দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

প্রকাশ : ১৬ জুন ২০১৬, ১০:৩৪

গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল

ভারতীয় উপমহাদেশের কোটি কোটি জনগণ তাকে জানে ও চিনে একজন সুবিখ্যাত রাজনীতিক ও আইনবিদ হিসাবে। লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারী পাস করে কলকাতায় আইন ব্যবসা করতেন তিনি। ১৮৪৯ সালে কলকাতায় যখন চালের মণ ছিল মাত্র আড়াই টাকা তখন তিনি প্রতিটি মামলার পরামর্শ ফি নিতেন এক হাজার টাকা। রাজনীতিতে ছিল তার যশ, খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা। প্রথম জীবনে তিনি বিলাসী ও ব্যয়বহুল জীবন-যাপন করতেন।

তিনি এতটাই সৌখিন ছিলেন যে তার পরিধেয় বস্ত্র ফ্রান্সের প্যারিস থেকে ধোলাই করে আনা হতো। অবশ্য রাজনীতিতে এসে তিনি বিলাসিতা ত্যাগ করেন। তিনি হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ রাজনীতিক ও আইনবিদ হলেও তিনি ছিলেন সাহিত্যপ্রেমী। তার এ কাব্য সাধনার কথা নিকটজন ছাড়া অনেকেই জানত না। চিত্তরঞ্জন দাশকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল কবিতা লিখেছেন।

চিত্তরঞ্জন যে সময় কবিতা চর্চা শুরু করেন তখন সমগ্র ভারতবর্ষ বৃটিশ শাসনে। এদেশের মানুষ বিদেশি শাসক দ্বারা অত্যাচারিত হতো। তার কবিতায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট আর ব্যথার কথাই প্রতিফলিত হয়েছে। আবার দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে ও সাহসের বাণী প্রতিফলিত হতো দেশবন্ধুর কবিতায়। এ বাংলার মাটি ও মানুষের কথাই প্রতিফলিত হতো কবিতার প্রতিটি চরণে। "দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ" মালঞ্চ, মালা, সাগর সংগীত, অন্তর্যামী ও কিশোর-কিশোরী নামে পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। মানব কল্যাণমূলক ও সেবাধর্মী কবিতাই তিনি বেশি লিখতেন।

কবি চিত্তরঞ্জন দাশের "পরার্থে কামনা" একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা। কবিতাটির কয়েকটি চরণ তুলে ধরা হলঃ "মোছ আঁখি মনে কর এ বিশ্ব সংসার/ কাঁদিবার নহে শুধু বিশাল প্রাঙ্গণ। রাবনের চিতাসম যদিও আমার/জ্বলিছে জ্বলুক প্রাণ, কেনগো ক্রন্দন? অপরের দুঃখ জ্বালা হবে মিটাতে/ হাসির আবরণ টানি দুঃখ ভুলে যাও। জীবনের সর্বস্ব অশ্রু মুছাইতে/ বাসনার স্তর ভাঙ্গি বিশ্ব ঢেলে দাও/ হায় হায় জন্মিয়া যদি না ফুটালে/ একটা জীবনে ব্যথা যদি না জুড়ালে/ বুক ভরা প্রেম ঢেলে বিফল জীবনে/ আপনা রাখিলে, ব্যর্থ জীবনে সাধনা/ জনম বিশ্বের তরে-পরার্থে কামনা।"

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জন্ম ৫ নভেম্বর ১৮৭০ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার তেলিরবাগ গ্রামে। তার পিতা ভুবনমোহন দাশ ছিলেন একজন এটর্নী ও ব্রাহ্মণ সমাজের প্রভাবশালী নেতা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ লেখাপড়া করেন কলকাতায়। পরে লন্ডনে যান আইন বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রীর জন্য। ফিরে এসে কলকাতায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। বৃটিশ বিরোধী আলীপুর "বোমা মামলার" অরবিন্দু ঘোষের পক্ষাবলম্বন করে প্রচুর সুনাম অর্জন করেন চিত্তরঞ্জন দাশ।

তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসহযোগনীতি অনুসরণ করে আদালত বর্জন করেন এবং কলকাতা শহরের বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং করেন। ১৯২১ সালে ইংরেজদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। মহাত্মা গান্ধীর সাথে রাজনৈতিক মতপার্থক্য দেখা দেয় এবং তিনি "স্বরাজ পার্টি" নামে একটি দল গঠন করেন। তিনি রাজনীতির সাথে সাথে সাহিত্য ও সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি ফরোয়ার্ড, নারায়ণ ও লিবার্টি নামক পত্রিকা প্রকাশ করতেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র ছিলেন। ১৯২৪ সালে তিনি মেয়র হন।

১৬ জুন ১৯২৫ সালে মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে কবি, সাংবাদিক ও রাজনীতিক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ মারা যান।

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে উদ্দেশ্য করে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেনঃ এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান"। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার চিত্তনামা কাব্য ও দেশবন্ধুকে স্মরণ করেই লিখেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত