স্যার যদুনাথ সরকার

প্রকাশ : ২০ মে ২০১৮, ১১:১৯

 

ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণায় স্যার যদুনাথ সরকার পথিকৃৎ বা পথ প্রদর্শক ছিলেন। স্যার যদুনাথ সরকারের জন্ম ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর, বৃহত্তর রাজশাহী জেলার আত্রাই থানার (বর্তমান নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার ছাতারদিঘী ইউনিয়ন) কড়চমারিয়া গ্রামে৷ পিতা রাজকুমার সরকার এবং মাতা হরিসুন্দরী দেবীর ৭ পুত্র এবং ৩ কন্যার মধ্যে তিনি ৫ম সন্তান, ৩য় পুত্র। তাদের পূর্বপুরুষ ধনবান জমিদার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। বিদ্যানুরাগী পিতা রাজকুমার সরকারের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ছিল বিশালাকার। গণিতের ছাত্র হলেও ইতিহাসে ছিল গভীর আগ্রহ। নানা জনহিতকর কাজে তিনি সময় ও অর্থ ব্যয় করতে ভালোবাসতেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই বিষয়গুলো যদুনাথ সরকারকে প্রভাবান্বিত করেছিল। পিতার মাধ্যমেই অল্প বয়সে তাঁর পরিচয় হয়েছিল বার্ট্রান্ড রাসেলের গ্রন্থের সঙ্গে। রাজকুমার সরকার তার পুত্রের হাতে প্লুটার্ক রচিত প্রাচীন গ্রিক ও রোমান নায়কদের জীবনী তুলে দিয়েছিলেন। পিতাই তাঁর কিশোর হৃদয়ে ইতিহাসের নেশা জাগিয়ে দিয়েছিলেন।

গ্রামের স্কুলে তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু। তারপর অধ্যয়ন করেছেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। এরপর গন্তব্য কোলকাতার হেয়ার স্কুল ও সিটি কলেজিয়েট স্কুল। পরে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন প্রথম শ্রেণীতে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন। তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে ১ম বিভাগে দশম স্থান অধিকার করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তী গন্তব্য কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ। থাকতেন ইডেন হোস্টেলে। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইতিহাস ও ইংরেজি সাহিত্য - এই দুটি বিষয়ে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন এবং ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে ৯০% নম্বর নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন৷ ১৮৯৭ সালে তিনি ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বর্ণপদকসহ দশ হাজার টাকা বৃত্তি লাভ করেন৷

অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে যদুনাথ সরকারের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শুরু হয়। ১৮৯৩ সালে যদুনাথ সরকার ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কলকাতার রিপন কলেজে যোগদান করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি প্রাদেশিক শিক্ষা বিভাগে যোগ দেন এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে নিয়োগ লাভ করেন। তাঁর প্রবন্ধ India of Aurangzeb ১৯০১ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯১৭ সালে যদুনাথ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন। ১৯১৮ সালে তিনি ভারতীয় শিক্ষা বিভাগের জন্য মনোনীত হন। ইংরেজি ও ইতিহাস দুটি বিষয়ই পড়াবার জন্য তাঁকে কটকের র‌্যাভন’শ কলেজে বদলি করা হয়। ১৯২৬ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর যদুনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯২৮ সালের ৭ আগস্ট তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। যদুনাথের পিতা ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এ ধর্মমতের প্রতি যদুনাথের কতটা আকর্ষণ ছিল তা বলা মুশকিল। তিনি কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত-এর (সতের শতকে) একটি সংক্ষিপ্ত ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। ব্রাহ্মরা কোনোদিনই যদুনাথকে তাঁদের সম্প্রদায়ভুক্ত বলে দাবি করেন নি।

যদুনাথ সরকার ১৯২৩ সালে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সদস্য হন। তাঁকে ইতিহাস-চর্চায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতা, যিনি সিস্টার নিবেদিতা নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ঐতিহাসিক গবেষণা-গ্রন্থ রচনার জন্য বাংলা, ইংরেজী, সংস্কৃত ভাষা ছাড়াও উর্দু, ফারসী, মারাঠীসহ আরও কয়েকটি ভাষা শিখেছিলেন। যদুনাথের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করা দুঃসাধ্য, কারণ এ বিষয়ে তিনি কিছু লেখেন নি। ইংরেজি সাহিত্য পড়ার পর যদুনাথ কেন দিক পরিবর্তন করে মধ্যযুগের ইতিহাসে আগ্রহী হয়েছিলেন সেটা নিরূপণ করাও কঠিন।

উনিশ শতকের বাংলায় দুটি ঐতিহাসিক ধারণা মুখোমুখি হয়। একটি ছিল আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে শুরু হওয়া ইংরেজ ঐতিহাসিকদের লেখা। দ্বিতীয় ধারণাটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী লেখা যেগুলিতে প্রায়শ বাংলায় বীরের সৃষ্টি করা হতো এবং যদুনাথ প্রায়ই যার বিরোধিতা করে লিখতেন। তাঁর এ ধরনের লেখা, বিশেষত ‘মুক্তিযোদ্ধা’ প্রতাপাদিত্যের ঐতিহাসিকতার বিরুদ্ধে রচনা এ ধারণাকে দৃঢ় করে যে, যদুনাথ ইংরেজ সমর্থক ছিলেন।

ইলিয়ট ও ডাউসন যদুনাথকে প্রভাবিত করেছিলেন, তবে তাঁদের উভয়ের চিন্তাধারা এক ছিল না। নিজের প্রথম গ্রন্থে ইলিয়টের দাবির বিপক্ষে যদুনাথ দেখান যে, মুসলমান ঐতিহাসিকগণ শুধু রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কেই লেখেননি, তাঁরা মুগল সাম্রাজ্যের আর্থ-সামাজিক বিষয়েও লিখেছিলেন। সাধারণ অর্থে, যদুনাথ মিলের পথনির্দেশ গ্রহণ করেছিলেন। মুগলপূর্ব সুলতানি আমলকে যদুনাথ ‘অন্ধকার যুগ’ বলে বিবেচনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিল্পকলা, শাসনপদ্ধতি ও আইন-শৃঙ্খলাকে আকবর এক নতুন উন্নততর অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সব সময়ই জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক শ্রেণিরূপে তুলনা করায় মিল অথবা এলফিনস্টোন দুজনের কেউই সুলতানি আমলকে সেভাবে বিবেচনা করেন নি।

যদুনাথ আকবরের প্রশংসা করলেও তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রথম গ্রন্থের বিষয়বস্ত্ত হিসেবে আওরঙ্গজেবকে বেছে নিয়েছিলেন, যার ফলে তিনি প্রায় এলফিনস্টোনের পর্যায়ে পৌঁছে যান। যদুনাথ এলফিনস্টোন থেকে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। আওরঙ্গজেবের নীতির প্রতিক্রিয়ার ফলে মুগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল এবং প্রগতিশীল ও সুসভ্য ইংরেজ কর্তৃক ভারতীয় সভ্যতা পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল এটা দেখানোই ছিল এলফিনস্টোনের উদ্দেশ্য। Fall of the Mughal Empire গ্রন্থের মাধ্যমে যদুনাথ দেখাতে চেয়েছিলেন যে, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণেই মুগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। তবে ইংরেজদের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি নীরব ছিলেন। পলাশীর যুদ্ধএর বর্ণনার পরই শুধু তিনি ইংরেজদের বিজয়কে ‘নতুন রেনেসাঁর’ অগ্রদূত রূপে ঘোষণা করেছিলেন, ‘...পৃথিবী যার সমতুল্য আগে কোনোদিন দেখেনি...’।

জেমস মিল-এর ভারতীয় ইতিহাসের যুগ-বিভাজন সম্পর্কেও যদুনাথ তেমন উচ্চবাচ্চ করেন নি। এ ধরনের কাল-বিভাজনের জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক ভিত্তি সম্পর্কে তিনি নির্দিষ্টভাবে বিরোধিতা করেন নি, তবে অধিক্রমণকারী যুগগুলির সমস্যাবলি অনুধাবনের অসুবিধাগুলি তিনি আগেই বুঝেছিলেন। যদুনাথের পদ্ধতিগত বিদ্যার অন্যতম ছিল ‘সাক্ষ্য-প্রমাণের’ উপর গুরুত্ব আরোপ, যদিও তিনি সেসব সাক্ষ্যের সমর্থনের বিবরণে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেন নি। ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বিভিন্ন ভাষার দলিলপত্র সংগ্রহে অনেক পরিশ্রম করেন। সেই সময়ের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁর পূর্বসূরিদের অনেকের মতোই যদুনাথ প্রধানত রাজনৈতিক ও সামরিক প্রকৃতির ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অনুসন্ধানের ফলে জয়পুর থেকে প্রাপ্ত আখবরাত, বাহারিস্তান-ই-গায়েবী, হাফ্ত আঞ্জুমান ও অন্যান্য দলিলপত্রসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল। এগুলির বেশ কয়েকটি ততোদিন পর্যন্ত ব্যক্তিগত সংগ্রহে অথবা ইউরোপীয় মহাফেজ খানায় রক্ষিত ছিল। বস্ত্তত, যদুনাথ তাঁর সারাজীবন এ ধরনের দলিলপত্র সংগ্রহেই ব্যয় করেছেন, যেগুলি তিনি প্রায়ই ‘ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল রেকর্ডস কমিশন’-এর সম্মেলনে উপস্থাপন করেছিলেন। সমকালীন ইংরেজি ও ফরাসি দলিলপত্রকে তিনি প্রায় একই রকম গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সতের শতকের ফরাসি বণিক ফ্রাঁসোয়া মার্টিনের রোজনামচার অংশবিশেষ তিনি উদ্ধার করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ সেন অবশ্য তাঁর অনুবাদ কর্মের কঠোর সমালোচনা করেন। অন্যদিকে যদুনাথ সংস্কৃত কাব্য, মারাঠা দলিলপত্র এবং বখর সাহিত্যের মূল্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। যদুনাথের কাছে পুণা রেসিডেন্সির পত্রাবলির মতো সমকালীন ইংরেজি পত্রাবলি ছিল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভারতীয় দলিলপত্রে না পাওয়া অনেক তথ্য সেখান থেকে জানা গিয়েছিল।

ইউরোপীয় এই সব দলিলপত্র যদুনাথের ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছিল। যুদ্ধ সম্পর্কিত তাঁর গ্রন্থে সৈন্য চালনার বর্ণনা দিতে এবং যথাযথ স্থান চিহ্নিত করতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং এ উদ্দেশ্যে তিনি স্থানগুলি বারবার পরিদর্শন করেন। ফলে যুদ্ধগুলির বর্ণনা অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে যদুনাথ তাঁর ভৌগোলিক জ্ঞান ব্যবহার করেছেন, যা সমকালীন অন্যান্য ঐতিহাসিক করেন নি। তাঁর পূর্বকৃত শনাক্তীকরণ তিনি বহুবার শুদ্ধ করেছেন। সুতরাং যদুনাথ প্রায় নৈর্ব্যক্তিকভাবে ‘ঘটনাবলির’, অবশ্য দলিলপত্রে শুধু তাঁর দৃষ্টিগোচর ‘ঘটনাবলির’, মধ্যে ‘সত্য’ সন্ধান করেছিলেন।

ঐতিহাসিক গবেষণা ছাড়াও তিনি একজন বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। এছাড়াও, রবীন্দ্র-সাহিত্যের সমঝদার পাঠক ছিলেন যদুনাথ সরকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার পাবার আগেই তিনি কবির রচনার ইংরেজী অনুবাদ করে পাশ্চাত্য জগতের কাছে তাঁর পরিচয় তুলে ধরেন। 

জাভা-যাত্রার পূর্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্সটিটিউটে বৃহত্তর ভারত পরিষদের উদ্যোগে পরিষদের স্থায়ী সভাপতি রবীন্দ্রনাথকে ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে বিদায় সম্ভাষণের অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য যদুনাথ সরকার সভাপতির অাসন অলঙ্কৃত করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি রবীন্দ্রনাথকে "পূর্বতন ঋষিদের স্থলাভিষিক্ত অধুনাজীবিত ব্যক্তি" বলে অভিহিত করেন।

বিশ্বভারতীর শিক্ষাপদ্ধতি যদুনাথ সরকার অনুমোদন করেন নি। তিনি বিশ্বাস করতেন, উপযুক্ত যোগ্যতা সৃষ্টি, সুনির্দিষ্ট নিয়মে অধ্যয়ন এবং গবেষণার ক্ষেত্রে কঠোর অধ্যাবসায় দ্বারা নির্দিষ্ট ফল লাভ করাই শ্রেয়। তিনি মনে করতেন বিশ্বভারতীতে নীতিনিয়মের কঠোরতা নেই। কেবল আদর্শ ও ভাবের পরিবেশই এখানে রচিত হয়েছে। পূর্বতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে শিশু ও কিশোরদের পক্ষে এটা উপযোগী হতে পারে, কিন্তু বিশ্বভারতীর উচ্চতর বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে এটি উপযোগী নয়। এই পাঠপদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পাঠক্রমে অধ্যয়ন করার জন্য অনুমোাদিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক ছিল না। শিক্ষার্থীরা আশ্রম বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেই বিশ্বভারতীতে প্রবেশাধিকার পেত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি ব্যতিরেকেই উচ্চতর পাঠক্রমে প্রবেশাধিকারকে যদুনাথ সন্তুষ্টিচিত্তে গ্রহণ করতে পারেননি।

১৯০৪ সাল থেকে মারাঠা ইতিহাস গবেষণা সূত্রে গোবিন্দ সখারাম সরদেশাইয়ের সঙ্গে যদুনাথের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব জন্মে। ওই সময় থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যদুনাথের পরিচয়। অনুমান করা হয় যদুনাথের পরামর্শে সরদেশাই তাঁর পুত্র শ্যামকান্তকে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করতে পাঠান। বিশ্বভারতীর শিক্ষাক্রম সম্পর্কে যদুনাথ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন নি। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যদুনাথের এই মনোভাব সহজভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। যদুনাথ অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সহজভাবেই ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করেন। তিনি দার্জিলিং-এ তাঁর টোঙ্গা রোডের বাড়ি থেকে প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের জন্য টাটকা ছানা ও ছানার মিষ্টি রবীন্দ্রনাথের দার্জিলিং-এর বাসায় পাঠাতেন।

যদুনাথ সরকার ২৫টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও ১২টি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। ১৯০১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত 'হিস্ট্রি অফ ঔরঙ্গজেব'। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে 'দ্য ফল অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার', 'শিবাজী' (বাংলা), 'মিলিটারী হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া', 'দ্য রানি অফ ঝাঁসী', 'ফেমাস ব্যাটেল্‌স্‌ অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি', 'শিবাজী এন্ড হিজ টাইম', 'ক্রনোলজী অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর সংগৃহীত গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি প্রদান করেন। ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৪৪ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে বিরল সম্মান অর্জন করেছিলেন। ৮৮ বছর বয়সে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে তিনি কলকাতায় পরলোকগমন করেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত