জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

তাজউদ্দীন আহমদ

প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০১৮, ১২:১৪

১.
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনকারী সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের জন্মবার্ষিকী আজ। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সুযোগ্য পরিচালক তাজউদ্দীন আহমদ কেবল একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন পরিণত সমাজভাবনা ও রাষ্ট্রচিন্তার অধিকারী। আপামর জনসাধারণের একান্ত প্রিয় এই নেতা ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। ‘বঙ্গতাজ’তাজউদ্দীন আহমদের জন্মদিনে জানাই তাঁর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
 
২.
আমরা জানি, ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধ খুবই প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালে ৪৬ বছর বয়সে তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর অনন্য সাধারণ নেতৃত্বে ৯ মাসের যুদ্ধে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি বিজয় অর্জন করে। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ছিলেন মনে প্রাণে দেশপ্রেমিক এবং সম্পূর্ণ নির্লোভ এক চরিত্রের মানুষ। মানুষের জন্য একেবারেই নিঃস্বার্থ সেবা ও কল্যাণ ছিল তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য। মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানকারী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও স্বদেশপ্রেম বাঙালি জাতির ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে থাকবে। রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সংগঠক, প্রশাসক, সর্বোপরি রাষ্ট্রনায়ক - সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছিলেন মানুষ তাজউদ্দীন আহমেদ। বড় বেদনার সাথে খেয়াল করছি বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার প্রাণপুরুষদের একজন হলেও ক্ষমতার রাজনীতিতে বর্তমান আনুগত্যমুখী মেধাহীন ধারায় তাঁর নাম এখন বিস্মৃতপ্রায়।
 
৩.
পৃথিবীতে এমন কিছু আলোকিত মানুষের জন্ম হয় যাদের জ্ঞান, মেধা, মনন, আদর্শ দেশ ও জাতির সেবায় সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকে। এমনই আলোকিত মানুষ ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। মনে প্রাণে দেশপ্রেমিক এবং সম্পূর্ণ নির্লোভ এক চরিত্রের মানুষ ছিলেন তিনি। মানুষের জন্য একেবারেই নিঃস্বার্থ সেবা ও কল্যাণ ছিল তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য। দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা যেন তাঁর প্রাণশক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের উপর। একাত্তরে এক চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সফল ভূমিকা পালন করেন তিনি। মাত্র নয় মাসে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
 
৪.
আমরা জানি, কোন জাতির ক্রান্তিলগ্নে সেই জাতিকে রক্ষা করতে যে মহৎ প্রাণ আবির্ভূত হয় সকল মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে তিনিই জাতির প্রকৃত কাণ্ডারী, আদর্শবান দেশপ্রেমিক মহান নেতা। এমন ভূমিকায় জাতির ত্রাতা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসে জ্বলে উঠে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। বিশ্ব জনপ্রতিনিধির সমর্থন পেতে যিনি ছুটেছিলেন একজন থেকে আরেকজন গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তির কাছে বৈঠকের পর বৈঠকে অংশ নিতে। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের সময় নিজেসহ সবাইকে অঙ্গীকার করিয়েছিলেন যে, ‘স্বাধীন না হওয়া পর্জন্ত কেউ সংসার ধর্ম পালন করবেন না’, যা তিনি অক্ষরে অক্ষরে সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেছিলেন। দেশপ্রেমের নিঃসঙ্গ জ্বলন্ত অগ্নিসারথী তাজউদ্দীন আহমদ মহাকালের অনুসন্ধান করে বের করা এমন এক শ্রেষ্ঠ মহৎ আদর্শবান ব্যক্তিত্ব; যার জন্ম বাংলা মায়ের গর্ভে না হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় সময়ের ইতিহাস অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো! দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের প্রাণশক্তি ছিল। তাঁর অদম্য সাহস, আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক দক্ষতা, নেতৃত্বদানের কলা কৌশল, মানুষের আপনজন হওয়ার ও তাদের প্রতি বিশ্বাস অর্জনের মতো গুণাবলী তাজউদ্দীন আহমদকে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত করেছিল রাজনৈতিক কর্মী থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নায়কে।আওয়ামী লীগে, শুধু আওয়ামী লীগেই নয়, বাঙালী জাতির মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতৃত্বে এখানেই ছিল তাজউদ্দীন আহমেদের ব্যতিক্রম। সে কারনেই তিনি দেশ-কালকে ছাপিয়ে তাঁর সময়কে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। সে সময়ের প্রধান নেতৃত্ব এটিকে মেনে নেওয়ার জন্য কখনই প্রস্তুত ছিল বলে মনে হয়নি। সে কারনেই তাজউদ্দীন হয়ে পড়েছিলেন একা, নি:সঙ্গ এবং ঝঞ্জাবিক্ষুদ্ধ সময়ের মাল্লা, বলা যায় - a man who came before his time, সেজন্য তিনি চলেও গেছেন তাঁর সময়ের আগেই। নিশ্চয়ই, তিনি ফিরে আসবেন ইতিহাসের হাত ধরে বারবার, পুনর্বার- তার কাছে যে গোটা বাঙালি জাতি রক্তঋণে আবদ্ধ।

৫.
বিগত ৩ জুলাই ২০১২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ‘তাজউদ্দীন আহমদ স্মারক বক্তৃতা’য় ‘তাজউদ্দীন আহমদের স্বদেশভাবনা’য় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলছেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-৭৫) যে দেশের মানুষের কাছ থেকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি, এ-দুর্ভাগ্য যতটা তাঁর, তার চেয়ে বেশি আমাদের সকলের। তিনি কেবল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিচালক। তিনি কেবল একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন পরিণত সমাজভাবনা ও রাষ্ট্রচিন্তার অধিকারী। এই দুইয়ের যোগফল সব দেশেই কম দেখা যায়। পড়াশোনায় তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল—এ-বিদ্যানুরাগ কেবল ভালো ছাত্র হওয়ার জন্যে ছিল না, ছিল মানুষ ও পৃথিবীকে জানার ও বোঝার জন্যে। আবাল্য দেশের মানুষের প্রতি তাঁর দরদ ছিল—তাঁর চরিত্রে যা অঙ্কুরিত হয়েছিল এলাকাবাসীর প্রতি গভীর ভালোবাসারূপে, উত্তরকালে তা-ই পল্লবিত হয়েছিল দেশবাসীর প্রতি অনুরাগ ও কর্তব্যবোধে। তিনি জনপ্রিয় নেতা ছিলেন না, তেমনটি হওয়ার কোনো চেষ্টাই তাঁর মধ্যে দেখা যায়নি; কিন্তু আপামর জনসাধারণ তাঁর একান্ত প্রিয় ছিল।’ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের ভাষায়, ‘তাজউদ্দীন আহমদের রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে এর আগেও আমি একবার কথা বলেছি। সুতরাং তাঁর স্বদেশভাবনার কথা বলতে গিয়ে আমার আগে-বলা কথার কিছু পুনরাবৃত্তি হবে। মুসলিম লীগে তাজউদ্দীন ছিলেন এর অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশ সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের উপদলের অন্তর্ভুক্ত। ঢাকায় তাঁর গুরু ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ ও শামসুল হক। তাঁরা একটি শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৬৯-৭০ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকরূপে তাজউদ্দীনের বক্তৃতা থেকেও স্পষ্টভাবে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা-প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ধ্বনিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন—এবং মন্ত্রিসভার অন্যেরাও সেটা মেনে নেন—যে, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সমাজতন্ত্র-প্রতিষ্ঠায় তিনি এতই আবেগাপ্লুত ছিলেন যে, ১৯৭২ সালের ৮ জুনে প্রদত্ত এক ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন, বাংলাদেশে ধনতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়েছে। কিন্তু পরে আরেকটি বক্তৃতায় তিনি বলেন: আমরা সামন্তবাদী অবস্থা ও পরিবেশ থেকে এখনও পূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থায় পৌঁছাতে পারিনি। সামন্ত প্রভু আজ নেই সত্য—কিন্তু সামন্ত মনোবৃত্তি এখনও রয়েছে। আগে এই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।’

৬.
আইনজীবী, রাজনীতিক এবং বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ( জন্ম : ২৩ জুলাই, ১৯২৫ – শহীদ : ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫) গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৌলবী মুহাম্মদ ইয়াসিন খান এবং মাতা মেহেরুন্নেসা খানম। তাঁরা ছিলেন চার ভাই ও ছয় বোন। তাজউদ্দীন আহমদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে, এরপর বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরবর্তী ভুলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠে তিনি ভর্তি হন দরদরিয়া থেকে আট কিলোমিটার দূরের কাপাসিয়া মাইনর ইংরেজি স্কুলে। তারপর তিনি গাজীপুরের কালিগঞ্জের সেন্ নিকোলাস ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। সর্বশেষ স্কুল জীবন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরীজ হাইস্কুলে শেষ হয়। তবে এর পূর্বে ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাইস্কুলে অধ্যয়ন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি পড়াশুনায় যত্নবান ছিলেন। মেধাবীর কারণে গুণী শিক্ষকদের দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হন তিনি। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৪ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরীজ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৪৮ সালে আই.এ এবং ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন এবং ঢাকায় আইনব্যবসা শুরু করেন। তিনি পবিত্র কোরআন-এ হাফেজ ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ শৈশব থেকে প্রতিবাদী ও বিপ্লবী মনোভাব পোষণ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ওই সময়ে বন্ধুদের নিয়ে পোশাক পরে সারা রাত ডিউটি করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ১৯৪২ সাল থেকে আজীবন বয়স্কাউট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত ছিলেন। 

৭.
ছাত্রজীবন থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত হন। ১৯৪৩ সাল থেকে তিনি মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলা ভাষার অধিকার, বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সকল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মুসলিম লীগ সরকারের গণবিচ্ছিন্ন রাজনীতির প্রতিবাদে তিনি এ দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের (১৯৪৯) অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ববাংলা ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে তিনি ভাষা আন্দোলনকালে গ্রেপ্তার হন এবং কারা নির্যাতন ভোগ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য এবং ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন এবং পরে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
 
৮.
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে কাপাসিয়া থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছরই তিনি ৯২-ক ধারায় গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারির পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে তাজউদ্দীন আহমদ গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৫৯ সালে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি কারাবরণ করেন। 

৯.
১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই বছর এপ্রিল মাসে তিনি গ্রেপ্তার হন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (১৯৬৫) সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই বৎসরের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে যে সর্বদলীয় নেতৃসম্মেলনে শেখমুজিবর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন, সেই সম্মেলনে শেখ মুজিবর রহমান-এর সাথে তিনিও যোগদান করেন। সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে তাজউদ্দীন ছিলেন অন্যতম সদস্য। ছয়দফা আন্দোলনের সময় এই বছরের ৮ মে তিনি দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে জেলে থাকা অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুনরায় নির্বাচিত হন। ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তিনি দলের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন। রাজনৈতিক বিরোধ নিরসনের লক্ষ্যে বিরোধী দল ও সরকারের মধ্যে আলোচনার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক আহূত গোলটেবিল বৈঠকে (১৯৬৯) তিনি আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এই বছরের সাধারণ নির্বাচনের জন্য গঠিত আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভের পরও ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় শেখ মুজিবর রহমান-এর ডাকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।
 
১০.
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট-এর মাধ্যমে গণহত্যা শুরু করে। এই সময় শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সূত্রে শুরু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। আত্মরক্ষার জন্য ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি ফরিদপুর কুষ্টিয়া পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান। ৩১ মার্চ তিনি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সাথে নিয়ে মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পদার্পণ করেন। এই সময় মেহেরপুরের মহকুমা শাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী তাঁকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করেন। এই সময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। সীমান্তের ওপারে তখন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য, বাঙালি পুলিশ, আনসারের সদস্যরা জড় হয়েছিল। এঁদের নিয়ে তিনি মুক্তিফৌজ গঠনের উদ্যোগ নেন। এক্ষেত্রে তিনি বিএসএফ এর সাহায্য চাইলে, তৎকালীন বিএসএফ প্রধান তাকে বলেন যে, মুক্তি সেনা প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রপ্রদানের জন্য ভারত সরকারের কোন নির্দেশ নেই। এরপর তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী'র সাথে দেখা করার জন্য দিল্লী যান। দিল্লীতে তাঁর সাথে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়। এসময় তিনি উপলব্ধি করেন যে, ভারত সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পেতে হলে একটি সরকারী বৈধতা বা স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন। তখনই তিনি প্রবাসী সরকার গঠনের চিন্তা করেন। এরপর ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে জানান যে, পাকিস্তানী আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ২৫/২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে। 

শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রীসভার সদস্য। মুজিবের গ্রেপ্তার ছাড়া তখন পর্যন্ত দলের অন্যান্য প্রবীণ নেতা-কর্মীর খবর অজানা থাকায় সমাবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শক্রমে দিল্লির উক্ত সভায় তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রীরূপে তুলে ধরেন। ঐ বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। এভাবেই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ধারণার সূচনা। ৪ঠা এপ্রিল দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। ১০ই এপ্রিল নির্বাচিত সাংসদগণ আগরতলায় একত্রিত হয়ে এক সর্বসস্মত সিদ্ধান্তে সরকার গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই সরকার স্বাধীন সার্বভৌম "গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার"। স্বাধীনতার সনদ (Charter of Independence) বলে এই সরকারের কার্যকারিতা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হয়। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন বেতারে ভাষণ দেন। ১৭ এপ্রিল নবগঠিত মন্ত্রীসভার প্রকাশ্য শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদনাথতলায়, যার নতুন নামকরণ হয় মুজিবনগর । রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির এই সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের শপথ পাঠ করান জাতীয় সংসদের স্পীকার অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মন্ত্রী পরিষদে প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দিন আহমেদ (প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত)। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগর নামকরণ তাজউদ্দীন আহমদেরই করা। 

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ দ্বার্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, “পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে । স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য । সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন । দুনিয়ার কোনো জাতি এই নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এই নতুন জাতিকে । স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে”। প্রকৃতপক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠনের মাধ্যমেই সুশৃঙ্খলভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে । ফলে আমরা অর্জন করতে পেরেছি প্রিয় স্বাধীনতা। উল্লেখ্য যে, ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর তাজউদ্দিন আহমেদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু ভারতের সীমান্তে পৌঁছে বলেন, একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্য দেশে তিনি কোন প্রটোকল ও আমন্ত্রণ ছাড়া প্রবেশ করতে পারেন না। এটা করলেও তার দেশের জন্য অসম্মানজনক। এরপর ভারতীয় বাহিনী তাকে গার্ড অফ অর্নার দিয়ে ভারতে নিয়ে যায়।

১১.
মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলে (১৯৭২) তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে অর্থ এবং পরে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি সংবিধান প্রণয়নে বিশিষ্ট ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা-২২ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটে মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। তবে ১৯৭৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের নির্দেশে তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে পরদিন তাজউদ্দীন আহমদ গৃহবন্দী হন। ২২ আগস্ট তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। কারাগারে বন্দি অবস্থায় ৩ নভেম্বর অপর তিন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং মোহাম্মদ মনসুর আলীর সঙ্গে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রনায়কোচিত আসামান্য দুরদর্শিতায় নিজের এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যত যেন দিব্যচোখে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যেন তিনি। তাজউদ্দীনের নিজের ভাষায়, ‘নেতা যখন অসৎ, অযোগ্য, দুর্নীতিপরায়ন ও সুবিধাবাদীদের কাছে টেনে নেন এবং তাদের প্রশয় দেন তখন তার ভয়াবহ পরিনাম শুধু তার ভাগ্যেই ঘটে না, পুরো জাতিকেই তার মাশুল দিতে হয়। জাতি পিছিয়ে যায় শতবছর’। ৭৪ সাল থেকে তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করেছিলেন, লিলি তুমি বিধবা হতে চলেছো। মুজিব ভাই বাঁচবে না। আমরা কেউই বাঁচবো না। দেশ চলে যাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে (সূত্র: তাজউদ্দীন আহমেদ, নেতা ও পিতা, পৃ: ১৭৫”। 

১২.
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পূর্ব থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ অবসর জীবন-যাপন করছিলেন। তবুও শত্রুরা ঠিকই বুঝলো, মুজিব না থাকলেও তাজউদ্দীন রয়েছেন। তাজউদ্দীনকে শেষ না করা পর্যন্ত তাদের মিশন সফল হবে না। একাত্তরে মুজিব ছিলেন না। মুজিবের অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠিকই অর্জিত হয়। ১৫ আগস্ট সকালে অন্য জাতীয় নেতাদের সঙ্গে তাজুদ্দিন আহমদকে গৃহবন্দি করা হয়। কয়েকদিন পর নেয়া হয় জেলে। '৭৫-এর ৩ নভেম্বর ভোররাতে ঠাণ্ডা মাথায় সুপরিকল্পিতভাবে ক্ষমতা দখলকারী ঘাতক খোন্দকার মোশতাকের নির্দেশে তাজউদ্দীনসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। এ কথা এখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার অংশ হিসেবেই বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও সুযোগ্য সহকর্মী তাজউদ্দীনকে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করার পরেও তাজউদ্দীন জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন_ বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আনুগত্যে কোনো খাদ ছিল না। কলামিস্ট স্বদেশ রায় দৈনিক জনকণ্ঠে (২৩.৭.২০০৪) লিখেছেন : 'সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে যত গবেষণাই হোক না কেন, বারবার দেখা যাবে মুজিব-তাজউদ্দীন এ জুটি যেন হয়েছিল একটি নির্যাতিত জাতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনে। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বিশাল নেতার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের মতো প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব ছিল প্রকৃতির অমোঘ আশীর্বাদ।' আসলে বঙ্গবন্ধু মুজিব এবং তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। চীনের মাও-চৌ এবং ভারতের গান্ধী-নেহরু জুটির মতো বাংলাদেশে মুজিব-তাজউদ্দীন জুটি অটুট থাকলে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হয়তো এভাবে সপরিবারে জীবন দিতে হতো না। 

১৩.
তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। বিগত ৩ জুলাই ২০১২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ‘তাজউদ্দীন আহমদ স্মারক বক্তৃতা’য় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যারের মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য, ‘ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী তাজউদ্দীন ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন: ধর্মের ওপর ভিত্তি করে দেশে কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না। অর্থনৈতিক ও গঠনমূলক কর্মসূচির উপর ভিত্তিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকেই শুধু এখানে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে। বাংলাদেশ হবে একটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বাংলাদেশে প্রতিটি ধর্মের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। রাষ্ট্র কোনো ধর্মের ব্যাপারে হস্তপেক্ষ করবে না। ধর্মের নামে কাউকে শোষণ করতে দেওয়া হবে না। ধর্মীয় ভিত্তিতে কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থাকবে না। দেশের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত দলই শুধু সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হবে।’

১৪.
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা, লেখক ও গবেষক, শারমিন আহমদ ‘তাজউদ্দীন আহমদ : জন্মদিনের অভিবাদন’ স্মৃতিচারণে সাবলীল ভাষায় লিখছেন, ‘শীতলক্ষ্যার কূল ঘেঁষা, শাল গজারীর বনে ঘেরা, লাল মাটিতে পথ আঁকা, নিটোল সবুজ গ্রাম দরদরিয়ায়, ভরা শ্রাবণের এক দিবাগত রাতে, ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই, বৃহস্পতিবার, তাজউদ্দীন আহমদ জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি বেঁচে থাকলে আজ নব্বই বছরে পদার্পণ করতেন। কিন্তু মাত্র অর্ধশত বছরের জীবনেই তিনি সম্পন্ন করেছেন শত বছরের যুগান্তকারী কর্ম। বাংলাদেশ নামের এক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে ও নবজাত রাষ্ট্র গঠনে তিনি যে অনন্য ও অসাধারণ অবদান রেখেছেন তা যুগ যুগ ধরেই বিশ্বের স্বাধীনতাকামী জাতির জন্যে হতে পারে দিক দর্শন ও অপার সম্ভাবনার বাতিঘর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেরণা ও প্রতীক। পাকিস্তান কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে, তাজউদ্দীন আহমদ, এক নির্মোহ সাধকের অধ্যবসায় নিয়ে সেই প্রেরণাকে এক সাফল্যমণ্ডিত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মধ্যে দিয়ে বাস্তবায়িত করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে যদি একবাক্যে সংজ্ঞায়িত করতে হয় তাহলে বলা যায় তিনি ছিলেন এক দুর্দান্ত প্রকৃতির ন্যায়নিষ্ঠ, নির্ভীক, দূরদর্শী ও স্বাধীনচেতা মানুষ। নিজেকে আড়ালে রেখে ও কোন কৃতিত্ব দাবী না করে বিশাল মাপের কাজগুলি অসাধারণ দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও আন্তরিকতার সাথে যেমন করে সম্পন্ন করতেন তার জুড়ি মেলা ভার। তার চরিত্রর ঐ বিরল গুনাবলীরই সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের চরম প্রতিকূল সময়ের আবর্তে- মুক্তিযুদ্ধের যজ্ঞ পীঠে। তাজউদ্দীন আহমদকে না জানলে তাই বাংলাদেশের জন্ম কথা- মুক্তিযুদ্ধর ইতিহাস জানাও হবে অসম্পূর্ণ। … আমার সুগভীর বিশ্বাসের কথাটি আবারও উল্লেখ করি। বাংলাদেশ একদিন তার নিজস্ব প্রয়োজনেই খুঁজে নেবে তাজউদ্দীনকে। তাঁর জ্যোতির্ময় জীবন ধারার অনির্বাণ আলোয় শিশুরা খুজে পাবে মুক্তির পথ। তাজউদ্দীন আহমদের নব্বইতম জন্মদিনে ছড়িয়ে দিলাম অজস্র শুভেচ্ছা। লক্ষ তারার দীপ্তিময় অভিবাদন।’

১৫.
‘তাজউদ্দীন আহমদের স্বদেশভাবনা’ স্মারক বক্তৃতায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীনের নীতিগত বিষয়ে কিছু কিছু মতান্তর দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা এই সুযোগে তাঁদের দুজনের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। তাজউদ্দীন পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু তাঁর এই ইচ্ছা গোপন থাকেনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন এবং সেই সঙ্গে পদত্যাগপত্রের খসড়াও পাঠিয়ে দেন। তাজউদ্দীন সেই খসড়া-অনুযায়ীই পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তাতে তাঁদের দুজনেরই ক্ষতি হয়, সর্বোপরি ক্ষতি হয় বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পরে খুনিরা তাজউদ্দীনকে গ্রেপ্তার করে। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার একজন বাদে আর সকল সদস্য কারাগারের অভ্যন্তরে নিহত হন। আমি বলেছি, তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর প্রাপ্য পাননি। বিষয়টি আরেক দিক দিয়ে ভাবা যেতে পারে। তিনি যা পেয়েছিলেন, তা কি তাঁর প্রাপ্য ছিল—বিশেষ করে তেসরা নভেম্বরের কালরাতে?’

১৬.
শারমিন আহমদ ‘তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রথম বাংলাদেশ সরকার’ শীর্ষক আরেকটি লেখায় বলছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে তাজউদ্দীন আহমদের বড় চারটি অর্জন হলো: ১. স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিজয়ে যুগান্তকারী সফল নেতৃত্ব প্রদান। ২. নবজাত বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের স্বীকৃতি আদায় এবং স্বীকৃতি প্রদানের পরেই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এই শর্তের উল্লেখ ও বাস্তবায়ন। ৩. ভারতের সঙ্গে চুক্তি যে বাংলাদেশ সরকার যত দিন চাইবে, ভারতীয় সেনাবাহিনী তত দিন পর্যন্তই বাংলাদেশে থাকবে। তারপর তাদের ফিরে যেতে হবে। বিশ্ব ইতিহাসের ওই বিরল চুক্তিটি প্রমাণ করে যে ভিন্ন দেশের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে, তাদের সাহায্য, সমর্থন লাভ করার পরেও নিজ রাষ্ট্রের মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রশ্নে কতখানি আপসহীন ছিলেন এই সুউচ্চ চিন্তাশক্তির বিরল রাষ্ট্রনায়ক। ৪. আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি নিশ্চিতকরণ। স্বাধীন বাংলাদেশে পবিত্র ধর্মের নাম অপব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদ, রাজতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট তথাকথিত ধর্মবাদী দলগুলো যাতে মাথাচাড়া না দিতে পারে, সে জন্যে বিজয়ের আগেই, ১৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভায় সম্মিলিতভাবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তিনি বলতেন, ‘আমরা এমন কাজ যেন না করি, যাতে করে রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র একদিন ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ স্বাধীন করার “অপরাধে” আমাদেরই উৎখাত করতে সচেষ্ট হয়।’ 

প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের সঙ্গে নিহত এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সৎ, নির্লোভ, স্বাধীনচেতা ও স্পষ্টবাদী এই রাজনীতিবিদের বহু কথাই আজ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তিনি নিজেকে আড়াল করে, কোনো কৃতিত্ব দাবি না করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন, তার সঠিক মূল্যায়ন রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আজও হয়নি। ইতিহাস প্রমাণ, মানুষটি আজ পরিণত হয়েছেন ইতিহাসের ফুটনোটে। এই দুর্ভাগ্য তাঁর নয়, দুর্ভাগ্য এ জাতির। তার পরও আশা থাকবে যে তরুণ প্রজন্ম যেভাবে ইতিহাসের কলঙ্ক মুছতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসির দাবিতে গণ-আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়েছে, তারা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে শিকড় গাড়া সকল প্রকার কলুষতা, অসত্য, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে চেতনার নবজাগরণ ঘটাতে; চেতনার রূপান্তরিত নিষ্কলুষ বিকাশে জন্ম নেবে তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর মতো সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের প্রতীক নতুন শিশু। তারা বাংলাদেশকে পথনির্দেশ করবে আলোর পথে।’

১৭.
নিঃসঙ্গ সারথী তাজউদ্দীন আহমদ কর্মময় জীবনে কোনো কাজেই দাবি করেননি নিজ কৃতিত্বের। কর্তব্য বিবেচনা করে নিঃস্বার্থভাবে, একাগ্রচিত্তে কাজ করে গেছেন। বলেছেন- 'মুছে যাক আমার নাম কিন্তু বেঁচে থাক বাংলাদেশ।' বাঙালি জাতির দুর্দিনে সফল নেতৃত্বদানকারী মহান নেতা তাজউদ্দীন আহমদকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, সাপ্তাহিক, দৈনিক কালের কন্ঠ, দৈনিক প্রথম আলো, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত