো তোমারে চাহিনি জীবনে’, ‘কেন বঞ্চিত তব চরণে’, ‘আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছ’, ‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব’ প্রভৃতি। গানগুলির মধ্য দিয়ে ভক্তিরস ও আত্মনিবেদন প্রকাশ পেয়েছে,, তেমনি রয়েছে জীবন ও জগতের প্রতি আপন বিষন্নতা ও বৈরাগ্যভাবনা।

৬.
তাঁর সমকালীন কবিদের মতো তিনি হাজার খানেক গান লেখেননি। অথচ কথা ও সুরের সারল্যের জন্য তাঁর সঙ্গীত রসিক শ্রোতার মন ছুঁয়ে যায়। তাঁর সমকালীন কবিদের জন্মের সার্ধশতবর্ষ যখন সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে তখনই কান্তকবির জন্মের সার্ধশতবর্ষটা যেন নীরবেই কাটালো সংস্কৃতিবান, রুচিশীল বাঙালি। মাত্র ৪৫ বছরের জীবনে রজনীকান্ত দেখেছিলেন মৃত্যুর মিছিল। সেই শোক আর স্বজন বিয়োগের যন্ত্রণাকে সঙ্গী করেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সঙ্গীত, কাব্য সৃষ্টিতে মগ্ন ছিলেন তিনি। তার কবিতার বিষয়ে কবি হেমেন্দ্রলাল রায় ‘ভারতী’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘কান্ত কবির বিশেষত্ব এই যে, তাঁহার কবিতা বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ ভক্ত এবং রসিক সকলেরই সমান উপভোগ্য- সকলেরই সমান আদরের বস্তু।’ আবার গবেষক সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘জীবিতকালে রজনীকান্তের দেশব্যাপী পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি ছিল দু’রকমের- গায়ক রূপে এবং গানরচয়িতা রূপে। তাঁর কবিপরিচয় গৌণ এবং সেইসব কবিতা কিছুটা কাহিনিধর্মী এবং প্রধানত নীতিকথায় ভরা, কাজেই তাকে শুদ্ধ কবিতা বা pure poetry বলা চলে না। অথচ তার পাঠকপ্রীতি কিছু কম ছিল না। তেমন একটা কবিতা দেখা যাক, যার শিরোনাম ‘চিত্রিত মানব’। বলা হচ্ছে- ‘অর্থ আছে, কপর্দক নাহি করে ব্যয়;/ বিদ্যা আছে, কারো সনে কথা নাহি কয়;/ বুদ্ধি আছে, ব’সে থাকে কাজ নাহি করে;/ রূপ আছে, বদ্ধ থাকে গৃহের ভিতরে;/ শক্তি আছে, নাহি করে পর-উপকার;/ তেজঃ আছে, দাঁড়াইয়া দেখে অবিচার;/ সে নর চিত্রিত এক ছবির মতন,-/ গতি নাই, বাক্য নাই, জড়, অচেতন।’ একে ঠিক নীতি-কবিতা বলা যাবে না, অথচ ভিতরে-ভিতরে কবি বুনে দিয়েছেন এই মানবজন্মের যথার্থ কর্তব্যবোধকে। বলতে চেয়েছেন মানুষের থাকা উচিত সচলতা ও আপন অর্জনের যথাযথ ব্যয় তথা সমাজপ্রবণতা। অর্থ সঞ্চয়ের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত তা সব দিকে ছড়ানো, বিদ্যার প্রকৃত অভিমুখ হল প্রকাশ্যে তার উচ্চারণ। বুদ্ধি মানুষকে কর্মশীল করে, রূপের কাজ তাকে বাইরে মেলে ধরা। যার শক্তি থাকে তার প্রকৃত সামর্থ্য বোঝা যায় পরোপকারে এবং যার তেজ থাকে তার কাজ হল অবিচার ও অন্যায়ের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সমাধান। এ সব না করে যারা আত্মগত বদ্ধতায় জীবনকে বেঁধে রেখেছে তাদের সঠিক সংজ্ঞায় মনুষ্যধর্মী বলা চলে না।’

৭.
রজনীকান্তের জন্ম অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তর পাবনা জেলার তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার (এখন জেলা) ভাঙাবাড়ি গ্রামে ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই । সংগীত ও সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিবেশে জন্ম রজনীকান্তর বাবা গুরুপ্রসাদ সেন মা মনমোহিনী দেবী। রজনীকান্তের বাবা গুরুপ্রসাদ সেন পেশায় ছিলেন ঢাকার মুন্সেফ পরে বরিশালের সাব-জজ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্য পরিচয় হল তিনিও কবি ছিলেন। ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলী ও শিবদুর্গার পদাবলী রচনা করেছিলেন। পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ছিলেন সেই সময়ের দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞও ছিলেন। লিখেছিলেন ‘পদচিন্তামণি’ নামে একটি কীর্তন সংকলন ও ‘অভয়া বিহার’ নামে একটি গীতিকাব্য সংকলন । ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি রজনীকান্তের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। ছোটবেলায় একটি বাঁশিতেই চলত তাঁর সঙ্গীতের অনুশীলন। রজনীকান্ত সেনের মা মনোমোহিনী দেবী বাংলা সাহিত্যের প্রতি বেশ অনুরক্ত ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে কিশোর রজনীকান্তের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। এই আলোচনা-পর্যালোচনাই তাঁর ভবিষ্যত জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।

৮.
শৈশবে রজনী খুবই চঞ্চল ও সর্বদাই খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু তাঁর নৈতিক চরিত্র সকলের আদর্শস্থানীয় ছিল। তিনি খুব বেশি সময় পড়তেন না। তারপরও পরীক্ষায় আশাতীত ফলাফল অর্জন করতে পারতেন। পরবর্তীকালে এ বিষয়ে তিনি তাঁর দিনপঞ্জি বা ডায়রিতে উল্লেখ করেছেন, ‘আমি কখনও বইপ্রেমী ছিলাম না। অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।’ বিদ্যালয় অবকাশকালে প্রতিবেশীর গৃহে সময় ব্যয় করতেন। সেখানে রাজনাথ তারকরত্ন মহাশয়ের কাছ থেকে সংস্কৃত ভাষা শিখতেন। এছাড়াও, গোপাল চন্দ্র লাহিড়ীকে তিনি তার শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়েছিলেন। রজনীকান্ত রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে ২য় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। এর ফলে তিনি প্রতিমাসে দশ রূপি বৃত্তি পেতেন। পরবর্তীতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী কলেজ থেকে ২য় বিভাগে এফ.এ পাস করে সিটি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৮৮৯ সালে বি.এ পাস করে করেন। অতঃপর একই কলেজ থেকে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে পরিবারকে সহায়তা করার জন্য আইন বিষয়ে বি.এল ডিগ্রী অর্জন করেন রজনীকান্ত সেন। এক সময় প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলেও হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাওয়ায় জীবনটা ছিল তাঁর কাছে একটা বড় পরীক্ষা। আর সব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে তিনি এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের সরকার কর্তৃক তিনি নাটোর, নওগাঁ ও বরিশালে মুন্সেফ হিসেবে চাকরি করেন। কিছুদিন চাকরি করার পর ভাল না লাগায় ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।

৯.
শৈশবকাল থেকেই তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও সাবলীলভাবে বাংলা ও সংস্কৃত- উভয় ভাষায়ই কবিতা লিখতেন। তিনি তাঁর রচিত কবিতাগুলোকে গান আকারে রূপ দিতে শুরু করেন। আর তারই প্রকাশ দেখি হিন্দু হস্টেল থেকে পড়াশুনা করার সময় তিনি স্বরচিত গান খঞ্জনী বাজিয়ে গেয়ে পথ পরিক্রমা করতেন। কবি রজনীকান্তের কবিতাগুলো স্থানীয় উৎস, আশালতা প্রমুখ সংবাদ-সাময়িকীতে অনেকবার প্রকাশিত হয়েছিল। ভাঙ্গাকুঠি গ্রামের তারকেশ্বর চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর বন্ধু। তাঁর সঙ্গীত সাধনাও রজনীকে সঙ্গীতের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ গড়তে সাহায্য করে। চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর বন্ধু তারকেশ্বর চক্রবর্তীর। তারকেশ্বর ভাল গান গাইতে পারতেন আর সেই কারণেই যেন গানের প্রতি রজনীকান্তের অনুরাগ বেড়ে গিয়েছিল। রজনীকান্তের কন্যা শান্তিলতা দেবীর একটি লেখা থেকে জানা যায়, ‘এক অর্থে এই তারকেশ্বর চক্রবর্তীই হলেন রজনীকান্তের সঙ্গীতগুরু— যদিও ঠিক নিয়ম মেনে প্রথাগত সঙ্গীতাভ্যাস রজনীকান্ত করেননি।’ তবু জানা যায় তিনি নিজেও সুগায়ক ছিলেন। রাজশাহিতে তিনি বিভিন্ন সাহিত্যসভা, মজলিশ এবং অনুষ্ঠানে তিনি স্বরচিত গান গেয়ে আসর মাত করে দিতেন। কলেজ জীবনের দিনগুলোতে তিনি গান লিখতেন। অভিষেক অনুষ্ঠান ও সমাপনী বা বিদায় অনুষ্ঠানেই গানগুলো রচনা করে গাওয়া হতো। তিনি তাঁর অতি জনপ্রিয় গানগুলো খুবই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে রচনা করতে সক্ষমতা দেখিয়েছিলেন। তেমনি একটি গান রাজশাহী গ্রন্থাগারের সমাবেশে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে রচনা করেছিলেন- 
‘তব, চরণ নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরণী সরসা;
ঊর্দ্ধে চাহ অগণিত-মনি-রঞ্জিত নভো-নীলাঞ্চলা
সৌম্য-মধুর-দিব্যাঙ্গনা শান্ত-কুশল-দরশা?

১০.
রজনীকান্ত ওকালতি পেশায় গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। জীবন ধারণের জন্য ওকালতি শুরু করেছিলেন বটে কিন্তু সংগীতরচনা ও কাব্যসাধনায় নিবেদিতপ্রাণ রজনীকান্ত আইনব্যবসাকে অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারেন নি । ১৮৯১ সালে আইন বিষয়ে পড়াশুনার শেষে রজনীকান্ত রাজশাহি শহরে ওকালতি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তবে তাতে তিনি মনোনিবেশ করতে পারেননি। এ সময় থেকে মৃত্যুর প্রায় এক বছর পূর্ব পর্যন্ত রজনীকান্তের জীবন এক অখন্ড আনন্দের খনি ছিল। তাঁর সঙ্গীত-প্রতিভাই তাঁকে অমর করে রেখেছে। সঙ্গীত-রচনা করা তাঁর পক্ষে এমনই সহজ ও স্বাভাবিক ছিল যে, তিনি অবহেলায় উপেক্ষায় অতি উৎকৃষ্ট সঙ্গীত রচনা করতে পারতেন। এক দিকে চলতে থাকে ওকালতি অন্য দিকে গান ও কবিতা রচনা। আর তাই সঙ্গীতের প্রতি তার প্রবল আগ্রহের কথা ব্যক্ত করে তিনি শরৎ কুমার রায়কে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, তাঁর নিজের কথায় ভাষায়, ‘কুমার, আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু আমি ব্যবসায় করিতে পারি নাই। কোন দুর্লঙ্ঘ্য অদৃষ্ট আমাকে ঐ ব্যবসায়ের সহিত বাঁধিয়া দিয়াছিল, কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম; কবিতার পূজা করিতাম, কল্পনার আরাধনা করিতাম; আমার চিত্ত তাই লইয়া জীবিত ছিল। সুতরাং আইনের ব্যবসায় আমাকে সাময়িক উদরান্ন দিয়াছে, কিন্তু সঞ্চয়ের জন্য অর্থ দেয় নাই।’ -একান্ত অনুগত শ্রী রজনীকান্ত সেন।’

১১.
সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী তাঁকে ‘উৎসবরাজ’ বলে অভিহিত করেছেন। ১৯০২-এ তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বাণী’ প্রকাশিত হয়। শোনা যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েও সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ভয়ে তিনি এই বইটি ছাপতে চাননি। পরে জলধর সেনের কলকাতার বাড়িতে সুরেশচন্দ্র সমাজপতি তাঁর গান শুনে সেগুলি গ্রন্থাকারে ছাপাতে বলেন। এর পরে ১৯০৫-এ তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কল্যাণী’ প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনটি এবং মৃত্যুর পরে পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি: বাণী (১৯০২), কল্যাণী (১৯০৫), অমৃত (১৯১০), অভয়া (১৯১০), আনন্দময়ী (১৯১০), বিশ্রাম (১৯১০), সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩), শেষদান (১৯১৬), পথচিন্তামণি এবং অভয় বিহার। এগুলির মধ্যে বাণী ও কল্যাণী গানের সঞ্চয়ন, পথচিন্তামণি একটি কীর্তনগ্রন্থ, আর অভয় বিহার একটি গীতিকাব্য।
 
১২.
যদিও তাঁর মেয়ে শান্তিলতা দেবী একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন যে, তাঁর মোট গানের সংখ্যা ২৯০টি। যদিও এটি সম্পূর্ণ সংখ্যা নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। রজনীকান্তের গানগুলিকে মূলত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলি হল ভক্তিমূলক, দেশাত্মবোধক, হাস্যরসের গান এবং জীবনের গান। ভক্তিরসাত্মক গানে যেমন বোঝা যায় যে রজনীকান্ত ঈশ্বরভক্তির কাছে কি ভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তেমনই হাস্যরসের গান রজনীকান্তের সঙ্গীতবৈচিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ দিক।এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ্য দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যখন রাজশাহিতে এসেছিলেন তখন রজনীকান্তের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানে মুগ্ধ রজনীকান্ত এর পর থেকে হাসির গান লিখতে শুরু করেছিলেন। তবু গবেষকদের মতো রজনীকান্তের হাসির গানের ধরণ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাসির গানের থেকে আলাদা। এ প্রসঙ্গে প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন, ‘দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান যদি শুক্ল শীতের বাতাস হয়, রজনীকান্তের হাসির গান বর্ষায় জলভারাক্রান্ত পূবের বাতাস।’

১৩.
রজনীকান্ত স্বদেশি আন্দোলনের যুগের কবি। ১৯০৫-এ ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন স্থায়ী করতে যাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রজনীকান্ত। চটজলদি গান বাঁধতে তাঁর কোনও জুড়ি ছিল না। স্বদেশী আন্দোলনে তাঁর গান ছিল অসীম প্রেরণার উৎস। ৭ আগস্ট, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কলকাতার টাউন হলে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিলাতী পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন বাংলার প্রখ্যাত নেতৃবর্গ। ভারতের সাধারণ জনগণ বিশেষত আহমেদাবাদ এবং বোম্বের অধিবাসীগণ ভারতে তৈরি বস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু এ কাপড়গুলোর গুণগতমান বিলাতে তৈরি কাপড়ের তুলনায় তেমন মসৃণ ও ভাল ছিল না। এর ফলে কিছুসংখ্যক ভারতবাসী খুশি হতে পারেননি। এই কিছুসংখ্যক ভারতীয়কে ঘিরে রজনীকান্ত রচনা করেন তার বিখ্যাত দেশাত্মবোধক ও অবিস্মরণীয় গান-
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই;
দ্বীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই?
বলা হয়ে থাকে, এই একটি গান রচনার ফলে রাজশাহীর পল্লীকবি রজনীকান্ত সমগ্র বঙ্গের জাতীয় কবি-কান্তকবি রজনীকান্ত হয়ে উঠলেন ও জনসমক্ষে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেন। প্রায়শই তাঁর গানগুলোকে কান্তগীতি নামে অভিহিত করা হতো। এ গানটি রচনার ফলে পুরো বাংলায় অদ্ভুত গণ-আন্দোলন ও নবজাগরণের পরিবেশ সৃষ্টি করে। গানের কথা, সুর ও মাহাত্ম্য বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করায় রজনীকান্তও ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গও গানটিকে উপজীব্য করে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় কর্ম পরিকল্পনা করেন। ভারতীয় বিপ্লবী নেতারাও পরবর্তী বছরগুলোয় বেশ সোৎসাহে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন গানটিকে ঘিরে। রজনীকান্তের দেশাত্মবোধক গানের আবেদনই বিশাল ও ব্যাপক। স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১) চলাকালে ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই’ গানটি রচনা করে অভূতপূর্ব গণআলোড়নের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন। কবি হিসেবেও যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন রজনীকান্ত সেন। নির্মল আবেগ ও কোমল সুরের ব্যঞ্জনায় তাঁর গান ও কবিতাগুলো হয়েছে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ।

১৪.
রজনীকান্তের এই গান বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। তবে এই গানটি রচনার নেপথ্যে একটি কাহিনি রয়েছে। রজনীকান্তের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র। রজনীকান্ত কলকাতায় এসে তখন একটি মেসে থাকতেন, সেখানে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসতেন অক্ষয়কুমার। এক বার সেখানেই সকলে মিলে গান করার জন্য অনুরোধ করলেন রজনীকান্তকে। তখন তিনি নতুন রচিত ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানটি ধরলেন। সবেমাত্র অন্তরার অংশটুকু রচনা করে গেয়েছেন, অক্ষয়কুমার এমন সময় রজনীকান্তকে সোজা নিয়ে এলেন বউবাজারে বসুমতীর অফিসে তৎকালীন সম্পাদক জলধর সেনের দফতরে। বললেন সেই গানের কথা। অসমাপ্ত সেই গানটি পড়ে জলধর বললেন বাকিটুকু রচনা করে দিতে। সেখানে বসেই রজনীকান্ত গানের বাকি অংশটুকু রচনা করেছিলেন।

১৫.
সে কালে রজনীকান্তের গান রেকর্ড করেছিলেন ইন্দুবালা, কে মল্লিকের মতো শিল্পীরা। পরবর্তী কালে বহু বিখ্যাত শিল্পী তাঁর গান রেকর্ড করেছিলেন। এমনকী, তাঁর গান বহু চলচ্চিত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। রজনীকান্ত কখনওই সরকারি মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তেমনই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হননি। আবার শুধু স্বদেশী গান লিখে কিংবা গেয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। প্রয়োজনে ছুটে গিয়েছিলেন গ্রামে গঞ্জে। সেখানে সাধারণ মানুষকে স্বদেশি অন্দোলনের তৎপর্য বুঝিয়েছিলেন।

১৬.
তিনি হিরন্ময়ী দেবী নামের এক বিদুষী নারীকে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে (৪ঠা জ্যৈষ্ঠ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) বিয়ে করেন। হিরন্ময়ী দেবী রজনীকান্তর লেখা কবিতাগুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। কখনো কখনো তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে মতামত ও সমালোচনা ব্যক্ত করতেন। তাঁদের সংসারে চার পুত্র- শচীন্দ্রকান্ত, জ্ঞানেন্দ্রকান্ত, ভুপেন্দ্রকান্ত ও ক্ষীতেন্দ্রকান্ত এবং দুই কন্যা -শতদলবাসিনী ও শান্তিবালা। কিন্তু ভুপেন্দ্র খুব অল্প বয়সেই মারা যায়। রজনী দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে এবং ঈশ্বরের উপর অগাধ আস্থা রেখে পরদিনই রচনা করেন – ‘তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ,
তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব?
তোমারি দুনয়নে তোমারি শোক-বারি,
তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব?’

১৭.
কবি হিসেবেও যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন রজনীকান্ত সেন। নির্মল আবেগ ও কোমল সুরের ব্যঞ্জনায় তাঁর গান ও কবিতাগুলো হয়েছে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ। ‘অমৃত’ কাব্যের কবি রজনীকান্তের বিধাতা বা স্রষ্টার পরম পরিকল্পনার দিকে ঝোঁক দেখা যায়। যেমন, ‘এক কূল ভাঙ্গে নদী, অন্য কূল গড়ে;/ দূষিত বায়ুরে লয় উড়াইয়া ঝড়ে;/ তীব্র কালকূটে হয় শুদ্ধ রসায়ন;/ কাক করে কোকিলের সন্তান পালন;/ দংশে বটে, মধুচক্র গড়ে মধুকর;/ বজ্র হানে যদি, বারি ঢালে জলধর;/ সুখ-দুখ-ভাল-মন্দ-জড়িত সংসার;/ অবিমিশ্র কিছু নাই দৃষ্ট বিধাতার।’ আবার, এই তিনিই অনেকসময় নিতান্ত দু’টি পঙ্ক্তিতে ভরে দিয়েছেন সামগ্রিক ভাবনা তথা তির্যক দৃষ্টিকোণ। দু’টি নমুনা- ‘বিরাম কাজেরই অঙ্গ এক সাথে গাঁথা, / নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা’ কিংবা ‘জন্ম মৃত্যু দোঁহে মিলে জীবনের খেলা, / যেমন চলার অঙ্গ পা-তোলা পা-ফেলা।’ ভাবে ও বক্তব্যে সংযত সংহত অথচ ঠিক নীতি-কবিতা বলা ঠিক নয় এদের, বরং প্রগাঢ় দার্শনিক ভাবনা যেন এর মধ্যে নিবিড়ভাবে ধরা রয়েছে।

১৮.
তাঁর ঐহিক জীবন ছিলো ১৮৬৫ থেকে ১৯১০ সময়কালের, মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর। তারই মধ্যে শোকে তাপে জর্জরিত, কর্কটরোগে বিধ্বস্ত ও বীতকণ্ঠ মানুষটি ভাবতেন- “ভাবিতাম, ‘আমি লিখি বুঝি বেশ,/ আমার সঙ্গীত ভালবাসে দেশ,’/ তাই, বুঝিয়া দয়াল ব্যাধি দিল মোরে,/ বেদনা দিল প্রচুর;/ আমায়, কত না যতনে শিক্ষা দিতেছে/ গর্ব করিতে চূর!” এমন পরম আস্তিক্যবাদী উচ্চারণ পৃথিবীর কোনও সারস্বত কর্মীর জীবনে শোনা যায়নি। এখানে যে ঈশ্বর বা দৈবনির্ভরতার প্রসঙ্গ এসেছে, তার পাশে পড়ে নেওয়া যায় রজনীকান্তের কবিতায় এক ‘স্নেহ-বিহ্বল, করুণা-ছলছল’ বাস্তব জননীর সন্তানের শিয়রে-বসা অতন্দ্র প্রতিমার উপস্থিতির কথা, যাঁকে দেখে মনে হয়, ‘আপনি মঙ্গলা, মাতৃরূপে আসি’,/ শিয়রে দিল দেখা পুণ্য-স্নেহ-রাশি;/ নমো নমো নমঃ, জননী দেবি মম!/ অচলা মতি পদে মাগি রে!’ আমরা জানি, স্রষ্টার সাধনা যে চির-অতৃপ্তিকে আস্বাদন করা। অথচ একটি রচনার শেষে রজনীকান্ত কী সহজভাবে বলে গিয়েছেন, ‘দ্বিধাহীন অনুভূতি হৃদয়ে বহিয়া যায়’। আর তাই স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন ওঠে, একজন প্রকৃত শিল্পীর জীবন কি প্রতি ক্ষণে-ক্ষণে দ্বিধাথরথর চূড়ে থেকে মুক্তিপথ অভিলাষী থাকে না?

১৯.
তার অসংখ্য গানের মধ্যে কিছু গান আছে যেগুলি আমার মত অনেকেরই নিশিদিন অন্তর মাঝে বেজে চলে। তারই একটি—
‘আমি অকৃতি অধম ব’লেও তো কিছু
কম করে মোরে দাওনি;
যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তা কিছু নাওনি ॥
তব আশীষ কুসুম ধরি নাই শিরে,
পায়ে দলে গেছি, চাহি নাই ফিরে;
তবু দয়া করে কেবলি দিয়েছ,
প্রতিদান কিছু চাওনি।’
ছেলেবেলা থেকে এই গানটি অনেকবার শুনেছি। যতবার শুনেছি চোখ ভিজে গেছে। যদিও এই গানটি প্রার্থনাধর্মী। তবে গানটি আমার কাছে বহুমাত্রিক অর্থ বহন করে। কখনও মনে হয় এই গানটিতে বিধাতার প্রতি আকুতি ফুটে উঠেছে। আবার মনে হয় প্রকৃতির উদারতা এবং অকৃত্রিম দানের কথা। কখনও মনে হয় গানটিতে দেশ মায়ের বিশালতা আর জন্মদাত্রী মায়ের ত্যাগের মহিমা ফুটে উঠেছে। সৃষ্টিকর্তা, প্রকৃতি, দেশ এবং মা কখনও প্রতিদানের প্রত্যাশা করে না। অকাতরে শুধু বিলিয়ে যায়। শত ঔদ্ধত্য আর অবহেলাতেও ছেড়ে যায় না। বরং বেশি করে আঁকড়ে ধরে।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, দেশ, বইয়ের দেশ, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক কালের কণ্ঠ, দৈনিক যুগান্তর, করুণাময় গোস্বামী : সঙ্গীত কোষ, বাংলা একাডেমী, সুধীর চক্রবর্তী : বাংলা গানের সন্ধানে, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত