আহমদ ছফা

প্রকাশ : ০১ জুলাই ২০১৮, ১০:৫৫

লেখক, চিন্তাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী আহমদ ছফা। ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর রচনায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। কৃষিজীবী পরিবারে বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা। তাঁর স্কুল ও কলেজের লেখাপড়া যথাক্রমে চট্টগ্রাম ও ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। সমাজবিজ্ঞান নিয়ে কিছুদিন পদ্ধতিগত গবেষনা করেন। কিন্তু অচিরেই তা ছেড়ে দিয়ে মৌলিক রচনা ও চিন্তাচৰ্চায় মনোনিবেশ করেন। মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য সাংবাদিকতা, পত্রিকা প্ৰকাশ, প্রেস ব্যবসা বা এনজিও কার্যক্রমকে পেশা হিসেবে নিলেও আজীবন লেখালেখিই ছিল তাঁর মূল কাজ।

তিনি ২০০২ সালে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। জীবদ্দশায় আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বুদ্ধিজীবি মহলে বিশেষ আলোচিত ছিলেন।

১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন এবং এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন আহমদ ছফা। পরবর্তীতে কলকাতায় গিয়েও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ‘দাবানল’ নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সৃষ্টিশীল এই লেখক শুরু থেকেই ছিলেন প্রথাবিরোধী। পড়াশোনা চলাকালীন অবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি ন্যাপ বা তৎকালীন জনপ্রিয় গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে আহমদ ছফাকে। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে এবং পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুদিন আত্মগোপন করেন। এরপর ১৯৮৬ সালের দিকে এসে জার্মান ভাষার উপর গ্যেটে ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। গ্যেটের অমর সাহিত্য ‘ফাউস্ট’ অনুবাদের ক্ষেত্রে এটিই ছিল প্রথম সোপান। গান, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদসহ সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখা মিলিয়ে ৩০টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন আহমদ ছফা।

সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন আহমদ ছফা। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণ কাহিনী মিলিয়ে ত্রিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায়ই আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। তাঁর রচনাবলী ৯ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথি’ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলী হলো, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘অলাতচক্র’ (১৯৯৩), বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), ‘ওঙ্কার’ (১৯৭৫), বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১), একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন (১৯৮৮), অলাতচক্র (১৯৯৩), গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্পবৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬), ফাউস্ট (১৯৮৬), যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮) ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে অভূতপূর্ব সংযোজন। তাঁর প্রবন্ধ দেশের রাজনীতি ও ইতিহাসের অনবদ্য দলিল এবং এ ক্ষেত্রে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অন্য রকম হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার প্রবণতা আয়ত্ত করার প্রয়োজনই পড়েনি আহমদ ছফার। কারণ তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন অন্য রকমই। সমাজের বিদ্যমান অসঙ্গতিগুলোকে ঘৃণা করতেন তিনি। বুদ্ধিবৃত্তির নামে ব্যবসা ফাঁদার প্রবণতার প্রতি ধিক্কার জানাতেন তিনি। বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে বিভিন্ন সময় যে বিতর্ক বা দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন আহমদ ছফা, সেখানে ব্যক্তিগত আক্রোশ বা স্বার্থের গন্ধ ছিল না। তিনি যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, সেই ব্যক্তিকেও একটি প্রতিষ্ঠান বা ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করেই তাঁর বিরোধিতা করেছেন। কখনো কখনো তাঁর বিবেচনা বা বিচার ভুল হয়েছে হয়তো। কিন্তু সেসব বিতর্ক যে সচেতন মানুষের সামনে অনেক নতুন চিন্তা এবং চিন্তাপদ্ধতির পথ খুলে দিয়েছে সেকথা অনস্বীকার্য। ২০০১ সালের ২৮ জুলাই তিনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।

কিংবদন্তী চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ছিলেন আহমদ ছফা। এঁরা দুজনেই ছিলেন বোহেমিয়ান বা ভবঘুরে, অবিবাহিত এবং খ্যাতি, ধন-সম্পদ বা অন্যান্য বৈষয়িক মোহ বিবর্জিত। এক শতাব্দিতে এমন ব্যক্তিত্ব আর দুটি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন আহমদ ছফা নিজেই।

"আমি মনে করি আমার স্বীকৃতি নিয়ে পশ্চিম বাংলা কী বলতে চায় সেটা আমার লুক আউট নয়। আমি পৃথিবীর গন্ধ এবং স্বাদ বুঝি। তুমি দেখবে আমি যখন আমেরিকায় যাবো তখন ওখানেও ঝড় তুলবো। তখন ওখানকার পণ্ডিতদের সাথে দেখবে আমি কিভাবে মিশে গেছি। সুলতানের বিশালত্ব চিন্তা করো, ৭৬-এর আগে এই জায়ান্ট কোথায় ছিলো? কেউ তাকে আবিস্কার করলো না কেন? এই আমি যাকে প্রেজেন্ট করেছি, আরেকজন লোক আসুক তো এমন।"

অাহমদ ছফা নিজে যা বিশ্বাস করতেন কেবলমাত্র তা-ই লিখতেন। ভান ধরা বা কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ছিল তাঁর অপছন্দ। আমাদের দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের নিয়ে লিখেছেন, তাদের প্রতিনিধিত্ব করেই লিখেছেন। লেখালেখি ছিল তার নেশা। ছফার গভীর চিন্তাশীলতার প্রতিফলন ঘটেছে তার দুটি উল্লেখযোগ্য রচনা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ (১৯৭৩) ও ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ (১৯৭৬) গ্রন্থে। গ্রন্থ দুটির বিশেষ চিন্তামূলক রচনাসহ দেশ, সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক নিবন্ধসমূহ তাঁকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী লেখকের মর্যাদাপূর্ণ আসন দিয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত