জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ার

প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০১৮, ১৩:০৫

১.
উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম পাইলট ক্যাপ্টেন মুস্তফা আনোয়ার, গাইতে জানতেন মনকাড়া সুরে ভাটিয়ালী গান, আঁকতে পারতেন মনকে নাড়া দেওয়া জীবনের জলছবি, আবার লিখতে পারতেন জীবন শিল্পকেও। পাকিস্তান ভারত বাংলাদেশের প্রথম মুসলিম ও প্রথম বাঙালি মুসলিম বৈমানিক ক্যাপ্টেন ছিলেন মুস্তাফা আনোয়ার। ক্যাপ্টেন আনোয়ার মাত্র ৪১ বছর বয়সে কর্মের মাঝখানে প্রাণ হারান। স্বল্পকালীন জীবনে তিনি অর্জন করেছিলেন ‘সাগর ও আকাশ’-এর স্বর্ণোজ্জ্বল অভিজ্ঞতা। ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ারের জন্ম ১৯১৭ সালের ২৪ জুলাই। জন্মদিনে তার স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। মুস্তাফা আনোয়ার অত্যন্ত সজ্জন ও স্বজনবৎসল ছিলেন। তাঁর হাসিমুখ, সুন্দর ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব ও সততার কোনো তুলনা ছিল না। তিনি কখনো কোনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। তিনি ছোট-বড় সকলকে আপন করে নিয়ে খুব সহজেই মিশে যেতে পারতেন । আনোয়ার অসাধারণ গান গাইতেন। ১৯৫৪ সালে বঙ্গীয় সংস্কৃতি পরিষদের অনুষ্ঠানে গান করে খুব নাম করেন। ‘দেশ’ পত্রিকা তাঁর গানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল। তাঁর কণ্ঠে ছিল উদাত্ত ভাটিয়ালী গান, মাঝে মাঝে রুশ লোকগীতি, ‘ভলগা ভলগা স্ট্রিম ও মাই ভলগা মাদার স্ট্রিম’ও গাইতেন । তিনি ভালো পিয়ানোও বাজাতেন। উল্লেখ্য যে, বিমান পরিচালনাকালে তিনি ১৯৫৯ সালের ১৪ আগস্ট মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। আনোয়ার যখন মারা যান, তখন তার Log Book-এ ১৪,৫০০ ঘণ্টার Flying-এর রেকর্ড ছিল। Civil ও Air Force মিলিয়ে সমগ্র পাকিস্তানে তার মতো অভিজ্ঞ অন্য কোনো Pilot ছিলেন না। সে জন্য সেদিন মাত্র ৪১ বছর বয়সে আনোয়ারের এই অপঘাতে মৃত্যু সারা পাকিস্তানে জাতীয় শোকে পরিণত হয়েছিল। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে এই শোকের ছায়া মিলাতে বহু দিন সময় লেগেছিল। ১৫ আগস্টের Pakistan Times-এ আনোয়ারের জীবনীসহ এই খবর বের হয়েছিল, তাতে লিখেছিল- Mustafa had about 14000 hours flying to his credit. A record which no Pakistani pilot had ever attained.’ কলকাতার Statesman পত্রিকায় ২৫ আগস্ট Capt. Anwar-এর সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ খবর ছাপা হয়েছিল। এ ছাড়া NewYork Times ও Spain-এর একটি পত্রিকায় এই দুঃসংবাদ ছাপা হয়েছিল দুঃখের সঙ্গে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক আজকের প্রজন্মের বৈমানিকদের অনেকেই তাঁর নামও জানে না, দেশ তাকে মনে রাখেনি। আজকের প্রজন্মের বৈমানিকেরা তার নামও জানে না। এ দোষ হয়তো সম্পূর্ণ তাদের নয়, আমরাই জাতি হিসেবে কেমন যেন ইতিহাসবিমুখ হয়ে পড়েছি। তা ছাড়া মনে হয়, এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা অগ্রজদের যোগ্য সম্মান দিতে বড়ই কুণ্ঠিত। জানি না এই অন্ধকারের বৃত্ত থেকে কবে আমাদের মুক্তি মিলবে, সম্মানিতদের শ্রদ্ধা জানানোর মানসিককতার শুভ বুদ্ধি আলোর দেখা মিলবে। 

২.
শুরুতেই উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, দুঃসাহসী এক ক্যাপ্টেনের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে জীবন যে কতটা সংগীতময়, বর্ণিল ও অ্যাডভেঞ্চারে রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছিলো তারই পরিচয় পাই তার স্ত্রী, খ্যাতিমান লেখিকা সুস্মিতা ইসলাম-এর ‘আমার দিনগুলি’ গ্রন্থে। দুর্লভ মানুষদেরই একজন সুস্মিতা ইসলাম, যাঁর আত্মজীবনীগ্রন্থ ‘আমার দিনগুলি’ শুধু তাঁর নিজের জীবনের মহাকাব্যিক আখ্যানই নয়, ব্রিটিশ-ভারত, ভারত-পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই তিনটি দেশ এবং তিনটি যুগের যেন চলমান কালছবিও। সেই সাথে অসম্ভব জীবন্তচরিত্র হিসেবে পাই প্রেমিক, স্বামী ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ারকেও। বরেণ্য শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার আমাদের দেশে পাপেটের জনক। মীনা কার্টুন, সিসিমপুরের শুরু তাঁর হাতে। ‘নতুন কুঁড়ি’ অনুষ্ঠানের স্রষ্টা। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। কবি গোলাম মোস্তফার ছেলে তিনি। তাঁর বর্ণময় জীবনের গল্প শুনতে গিয়ে বড় ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে পরিবারে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, ‘বড় ভাই ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ার আমাকে অনেক রংতুলি কিনে দিতেন।’ শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের শিল্পজীবন যাপনে বড়ভাই ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ার-এর প্রভাব ও সহযোগিতারও অনেক কথা জানতে পারি।

৩.
ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ারকে নিয়ে লেখার শুরুতেই উল্লেখ করতে চাই একটি স্মারক রচনার কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ। সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা জামান আব্বাসী তার ভাতৃপ্রতিম ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে নিয়ে লিখেছেন শোকাজ্ঞলি ‘যে বৈমানিক গাইতেন ভাটিয়ালি গান’। মুস্তাফা জামান আব্বাসী লিখেছেন, ‘ক্যাপ্টেন আনোয়ার ছিলেন আমার আপন বড় ভাইয়েরই মতো। তাঁর হাসিমুখ, সুন্দর ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব ও সততার কোনো তুলনা ছিল না। এমন শান্ত-সুন্দর মুখশ্রীর মানুষ আর পাইনি। ভেবে পেতাম না এমন সুন্দর চেহারা কোনো বাঙালির হতে পারে? তাঁর কণ্ঠে ছিল উদাত্ত ভাটিয়ালি গান, মাঝেমধ্যে রুশ লোকগীতি, ‘ভলগা ভলগা, মাদার স্ট্রিম ও মাই ভলগা মাদার স্ট্রিম’ও গাইতেন। আমার আব্বাও তাঁর গান শুনে অতিশয় মুগ্ধ হতেন। চোখ বন্ধ করলেই যেন সেসব গান শুনতে পাই। মুস্তাফা আনোয়ারের স্ত্রী সুস্মিতা যেমন সুন্দরী, তেমনি বিদ্যায় ও সংস্কৃতিতে অনন্যা। তিনি একাধিক গ্রন্থের লেখিকা। একবার কলকাতার ২৯ নম্বর সার্কাস অ্যাভিনিউতে তাঁদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাঁর আপ্যায়ন ও সেবার কোনো তুলনা ছিল না। বুঝতেই পারিনি আমি তাঁর রক্তের কেউ নই, এমনকি দেবরও নই। কী কোমল স্নেহছায়ায় কাটিয়েছি কয়েকটি দিন। তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি স্নেহমাখা স্পর্শ আজও আমায় আন্দোলিত করে। যেমন করে তিনি ভালোবেসেছিলেন তাঁর স্বামী আনোয়ারকে, তেমনি তাঁর পরিবার, তাঁর ধর্ম ও তাঁর সংস্কৃতিকে। এই সঙ্গেই মনে পড়ছে মন্টু ভাইয়ের [চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার] কথা। মুস্তাফা আনোয়ারের ভাই। সম্ভবত তিনি আমার বড় ভাইয়ের চেয়ে দু-এক মাস বড়, অথচ দারুণ বন্ধুত্ব আমাদের মধ্যে। দুজনই গান গাই, দুজনই দুজনকে ভালোবাসি। একবার একটি মেয়েকে পছন্দ হলো মন্টু ভাইয়ের। মেয়েটি ভারী সুন্দরী। দুজনে একসঙ্গে রোজ ছবি আঁকতে বেরিয়ে যায়, আর আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। সুস্মিতা ভাবি বুদ্ধিমতী। ভাবলেন, মুসলমান ঘরে দুই হিন্দু বউ চলবে না। মেয়েটিকে মিষ্টি কথায় বিদায় দিলেন। একদিন মন্টু ভাই সকালবেলা গুনগুন করছেন কে এল সায়গলের গাওয়া, ‘ম্যায় কেয়া জানু কেয়া জাদু হ্যায়’। একজন ভিখারিনী তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠে বেল বাজালেন। জানালেন, আমি ভিখারিনী নই। শুধু একনজর দেখতে এসেছি সেই ভদ্রলোককে, যিনি ওই গান গাচ্ছিলেন। সুস্মিতা ভাবি আমল দিলেন না, তাঁকে বিদায় করলেন। মন্টু ভাই যদি গানই করতেন, তিনি হতেন একজন সেরা কণ্ঠশিল্পী। ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ারের ক্ষেত্রেও তা-ই। উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁরা দুজন—মুস্তাফা আজিজ, মুস্তাফা পাশা, পেয়েছিলেন পিতার কাব্য, শিল্প ও সংগীতগুণ। জ্যোৎস্না, হাসনা ও হেনা—কবির তিন মেয়েও ব্যতিক্রম নন। পরিবারটি বাংলাদেশের গৌরব।’

৪.
ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ারের জন্ম ১৯১৭ সালের ২৪ জুলাই যশোরের গড়াই নদীর তীরে নানাবাড়ি কমলাপুর গ্রামে। পিতা কবি গোলাম মোস্তফা আর মা জমিলা খাতুনের প্রথম সন্তান তিনি। পৈতৃক নিবাস ঝিনাইদহের মনোহরপুর গ্রামে। উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর দ্বিতীয় ভ্রাতা বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা আজিজ, তৃতীয় ভ্রাতা স্বনামধন্য শিল্পী মুস্তাফা মানোয়ার ও অপর ভাই মুস্তাফা পাশা পেয়েছিলেন পিতার কাব্য, শিল্প ও সংগীতগুণ। সুন্দর চেহারা ও সুস্বাস্থ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুস্তাফা আনোয়ার। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিভিন্ন রকম খেলাধুলায় যেমন—ফুটবল, সাঁতার, লাঠিখেলা কিংবা কুস্তি খেলায় গ্রামের অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিলেন। তাঁর সমকক্ষ গ্রামে আর কেউ ছিল না। শিক্ষকতাসূত্রে পিতা কলকাতায় অবস্থান করতেন। সপ্তাহান্তে গ্রামে এসে শিশু আনোয়ার ও তার মাকে দেখে যেতেন। প্রাথমিক শিক্ষা ননীবাবুর পাঠশালায়, নিজ গ্রাম মনোহরপুর ও শৈলকুপায় প্রাইমারি স্কুলে। কিন্তু বাল্যশিক্ষায় আনোয়ারের তেমন অগ্রগতি হচ্ছিল না। বুঝতে পেরে আনোয়ারের ১১ বছর বয়সে (১৯২৮ সাল) পিতা তাঁকে সঙ্গে করে কলকাতায় নিয়ে যান। সেখানকার শ্রেষ্ঠতম স্কুল হেয়ার স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি করে দেন। কবি স্বয়ং তখন ওই স্কুলের শিক্ষক। কিন্তু স্কুলের প্রথাগত শিক্ষায় আনোয়ার কখনো সেভাবে মনোযোগ দিতে পারেননি। 

৫.
অজানাকে জানার আগ্রহ এবং নতুন কিছু করার তাড়না সবসময়ই তাঁকে অস্থির করে রাখত। এভাবে ১৯২৮ সাল থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করে হেয়ার স্কুলে ক্লাস টেন-এ ওঠেন। তবে সব সময়ই তিনি প্রথম দশজনের মধ্যে নিজের অবস্থান বজায় রেখেছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি গল্প বলার ক্ষেত্রেও তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেন ।এ সময়ে একদিন আমিনুল ইসলাম বলে একটি ছেলের I.M.M.T.S Duffrin-এর প্রবেশ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার রিপোর্ট ক্লাসে এলে আনোয়ার সেই প্রথম জানলেন I.M.M.T.S Duffrin একটি জাহাজ। যে জাহাজে ভবিষ্যতে কাজ করার জন্য ছেলেদের উপযুক্ত বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয়। আর ওই জাহাজটি থাকে বম্বের সমুদ্রে—শহরের কাছাকাছি জায়গায়। প্রতি বছর শিক্ষার জন্য ৪০ জন ছাত্রকে বেছে নেওয়া হয় এবং তারা ভারতের সব প্রদেশ থেকে এসে প্রবেশ পরীক্ষা দেয়। সেদিনকার এই খবরটি আনোয়ারের মনকে আনন্দে ভরিয়ে দেয়। তাঁর মনে হয়, এতদিন ধরে তিনি এমনই একটি পথের সন্ধান করছিলেন। ওই জাহাজ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সৌভাগ্যবশত একদিন সে সুযোগও এসে যায়। পিতার সঙ্গে পিতার এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, ভদ্রলোক I.M.M.T.S Duffrin-এর গভর্নিং বডি’র একজন মেম্বার। স্বাস্থ্যবান ও সুপুরুষ আনোয়ারকে দেখে তিনি কবিকে বললেন আনোয়ারকে Duffrin-এ পাঠাতে। কিন্তু কবি তাঁর কথার কোনো জবাব না দিয়ে নিরুত্তর রইলেন। আর আনোয়ার প্রবল উত্সাহে তাঁর কাছ থেকে Duffrin-এর প্রোগ্রাম এবং ওখানকার লেখাপড়া সম্পর্কে যতদূর সম্ভব খবর নিয়ে উত্ফুল্লচিত্তে বাড়ি ফিরে এলেন। প্রবলভাবে জেদ ধরলেন, (I.M.M.T.S Duffrin Indian Merchant Marine Trainig Ship. এটি একটি মার্চেন্ট মেরিন অফিসারদের স্কুল।) স্কুলের প্রথাগত শিক্ষা বাদ দিয়ে Duffrin-এ ভর্তি হবেন। পিতার প্রচণ্ড শাসন এবং সেইসঙ্গে প্রহার—কোনো কিছুই আনোয়ারকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে ফেরাতে পারল না। একদিন পিতার প্রচণ্ড প্রহারের পর গভীর রাতে আনোয়ার ছোট একটি স্যুটকেসে নিজের ২-৪টি জামা-কাপড় ও জমিয়ে রাখা ২০টি টাকা সম্বল করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। শেয়ালদা স্টেশনের পুলিশের কাছে রাতটুকু কোনোমতে কাটাবার পারমিশন নিয়ে ভোর না হতেই কাছেই হ্যারিসন রোডে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে নিজের অবস্থার কথা জানিয়ে ও তাঁর কাছ থেকে আরও কয়েকটি টাকা ধার নিয়ে সোজা রাঁচিতে চলে যান পিতার এক বন্ধুর কাছে। সেখানে গিয়ে তাঁর গৃহত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বললে সেই ভদ্রলোক তত্ক্ষণাত্ টেলিগ্রাম করে কবিকে জানান যে, তাঁর পুত্র তাঁর কাছেই আছে এবং ভালো আছে। এদিকে আনোয়ার নিখোঁজ হওয়ার পরে বাড়িসুদ্ধ সবার পাগলের মতো অবস্থা। কবি গোলাম মোস্তফা সেই টেলিগ্রাম পেয়ে আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে সোজা রাঁচিতে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আনোয়ারকে Duffrin-এ পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সঙ্গে করে কলকাতায় নিয়ে আসেন। Duffrin-এ যোগদানের জন্য নির্বাচন পরীক্ষা কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে তিন দিন ধরে অনুষ্ঠিত হতো। এই পরীক্ষায় তিনি ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হন।

৬.
ডাফরিনের ট্রেনিং শেষে আনোয়ার B.I.S.N. Co. (ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কো.) ‘S.S. Chyebassa’ নামের জাহাজে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। জাহাজে কর্মরত অবস্থায় ১৯৩৮ সালের ১ আগস্ট টেলিগ্রাম মারফত মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং জাহাজে খুব বেশি ‘সি সিকনেস’ হওয়ার কারণে ১৯৪০ সালের নভেম্বর মাসে কষ্টার্জিত জাহাজের চাকরিতে ইস্তফা দেন। তাঁর এই আচরণে পিতা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণে পৃথিবীর সব ব্রিটিশ কলোনিতে যেমন সিভিল এয়ার রিজার্ভ কর্প গড়ে তোলা হচ্ছিল, ভারতেও তার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু হলে আনোয়ার সেখানে দরখাস্ত দিয়ে মনোনীত হন এবং ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে বিহার ফ্লাইং ক্লাব-এ যোগ দেন। এরপর তিনি ব্রিটিশ ভারত স্টিম নেভিগেশন কোম্পানিতে ক্যাডেট পদে দুই বছর চাকরি করেন।

৭.
১৯৪০ সালের ডিসেম্বরে সিভিল এয়ার রিজার্ভ কর্প-এর জন্য মনোনীত হয়ে ১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে বিহার ফ্লাইং ক্লাবে যোগদান করেন। ১৯৪১ সালের ৯ এপ্রিল সিভিল ফ্লাইং ক্লাবের ট্রেনিং সম্পন্ন করে ওই মাসেই ভারতীয় বিমান বাহিনীতে ক্যাডেট অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪১ সালের ২৩ মে আই.টি.এস ট্রেনিং শেষ করে ১৩ মে ১৯৪১ বিহার ফ্লাইং ক্লাব থেকে ‘এ’ গ্রেডের বৈমানিকের লাইসেন্স পান। ১৯৪১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আম্বালার ইন্টারমিডিয়েট ট্রেনিং সেন্টার-এ কৃতিত্বের সঙ্গে ট্রেনিং সম্পন্ন করে ১৯৪১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ‘উইং’ লাভ করেন। এখানে তিনি বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। এই সময় তিনি তাঁর কোর্সের শ্রেষ্ঠ পাইলট সম্মান লাভ করে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪২ সালের ১০ জানুয়ারি Ormament Training-এর জন্য ‘KOHAT’-এ যান ১৯৪২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে। ফ্লাইং ও বোম্বিং উভয় বিভাগেই বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে পেশোয়ারে গিয়ে No 3 Squadron-এ যোগ দেন। Kohat-এ থাকতে বিদ্রোহী আফ্রিদিদের ওপরে বোমাবর্ষণ-ও করতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর রুমমেট ওই বোমাবর্ষণ করতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। আফ্রিদিরা বন্দুক ছুড়ে তাঁর প্লেন নামিয়ে নিয়েছিল। ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে ইনস্ট্রাকটর কোর্সে যোগ দিয়ে ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাফল্যের সঙ্গে কোর্স সম্পন্ন করে I.T.S.-এ ইনস্ট্রাকটর নিযুক্ত হন। ১৯৪৩ সালের ৩০ অক্টোবর D.C.A.-এর রিজার্ভ পাইলট হিসেবে বিহার ফ্লাইং ক্লাব-এ যোগ দেন। ১৯৪৫ সালের ২২ জুন পাইলট ‘এ’ লাইসেন্স পান। ১৯৪৬ সালের ১৫ এপ্রিল পাইলট ‘বি’ লাইসেন্স পান। নম্বর ৩১৪। এসময় তিনি ফ্লাইং অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।

৮.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভারতের উত্সাহী ব্যবসায়ীরা যুদ্ধবিধ্বস্ত ডাকোটা বিমানগুলো কিনে সেগুলোকে সারিয়ে প্যাসেঞ্জার বসার উপযোগী সিট বসিয়ে আকাশপথে যাত্রীসেবার ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যাপারে সবচেয়ে আগ্রহী ছিলেন মিস্ত্রি নামে বম্বের এক পার্সি তরুণ ব্যবসায়ী। তিনি নিজের নামেই নামকরণ করেন ভারতের সিভিল এভিয়েশনের প্রথম এয়ারলাইন্সের। সেই এয়ারলাইন্সে ক্যাপ্টেন আনোয়ার যোগ দিলেন ফ্লাইং অফিসার হিসেবে ১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ডালমিয়া জৈন এয়ারওয়েজে জুনিয়র ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন, ১৯৫০-এর আগস্ট মাসে সিনিয়র ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রমোশন পান, ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে ডিসি ৪-এর ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন।

৯.
ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সে কাজ করার সময় ক্যাপ্টেন আনোয়ার ভিআইপি পাইলট ছিলেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু যখন প্রথমবার চৌ এন লাইকে ইন্ডিয়াতে আসার নিমন্ত্রণ জানান, তখন ক্যাপ্টেন আনোয়ার তাঁকে কুনমিং থেকে দিল্লিতে এনে আবার ফেরার পথে কুনমিংয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

১০.
ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ারের ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই লেখার অভ্যস ছিল। তিনি ‘Indian Airways’ নামে একটি বই লেখেন। ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এটি প্রকাশিত হয়। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স সম্পর্কে সেটিই ছিল প্রথম বই। এটি একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

১১.
১৯৪৫ সালের ২৪ এপ্রিল যশশ্বী ঐতিহাসিক নিখিল নাথ রায়ের পৌত্রী, কলকাতার খ্যাতমান আইনজীবী, সংস্কৃত সাহিত্যে পণ্ডিত, মধ্যযুগ বিষয়ক গবেষক ত্রিদিবনাথ রায় ও কবি কল্যাণী রায়ের কন্যা সুস্মিতা রায়কে (পরবর্তী সময়ে সুস্মিতা ইসলাম, জন্ম : ১৯২৬) বিবাহ করেন। বনেদি হিন্দু পরিবারের মেয়ে হয়ে একজন মুসলমান ছেলের সাথে বিয়ে হবার কারণে তাঁদেরকে সামাজিক ও পারিবারিক সংকটে পড়তে হয়। পরবর্তী সময়ে সুলেখিকা সুস্মিতা আনোয়ার সামাজিক সংকট সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিকথামূলক ‘ফিরে ফিরে চাই’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন—‘১৯৪৫ সালে যখন ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ারের সঙ্গে আমার বিয়ে হয় তখন আমার বাবা-মা সেই বিয়ে উপলক্ষে আমার পিতৃকুল, মাতৃকুল উভয় কুলের সব আত্মীয়কে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। লেখাই বাহুল্য, তাঁদের একজনও সে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি, নিমন্ত্রণরক্ষা করা তো দূরের কথা বরং তাঁরা যে যতদূর পেরেছিলেন আমার বাবা-মাকে তাদের সেই অসীম দুঃসাহসের জন্য ধিক্কার দিয়েছিলেন এবং আমাকে দিয়েছিলেন অভিশাপ। আমাদের সেই পারিবারিক দুর্দিনে আত্মীয়ের প্রতিনিধি হয়ে একমাত্র রাঙা দাদুই (নীরেন্দ্রনাথ রায়— সাহিত্যিক) সেদিন এসে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের পাশে। শুধু তা-ই নয়, তিনি আমাদের বিয়ের অন্যতম সাক্ষীও ছিলেন। ... ... আমাদের পরিবারের সেই চরম দুর্দিনে তিনিই ছিলেন একমাত্র আত্মীয়, যিনি প্রকৃত বন্ধু হয়ে আমার বাবা-মাকে সাহস সঙ্গ ও উপদেশ দিয়েছিলেন।’ ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ার ও সুস্মিতা আনোয়ারের দুই সন্তান। তাঁর পুত্র প্রদীপ আনোয়ার জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং কন্যা মনীষা আনোয়ার হক বাবলী।

১৩..
১৯৪৭ সালে যখন ভারতবর্ষ দ্বি-খণ্ডিত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তখন তিনি পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে পাকিস্তান চলে আসতে চাননি। তিনি ভারতবর্ষের ভাগাভাগিতে বিশ্বাস করতেন না। কেননা তিনি ছিলেন ‘ন্যাশনালিস্ট মুসলিম’।

১৪.
১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ‘পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স’-এর ভিসকাউন্ট বিমানের চেক পাইলট হিসেবে যোগদান করেন। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের পরের মডেলের ভিসকাউন্ট কিনেছিল বলে সেই নতুন মডেলের প্লেনে প্রশিক্ষণের জন্য পি.আই.এ আনোয়ারকে ১৭ ফেব্রুয়ারি করাচিতে নিয়ে যায়। তাঁকে পরবর্তী সময়ে কনভার্সন কোর্সে শিক্ষা লাভের জন্য ব্রিটেনে পাঠানো হয়।

১৫.
ক্যাপ্টেন বার্নলারের কাজের শেষ দিনে (১৪ আগস্ট ১৯৫৯) তিনি যখন একজন জুনিয়র পাইলটকে ট্রেনিং দিচ্ছিলেন সেসময় তিনি করাচি বিমান বন্দরের ওপরেই ৬টি ল্যান্ডিং ও ৬টি টেকআপ-এর পরীক্ষা নেন। অবজার্ভার হিসেবে আনোয়ার তখন সেই প্লেনে। জুনিয়র পাইলটের ভুলে প্লেনে আগুন ধরে যায় এবং আনোয়ার ও ক্যাপ্টেন বার্নলার উভয়েই প্রাণ হারান। ভিসকাউন্ট বিমানটি দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার পূর্বে ট্রেনিং-এর জন্য প্রায় ৩ ঘণ্টা আকাশে ওড়ে। যে জুনিয়র পাইলটের ভুলে এই দুর্ঘটনা ঘটে, তার নাম এজাজ কোরেশী, তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও জীবনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। জীবনের মতো ফ্লাইং থেকে অবসর নিতে বাধ্য হন।

১৬.
আনোয়ার যখন মারা যান, তখন তাঁর লগ বুক-এ ১৪,৫০০ ঘণ্টা ওড়ার রেকর্ড ছিল। সিভিল ও এয়ার ফোর্স মিলিয়ে সমগ্র পাকিস্তানে তাঁর মতো অভিজ্ঞ অন্য কোনো বৈমানিক ছিলেন না সে-সময়ে। সিভিল ও এয়ার ফোর্স মিলিয়ে সমগ্র পাকিস্তানি পাইলটদের মধ্যে কোনো পাইলটই এত অধিক সময় বিমান চালনা করেননি। তাঁর পরেই যাঁর স্থান ছিল তাঁর নাম আজগার খান। তিনি এয়ার ফোর্স-এর বৈমানিক ছিলেন এবং তখন তাঁর মাত্র ৭,০০০ ঘণ্টা ফ্লাইং আওয়ার্স ছিল। পাকিস্তান টাইমস-এ আনোয়ারের জীবনীসহ এই খবর বের হয়েছিল, তাতে লিখেছিল—‘Mustafa had about 14000 hours flying to his credit. A record which no Pakistani pilot had ever attained.’

১৭.
তাঁর মৃত্যুর খবর শুধু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানেই নয়, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর পর কলকাতার ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ক্যাপ্টেন আনোয়ারের সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ খবর ছাপা হয়েছিল—End of noteworthy aviation career। সেদিন মাত্র ৪২ বছর বয়সে আনোয়ারের এই অপঘাতে মৃত্যু সারা পাকিস্তানে জাতীয় শোকে পরিণত হয়েছিল। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে এই শোকের ছায়া মিলাতে বহুদিন সময় লেগেছিল। ক্যাপ্টেন আনোয়ারের মৃত্যুতে পূর্ব পাকিস্তানের তত্কালীন গভর্নর জাকির হোসেন এবং দৈনিক আজাদ সম্পাদক মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ তাঁর পিতার নিকট পত্রে গভীর শোক প্রকাশ করেন।

১৮.
দুঃসাহসী এক ক্যাপ্টেনের সঙ্গে জীবন জড়িয়ে নিজের জীবন যে কতটা সংগীতময়, বর্ণিল ও অ্যাডভেঞ্চারে রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছিল, তারই দারুণ ছোঁয়া পাই তাঁর স্ত্রী, খ্যাতিমান লেখিকা সুস্মিতা ইসলাম-এর ‘আমার দিনগুলি’ গ্রন্থে। বইয়ের একটি অংশ থেকে পাঠ করলেই সেটি বোঝা যাবে, স্পষ্ট হবে। বাবা তাঁকে লাহোরে নিয়ে গিয়েছেন, আর এটা সেই লাহোরেরই ঘটনা। ক্যাপ্টেন আনোয়ার তাঁকে একটা ট্রেনিং বিমানে চড়ালেন, তারপর পড়ুন, ‘এরপর আনোয়ার যা করল তার জন্য আমার কোনোরকম মানসিক প্রস্ত্ততি ছিল না। আনোয়ার বলল, ‘এইবার আমরা একবার একটা dive করব, তারপরে একটি loop করব।’ ‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তুমি শুধু সিট বেল্টটা খুব শক্ত করে বেঁধে রেখো।’ বলা শেষ না হতেই দেখি চিল যেমন উঁচু আকাশের সীমানা থেকে পথিকের বাজারের থলিতে ছোঁ মারে, ঠিক সে-ভঙ্গিমায় আমাদের প্লেনটি খুব দ্রুতবেগে মাটির প্রায় কাছাকাছি এসেই সুদূর ওপরে উড়ে গেল। তারপর প্লে¬নকে সমান্তরালে ভাসমান করে আনোয়ার জিগ্যেস করল, ‘কী, ভয় পেলে?’ আমি বললাম, ‘না, না।’ আনোয়ার মহাখুশি। ও বলল, ‘এই তো চাই।’ এবার আমরা slow loop করব; সিট বেল্টটা শক্ত করে ধরে রেখো, দেখো খুব মজা হবে।’ আমার কি তখন কোনো পছন্দ ছিল? না। যে-অ্যাডভেঞ্চারের পথে এসেছি তার শেষ পর্যন্ত তো যেতেই হবে। তাই খুব মনের জোর নিয়ে বড় করে একটি গভীর নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই দেখি আমাদের প্লে¬নটি এমনভাবে ঘুরল, যাতে আমাদের দুজনার মাথা মাটির দিকে থাকল। আগেই বলেছি, টাইগার মথে কোনো ছাদ নেই। সুতরাং সেই শূন্যে মাধ্যাকর্ষণের আকর্ষণকে উপেক্ষা করে পুরো বৃত্তাকারে (loop) ঘুরে প্লে¬নটি আবার সোজা হলো। আনোয়ার বলল, ‘খুব মজা, না?’ তখন আর কি পিছিয়ে আসা যায়, যতদূর সম্ভব গলায় উচ্ছলতা নিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, খুব মজা।’ তখন বলল, ‘চলো আরো একবার একটি ‘লুপ’ করে আমরা নিচে নামি’ এবং আবারও একটি ‘লুপ’ করল আনোয়ার। প্রতিবারই মাথা যখন মাটির দিকে যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল বুকের সব যন্ত্রপাতি বোধহয় নিচে নেমে যাচ্ছে। এরই নাম যদি মজা হয়, তাহলে অবশ্যই আমি সেদিন ভীষণ মজা পেয়েছিলাম। অন্তত ভয় পেয়ে যে পিছিয়ে যাইনি সেটাই আমার সবচাইতে বড় প্রাপ্তি হয়েছিল। কারণ আমাকে নিয়ে প্লে¬নের এই কসরত করতে পেরে আনোয়ার অসম্ভব খুশি হয়েছিল। কিন্তু আমাদের জন্য চমক অপেক্ষা করছিল মাটিতে। প্লেন থেকে নামার পর যখন সবাই হাততালি দিচ্ছে এবং অবশ্যই মুভি তোলা হচ্ছে, বাবা সবকিছু উপেক্ষা করে সবার সামনে তার জামাতাকে যে বকুনিটা দিলেন, তাতে আমার আর লজ্জার সীমা-পরিসীমা রইল না। বাবা বলে উঠলেন, ‘তুমি যা খুশি করো, তাই বলে আমার মেয়েটাকে নিয়ে এভাবে অ্যাডভেঞ্চার করা তোমার খুবই অন্যায় হয়েছে।’ আমি লজ্জায় মরমে মরে থাকলেও আনোয়ার কিন্তু একটুও না রেগে উলটো বাবার পিঠে হাত দিয়ে বাবাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। এই হলো আমার বিমান ভ্রমণের প্রথম অভিজ্ঞতা। আনোয়ারের উৎসাহে সেই বছরের পূজাসংখ্যা যুগাস্তরে এই অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে ‘ভারতীয় মহিলার বিমান অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধও লিখেছিলাম।’

১৯.
অনন্যসাধারণ এক মানুষ, যিনি ব্রিটিশ-ভারতের একজন নামকরা পাইলট হিসেবে হয়েছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত, শুধু তাই নয়, গান গেয়েছেন ‘সায়গলের মতো’, দেখতেও ছিলেন ‘সুপুরুষ’ সেই অনালোচিত আলোকিত মানুষ ক্যাপ্টেন মুস্তাফা আনোয়ারের জন্মদিনের আবারো তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(অকৃপণ ঋণ/তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সমকাল, দৈনিক প্রথম আলো, কালি ও কলম, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত