শহীদ ছাত্রনেতা আসাদ

প্রকাশ : ১১ জুন ২০১৮, ১১:০৫

উনিশশো ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ছাত্রনেতা আসাদের জন্মদিন আজ। তাঁর পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। আসাদুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ১১ দফা আদায়ের মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যু ঊনসত্তরের ছাত্র-গণআন্দোলনের গোটা অবয়বকেই পাল্টে দেয় এবং তা আইয়ুব খানের শাসন ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়।

আসাদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)-এর ঢাকা হল শাখার সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান সংগঠক। ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশ থেকে এগারো দফার বাস্তবায়ন এবং ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ ও ই.পি.আর বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লঙ্ঘনের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ২০ জানুয়ারি গোটা পূর্ব পাকিস্তানের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানিয়েছিল। এ ধর্মঘট মোকাবিলার জন্য প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। তথাপি বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সমবেত হতে থাকে এবং বেলা ১২টার দিকে বটতলায় এক সংক্ষিপ্ত সভা শেষে প্রায় দশহাজার ছাত্রের একটি বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজপথে এগিয়ে চলে। মিছিলটি চাঁনখা’র পুলের কাছে তখনকার পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি অাসার পর পুলিশ মিছিলে হামলা চালায়। প্রায় ঘন্টাখানেক সংঘর্ষ চলার পর আসাদসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা মিছিলটিকে ঢাকা হলের পাশ দিয়ে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা খুব কাছ থেকে রিভলবারের গুলি ছুঁড়ে আসাদকে হত্যা করে।

হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী মেডিক্যাল কলেজের দিকে ছুটে আসে। বেলা তিনটায় কোনো রকম প্রস্ত্ততি ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বের হয় একটি বিরাট শোক মিছিল। মেয়েদের নেতৃত্বে এ মিছিল অগ্রসর হতে থাকলে সাধারণ জনগণও এতে যোগ দেয়। আসাদের মুত্যুর প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে বের হওয়া প্রায় দুমাইল দীর্ঘ মিছিলটি শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়।

শোকাতুর ও আবেগে আপ্লুত অগণিত ছাত্র-জনতার মিছিলে শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট দেখে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি শামসুর রাহমান তাঁর অমর কবিতা 'আসাদের শার্ট' লিখেন।
এছাড়াও, বাংলাদেশের অন্যতম কবি হেলাল হাফিজ এ ঘটনায় ক্রোধে ফেঁটে পড়েন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে কালজয়ী 'নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়' কবিতাটি লিখেন। ছাত্র আন্দোলনে আসাদের মৃত্যুতে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় আলোকচিত্র শিল্পী রশীদ তালুকদার তার ক্যামেরায় স্থিরচিত্র হিসেবে ছাত্র-জনতার দীর্ঘ মিছিলসহ আসাদের শার্টের ছবি ওঠান।

আসাদের মৃত্যুতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি গোটা পূর্ব পাকিস্তানে তিনদিনব্যাপী শোক ঘোষণা করে। এ ছাড়া কমিটি ঢাকা শহরে হরতাল এবং পরবর্তী চার দিন প্রতিবাদ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। ২৪ তারিখে হরতালে গুলি চললে ঢাকার পরিস্থিতি গভর্নর মোনেম খানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সরকারের দমন নীতি জনতাকে দাবিয়ে রাখতে পারে নি এবং শেষাবধি প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পতন ঘটে।

সত্যিকার অর্থে আসাদের মৃত্যুতে ঊনসত্তরের গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। অনেক জায়গায় জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইয়ুবের নামফলক নামিয়ে আসাদের নাম উৎকীর্ণ করে। এভাবে ‘আইয়ুব গেট’ হয়ে যায় ‘আসাদ গেট’,‘আইয়ুব এভিনিউ’ নামান্তরিত হয়ে হয় ‘আসাদ এভিনিউ’। তখন থেকে আসাদের নাম হয়ে ওঠে নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক।

শহীদ আসাদ ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বড় ভাইয়ের নাম প্রকৌশলী রশিদুজ্জামান। শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ও এমসি কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৬৬ সালে বি.এ এবং ১৯৬৭ সালে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। এই বৎসরেই আসাদ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এবং কৃষক সমিতির সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাষাণী'র নির্দেশনায় কৃষক সমিতিকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে শিবপুর, মনোহরদী, রায়পুরা এবং নরসিংদী এলাকায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন।

ঢাকা'র সিটি ল কলেজে তিনি ১৯৬৮ সালে আরো ভালো ফলাফলের জন্যে দ্বিতীয়বারের মতো এম.এ বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের জন্য চেষ্টা করছিলেন। ১৯৬৯ সালে মৃত্যুকালীন সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এম.এ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। শহীদ আসাদ তৎকালীন ঢাকা হল (বতর্মান শহীদুল্লাহ হল) শাখার পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে এবং পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপসু-মেনন গ্রুপ), ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত প্রাণ আসাদুজ্জামান গরিব ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার বিষয়ে সর্বদাই সজাগ ছিলেন। তিনি শিবপুর নৈশ বিদ্যালয় নামে একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিবপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদেরকে সাথে নিয়ে আর্থিক তহবিল গড়ে তোলেন

শুধু ছাত্র ও কৃষক সংগঠনে অথবা গণশিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যেই আসাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতা সীমিত ছিল না। তিনি উন্নত রাজনৈতিকে আদর্শ বহনকারী একটি পার্টির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ১৯৬৮ সালে লিখিত তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে সর্বহারা শ্রেণির রাজনীতি পরিচালনার জন্য সংক্ষিপ্তভাবে স্টাডি সার্কেল গঠন করার কথা লেখা আছে। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটির একজন অগ্রণী সংগঠক, যারা ১৯৬৮ সাল থেকেই সার্বভৌম ও শ্রেণিশোষণমুক্ত একটি দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছিলেন।

সূত্র : 
♦ বাংলাপিডিয়া
♦ 'আসাদ ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান'- মেসবাহ কামাল, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত