প্রয়াণ দিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

মহাকবি কায়কোবাদ

প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০১৮, ১২:৫৮

১.
কায়কোবাদ, মহাকবি কায়কোবাদ বা মুন্সী কায়কোবাদ (জন্ম : ১৮৫৭- মৃত্যু : ২১ জুলাই, ১৯৫১) আধুনিক বাংলা মহাকাব্য ধারার শেষ কবি হিসেবে বহুল আলোচিত। তাঁর প্রকৃত নাম মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী, ‘কায়কোবাদ’ তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম। কবি কায়কোবাদ ১৯০৪ সালে তাঁর অমর কাব্যগ্রন্থ ‘মহাশ্মশান’ লিখে মহাকবি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। কবি কায়কোবাদ ১৯৫১ সালের ২১ জুলাই ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। মহাকবি কায়কোবাদের প্রয়াণ দিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, তিনি ১৮৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মতান্তরে ২৫ মার্চ, ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা পূর্বপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সঠিক জন্ম তারিখ খুঁজে পাই নি।

২.
ছেলেবেলায় স্কুলের শিক্ষকের কণ্ঠে সুরে সুরে শোনানো যে কবিতাটি আজো মনে গেঁথে আছে, প্রতিদিন পাঁচবার না হলেও চারবার স্মরণে আসে, সেই কবিতাটিরই ক’টি পংক্তি হলো- ‘কে ঐ শোনালো মোরে আজানের ধ্বনি, মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিলো কি সুমধুর, আকুল হইলো প্রাণ, নাচিলো ধমনি। কি-মধুর আযানের ধ্বনি’।- মহাকবি কায়কোবাদ এরূপ অসংখ্য কবিতাসহ অসাম্প্রদায়িক আধুনিক শুদ্ধ বাংলায় গীতিকাব্য ও কাহিনীকাব্য রচনা করে গেছেন। তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি এবং মুসলমান। বাংলা মহাকাব্যের অস্তোন্মুখ এবং গীতিকবিতার স্বর্ণযুগে মহাকবি কায়কোবাদ মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস থেকে কাহিনী নিয়ে ‘মহাশ্মশান’ মহাকাব্য রচনা করে যে দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছেন তা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় আসনে স্থান করে দিয়েছে । সেই গৌরবের প্রকাশে ১৯৩২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মূল অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কবি কায়কোবাদ। তিনি বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রথম সনেট রচয়িতা। তিনি আধুনিক বাংলাসাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি। মুহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী ওরফে কায়কোবাদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলমান সাহিত্যধারার সূচনা পাঠের শ্রেষ্ঠ কবি। রবীন্দ্রনাথেরও বয়োজ্যেষ্ঠ কবি কায়কোবাদ গীতি কবি হিসাবেই সাহিত্য ক্ষেত্রে আবির্ভূত হন এবং রবীন্দ্রযুগেই মহাকাব্য রচয়িতা রূপে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। মূলত গীতিকবি হলেও মহাকাব্য রচনায় তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্যই তিনি সকলের সপ্রশংস ও বিস্মিত দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কায়কোবাদ ছিলেন মূলত একজন প্রেমিক কবি, বেদনার কবি, একজন আধ্যাত্মিক সাধক কবি। স্বদেশ প্রেম, সত্যনিষ্ঠা আর ইতিহাস ঐতিহ্য প্রীতি ছিল তার কবি প্রতিভার মৌল বৈশিষ্ট্য। তিনি ছিলেন সৌন্দর্যের একজন মস্তবড় উপাসক। স্বভাব কবির ন্যায় তিনি তাঁর কাব্যে অপূর্ব শিল্পচাতুর্যে প্রকৃতি ও নারীর স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে তুলে ধরেছেন। সঙ্গীত রচনায়ও তার হাত ছিল দক্ষ। তাঁকে যেমন আমরা দেখি একজন মুসলিম দরদী জাতীয় কবিরূপে, সেইরূপ তাকে দেখি ধর্ম, বর্ণ নিরপেক্ষ বাংলাদেশের একজন সাম্যবাদী অসাম্প্রদায়িক জাতীয় কবিরূপে।

৩.
তিনি ১৮৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মতান্তরে মার্চ, ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা পূর্বপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম শাহমত উল্লাহ আল কোরেশী ওরফে এমদাদ আলী এবং মায়ের নাম জোমরাত উন্নেসা ওরফে জরিফুন্নেসা খাতুন। কবির পিতৃপুরুষগণ বাদশাহ শাহজাহানের রাজত্বকালে বাগদাদের কোন এক অঞ্চল থেকে ভারতে আসেন। তাদের মধ্যে মাহবুব উল্লাহ আল কোরেশী ফরিদপুর জেলার গোড়াইলে বসবাস শুরু করেন। কায়কোবাদ মাহবুব উল্লাহ আল কোরশীর প্রপৌত্র। কবির পিতামহের নাম নেয়ামত উল্লাহ আল কোরেশী। কবির বাবা ঢাকায় ওকালতি করতেন। কবির বয়স যখন এগারো তখন তার মা এবং বারো বছর বয়সে বাবা মারা যান। কবি পড়াশোনায় তেমন একটা এগোতে পারেননি। তিনি ঢাকা পগোজ স্কুলে ও আলিয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করেন এবং এন্ট্রাস পরীক্ষার পূর্বেই তার পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটে। তাঁর পিতা শাহামতউল্লাহ আল কোরেশী ছিলেন ঢাকার জেলা-জজ আদালতের উকিল। কায়কোবাদ ঢাকার পোগোজ স্কুল এবং সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ঢাকা মাদ্রাসায় এন্ট্রান্স পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন, কিন্তু পরীক্ষার আগেই পোস্ট-মাস্টারের চাকরি নিয়ে তিনি স্বগ্রাম আগলায় চলে যান। সমগ্র চাকরি জীবনে তিনি এ পদেই বহাল ছিলেন এবং এখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেন।

৪.
অতি অল্পবয়স থেকে কায়কোবাদের সাহিত্য-প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। কায়কোবাদের কবি জীবন শুরু সেই বাল্যকালে মাদরাসার ছাত্রাবস্থায়। মাত্র বারো বছর বয়সে ১৮৭০ সালে তার প্রথম কবিতার বই ‘বিরহ বিলাপ' রচনা করেন। পনের বছর বয়সে ১৮৭৩ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর দ্বিতীয় কাব্য ‘কুসুম কানন'। কবি জীবনের প্রথম পর্যায়ের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কাব্য ‘অশ্রুমালা' প্রকাশিত হয় ১৮৯৪ সালে। এরপর তিনি মহাকাব্য রচনায় মনোনিবেশ করেন এবং ১৯০৪ সালে তার বিপুল আয়তনের মহাকাব্য ‘মহাশ্মশান' প্রকাশিত হয়। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত কায়কোবাদ কাব্যটির নানা আকৃতি ও প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধন করেন। ‘মহাশ্মশান' এর পরে তিনি রচনা করেন ‘শিব মন্দির' (১৯২১), ‘অমিয় ধারা' (১৯২৩), ‘মহরম শরীফ' (১৯৩৩) এবং ‘শ্মশান-ভস্ম' (১৯৩৮) কাব্য। ‘মহররম শরীফ' কবির মহাকাব্যোচিত বিপুল আয়তনের একটি কাহিনী কাব্য। কবির মৃত্যুর বহুদিন পরে প্রেমের ফুল (১৯৭০), প্রেমের বাণী (১৯৭০), প্রেম-পারিজাত (১৯৭০), মন্দাকিনী-ধারা (১৯৭১) ও গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ (১৯৭৯) প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি বাংলা একাডেমী কায়কোবাদ রচনাবলী (৪ খন্ড, ১৯৯৪-৯৭) প্রকাশ করেছে। 

৫.
কায়কোবাদের কাব্যচর্চাকে মোটামুটি ছটি ভাগে ভাগ করা যায়- গীতিকাব্য বা খন্ডকাব্য ও মহাকাব্য বা কাহিনী কাব্য। তবে মহাকাব্য বা কাহিনী কাব্য অপেক্ষা গীতি কবিতা বা খন্ড কবিতা রচনাতেই তিনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত ও অধিকতর সিদ্ধহস্ত। তার শ্রেষ্ঠ গীতিকাব্য ‘অশ্রুমালা'ই তার বড় প্রমাণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও কায়কোবাদের যাবতীয় খ্যাতি এবং পাঠক সমাজের যত সব বিমুগ্ধ বিস্ময় তা তার ‘মহাশ্মশান' কাব্যকে ঘিরে। কাব্যটিকে তিনি মহাকাব্য বলে দাবি করেছেন। কিন্তু বাস্তব কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কবির দাবি অনুযায়ী কাব্যটি যথার্থ মহাকাব্য না হলেও নানা বৈশিষ্ট্যের কারণে কায়কোবাদের এই মহাকাব্যিক প্রয়াসকে কোন অবস্থাতেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। সে সময়কার প্রেক্ষাপটে এরূপ উদার মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, সত্যনিষ্ঠ এবং বিশাল আয়তনের কাব্য প্রয়াস সত্যি আমাদেরকে যুগপৎ ও মুগ্ধ করে।

৬.
কায়কোবাদ বাংলার অপর দুই মহাকবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনের ধারায় মহাকাব্য রচনা করেন। তবে নবীনচন্দ্রই ছিলেন তাঁর প্রধান আদর্শ। কায়কোবাদের মহাশ্মশান তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ অবলম্বনে রচিত। এ কাব্যে জয়-পরাজয় অপেক্ষা ধ্বংসের ভয়াবহতা প্রকট হওয়ায় এর নাম হয়েছে ‘মহাশ্মশান’। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা এবং এর দ্বারাই তিনি মহাকবিরূপে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর গীতিকবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ ও আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ পেয়েছে। 

৭.
ঊনিশ শতকের যুগস্রষ্টা বিপ্লবী কবি মাইকেল মধুসূধন দত্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম মহাকাব্য রচয়িতা। পরবর্তীকালে তার ধারা অনুসরণ করে যারা মহাকাব্য রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কায়কোবাদ ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী অসাধারণ মহাকাব্য রচয়িতা। বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি হিংসা, বিদ্বেষ ও সংকীর্ণতার যে পরিপ্রেক্ষিত পেয়েছিলেন, তাকে তিনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মহাশ্মশান সম্প্রীতির এক নবপ্রেক্ষিত নির্মাণের প্রয়াসী হয়েছিলেন। যেখানে রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, নবীণ চন্দ্র সেন প্রমুখ মহাকাব্য রচয়িতা তাদের কাব্য নির্মাণের প্রয়োজনে মুসলমানদের পাপচারী ও দুর্বৃত্ত বলে চিহ্নিত করেছেন এবং যেখানে কাব্য সৃষ্টির ভাবাদর্শে হিন্দুত্বের পুনর্জাগরণই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেখানে কায়কোবাদ একটি অতুলনীয় সাম্যবাদের আনন্দ লোক নির্মাণ করেছিলেন। যেখানে হিন্দু মুসলমান একই দেশবাসী এবং একই প্রকৃতির মানবীয় গুণাগুণে বিভূষিত। তিনি তার কাব্যে যে আবেগে মুসলমানদের মনোবেদনা বর্ণনা করেছেন, অনুরূপ আবেগে এবং অনেক ক্ষেত্রে অধিকতর নিষ্ঠায় হিন্দুদের মনোবেদনা বর্ণনা করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, হিন্দুদের দুর্বল করে অঙ্কন করলে শক্তিমান মুসলমানের কোন গৌরব নেই। কেননা, শৃগালের সঙ্গে যুদ্ধে সিংহের কোন গৌরব নেই।

৮.
কায়কোবাদের কাব্যসাধনার মূল উদ্দেশ্য ছিল পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়কে তার অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করা এবং তা পুনরুদ্ধারে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী, যার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর বিভিন্ন রচনায়। তিনি হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। ১৯৩২ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনের মূল অধিবেশনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা কাব্যসাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ তাঁকে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ ও ‘সাহিত্যরত্ন’ (১৯২৫) উপাধিতে ভূষিত করে।
 
৯.
১৮৫৭ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি ৯৪ বছর জীবিত ছিলেন। জীবনের সুদীর্ঘ ৮২ বছরই বাংলা সাহিত্য নিয়ে চর্চা করেছেন মহাকবি কায়কোবাদ। ১৯৫১ সালে ২১ জুলাই বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পুরাতন আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন হয়।

১০.
কায়কোবাদ দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন। ঐতিহাসিক সিপাহী বিপ্লবের বছরে সেই ১৮৫৭ সালে তার জন্ম এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের পূর্ব বছরে ১৯৫১ সালে। এত দীর্ঘ জীবন লাভের সৌভাগ্য খুব কম লেখকের জীবনেই ঘটে। কিন্তু তার এই দীর্ঘ জীবন পরিসরে পরিবর্তনশীল জগত ও সাহিত্যোদর্শের অনিবার্য বিবর্তনকে তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি বা করতে চাননি। বিশ শতকের পরিবর্তিত পরিবেশে অবস্থান করেও তিনি ছিলেন ঊনিশ শতকীয় সাহিত্যাদর্শ ও সাহিত্য রীতির অনুসারী। তাঁর কবি মানসের এই সীমাবদ্ধতা তাঁর মহাশ্মশান কাব্যের মহাকাব্যিক প্রয়াসকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তা সত্ত্বেও সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর বিপুল অবদান, তার উদার মানসিকতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা, তাঁর সত্যনিষ্ঠা এবং আধুনিক বাংলা সাহিত্যচর্চায় পশ্চাদপদ মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের অভয়দান ও অনুপ্রাণিত করার জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এবং আমাদের স্বকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা দাবি করবেন চিরকাল।

১১.
মহাশ্মশান কায়কোবাদ রচিত বাংলা মহাকাব্য (১৯০৪)। এর উপজীব্য ১৭৬১ সালে সংঘটিত পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল ভারতের উদীয়মান হিন্দুশক্তি মারাঠাদের সঙ্গে মুসলিমশক্তি তথা আহমদ শাহ আবদালীর নেতৃত্বে রোহিলা-অধিপতি নজীবউদ্দৌলার শক্তিপরীক্ষা; যুদ্ধে মুসলমানদের জয় হলেও কবির দৃষ্টিতে তা ছিল উভয়েরই শক্তিক্ষয় ও ধ্বংস; এজন্যই তিনি একে ‘মহাশ্মশান’ বলেছেন। যুদ্ধকাহিনীর মধ্যে অনেকগুলি প্রণয়বৃত্তান্ত স্থান পেয়েছে। মহাশ্মশান কাব্যে মোট তিনটি খন্ড রয়েছে। প্রথম খন্ড ১৯ সর্গ, দ্বিতীয় খন্ড ২৪ সর্গ এবং তৃতীয় খন্ড ৭ সর্গে সমাপ্ত। কাব্যের প্রারম্ভে আছে ‘কবির বীণা ও কল্পনা’ এবং ‘আল্লাহু আকবর’ নামক বন্দনা অংশ। এছাড়াও ‘এব্রাহিম কার্দ্দি ও জোহরা বেগমের বাল্য জীবনের এক অধ্যায়’ শীর্ষক একটি সর্গ আছে। মহাশ্মশান মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও নবীনচন্দ্র সেনের অনুসরণে রচিত হলেও মহাকাব্য হিসেবে তা খুব একটা সফল হয়নি। প্রকরণে ও মেজাজে কাব্যখানি বীররসের পরিবর্তে করুণরসের গীতিময় উচ্ছ্বাসে পরিণত হয়েছে। উপনিবেশিক শাসনামলে জাতীয়তাবাদী চেতনার আলোকে কবি হিন্দু-মুসলিম দুই জাতির বীরত্ব-গাথা রচনা করতে চেয়েছেন; এখানেই এ গ্রন্থের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিহিত।

১২.
মহাকবি কায়কোবাদ রচিত আমার আরো কিছু প্রিয় পংক্তিমালা পাঠ করা যাক।–
‘বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা আমার জন্মভূমি।
গঙ্গা পদ্মা যাচ্ছে ব’য়ে,
যাহার চরণ চুমি।
ব্রহ্মপুত্র গেয়ে বেড়ায়,
যাহার পূণ্য-গাথা!
সেই-সে আমার জন্মভূমি,
সেই-সে আমার মাতা!
আমার মায়ের সবুজ আঁচল
মাঠে খেলায় দুল!
আমার মায়ের ফুল-বাগানে,
ফুটছে কতই ফুল!
শত শত কবি যাহার
গেয়ে গেছে গাথা!
সেই-সে আমার জন্মভূমি,
সেই-সে আমার মাতা!
আমার মায়ের গোলা ছিল,
ধন ধান্যে ভরা!
ছিল না তার অভাব কিছু,
সুখে ছিলাম মোরা!
বাংলা মায়ের স্নিগ্ধ কোলে,
ঘুমিয়ে রব আমি!
বাংলা আমার মাতৃভাষা
বাংলা জন্মভূমি!’
(বঙ্গভূমি ও বঙ্গভাষা : কায়কোবাদ)
১৩. ১
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
যবে তুমি মুক্ত কেশে,
ফুলরাণী বেশে এসে,
করেছিলে মোরে প্রিয় স্নেহ-আলিঙ্গন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন? 
(প্রণয়ের প্রথম চুম্বন-১ )
১৩. ২
সে চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রেম-সম্ভাষণ,
অতৃপ্ত হৃদয় মূলে
ভীষণ ঝটিকা তুলে,
উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
(প্রণয়ের প্রথম চুম্বন-৪ )
১৩. ৩
বিদায়-চুম্বন,
উভয়েরি প্রাণে করে অগ্নি বরিষণ,
উভয়ে উভয় তরে,
আকুলি ব্যাকুলি করে,
উভয়েরি হৃদিস্তরে যাতনা-ভীষণ!
এমনি কঠোর হায় বিদায়-চুম্বন!
(বিদায়ের শেষ চুম্বন-২ )

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, দৈনিক ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন পত্রিকা, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত