হামলার বিচারের চেয়ে যখন প্রক্টর সরানোই বড়

প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৩, ১৬:৫৫

সাহস ডেস্ক

ব্যক্তিগত কোন্দলে বহিরাগতের হাতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) দুই শিক্ষার্থী মারধরের শিকার হয়েছেন। তাদের বাঁচাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন আরেক শিক্ষার্থী। তারা তিনজনই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ে পদধারী। কমিটি বিলুপ্তির পরপরই মার খেয়েছেন তারা। তবে এভাবে মারধরের শিকার হয়ে বিচারের চেয়ে যেন তাদের সামনে প্রক্টরকে সরানোই এখন বড় ‘মিশন’ হয়ে দাড়িয়েছে।

মারধরের বিচার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো লিখিত না দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় মামলা করার আগেই নিজেরা মামলা করা, বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন ডেকে প্রথম দাবিতে প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর অপসারণ এবং বিলুপ্ত কমিটির নেতাকর্মীদের নিয়ে ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার’ ব্যানারে মানববন্ধনের আয়োজন করে প্রক্টর অপসারণের দাবি তোলায় এসব প্রশ্ন উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহল বলছে, মারধরের বিচার চাওয়ার আড়ালে ‘প্রক্টর বধের’ মিশনে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলুপ্ত কমিটির নেতাকর্মীরা।

একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো: তোফায়েল হোসেন মজুমদার বলেন, ‘একটা পক্ষ সরাসরি প্রক্টরের দিকে আঙুল তুলে ঘটনাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। কোন ধরনের তথ্য প্রমাণ ছাড়া এই ধরনের অপপ্রচার চালানোর তীব্র নিন্দা জানাই। এই ঘটনার পেছনে যারা ইন্ধন দিচ্ছে আবার তারাই হামলার সাথে জড়িত কিনা আমি সেখানে সন্ধিহান।’

এই ব্যাপারে গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘গত কয়েকদিনে প্রক্টরিয়াল টিমের অবদান প্রশংসনীয়। প্রক্টরিয়াল টিম কখনো অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে না বরং তারা আইন-শৃঙখলা বাহিনীর কাছে তাৎক্ষণিক অভিযোগ জানায়। কিন্তু ছাত্ররা প্রক্টরকে নিয়ে যে ব্যাঙ্গচিত্র অঙ্কন করেছে তা দৃষ্টিকটু।’

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এন এম রবিউল আউয়াল চৌধুরী বলেন,‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ একাডেমিক কাজ পরিচালনা করা, পাশাপাশি গবেষণা করা। হঠাৎ করেই কোন কারণ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থির করার একটা পায়তারা শুরু হয়েছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন প্রকার অস্থিরতা চাই না। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর উপর বহিরাগত যারা হামলা করেছে তাদের শাস্তির দাবিতে প্রশাসন সক্রিয় রয়েছে। প্রক্টরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তা ভিত্তিহীন। যদি তিনি অপরাধ করে থাকে তাহলে আমরা বঙ্গবন্ধু পরিষদ থেকেও ব্যবস্থা নিবো।’

গত বুধবার (৮ মার্চ) ক্যাম্পাস সংলগ্ন একটি মসজিদের সামনে মারধরের শিকার হন শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সালমান চৌধুরী। প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা যায়, সালমান চৌধুরীকে বিপ্লব দাস ও কাউসার মারতে শুরু করলে এনায়েত উল্লাহ বাধা প্রদান করেন। সে সময় বিপ্লব দাস তাকে থাপ্পড় মারে এবং কাউসার লাঠি দিয়ে বাড়ি দিতে গেলে আটকাতে যায় একই হল শাখা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি সাইদুল ইসলাম রোহান, তার হাতে লাঠির বাড়ি পরে। ফলে হাত ভেঙে যায় রোহানের। এরপর রনি এনায়েত উল্লাহকে মারতে শুরু করে।

এনায়েত উল্লাহকে মারধরের ঘটনার ৩০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায় ঘটনাস্থলে স্থানীয় ছাত্রদল নেতা রনি মজুমদার এনায়েত উল্লাহকে মারধর করছেন। এছাড়াও এ সময় আরো উপস্থিত দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও খুনের মামলায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়া বিপ্লব দাস, অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী কাউসার হোসেন, মো. ফয়সালকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের নবম ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মো ইকবাল হোসেন খানও সেখানে ছিলেন।

ঘটনা অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের ১৭ মার্চ ডেকোরেশনের বাঁশের ওপর প্রস্রাব করতে নিষেধ করায় রনি মজুমদার নামক এক স্থানীয় ছাত্রদল নেতাকে মারধর করে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খায়রুল বাশার সাকিব। সেই রেশ ধরে গত ৮ মার্চ রনি এনায়েতকে মারধর করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রনি এখন পর্যন্ত পলাতক অবস্থায় আছেন। এছাড়া ঘটনাস্থলে থাকা বিপ্লব দাস, কাউসার কারো খোঁজই নেই পুলিশের কাছে। ঘটনাস্থলে থাকা ইকবাল হোসেন খান মারধরের শিকার আরেক শিক্ষার্থী সালমান চৌধুরী হৃদয়ের বিভাগের সিনিয়র। তবে ২০১৮ সালে বিভাগের সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও সালমান ইকবালকে মারধর করেন বলে অভিযোগ আছে। অনেকের ধারণা সেই ক্ষোভ থেকে সালমানকে ডেকে নিয়ে শাসানো শুরু করা হয়, তবে ইকবাল সেখানে থাকলেও মারধর বা শাসানোতে অংশ নেননি বলে নিশ্চিত করেছেন একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একই দিন ক্যাম্পাসের মূল ফটকের সামনে প্রক্টরকে উদ্দেশ্য করে নানারকম স্লোগান দিতে থাকে বিলুপ্ত কমিটির নেতাকর্মীরা। পরবর্তীতে তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন, সেখানেও তারা প্রক্টরের পদত্যাগ চেয়ে স্লোগান দেন। কুমিল্লা জেলার এসপি আব্দুল মান্নানের আশ্বাসে দেড় ঘন্টা পর মহাসড়ক ত্যাগ করেন তারা।

পরের দিন ৯ মার্চ বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে বিলুপ্ত কমিটির নেতাকর্মীরা। সেখানে প্রথম দাবি ছিল প্রক্টরের পদত্যাগ। সেই ধারাবাহিকতায় রবিবার (১২ মার্চ) বিলুপ্ত কমিটির নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসের মূলফটক সংলগ্ন রাস্তায় মানববন্ধন করেন। এ সময়ও তারা মারধরকারীদের বিচারের চেয়ে প্রক্টরের পদত্যাগের বিষয়ে জোর দেন। প্রক্টরকে নিয়ে বিভিন্ন ব্যাঙ্গাত্মক পোস্টার উপস্থাপন করেন।

প্রক্টরের পদত্যাগের দাবির বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের একজন মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিতিশীল হওয়ার জন্য দায়ী প্রক্টর। এই পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে তার প্রেক্ষিতে কোন ব্যবস্থাই নেননি তিনি। আমরা প্রক্টরের উপর আস্থা রাখতে পারছি না। তাই তার পদত্যাগ চাই।’ বহিরাগতের হাতে মার খেয়ে লিখিত অভিযোগ কেন দেননি এমন প্রশ্নে মারধরের শিকার হওয়া এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা প্রক্টরের উপর আস্থা হারিয়েছি। তাই লিখিত অভিযোগ দেইনি।’

তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, মারধরের ঘটনা শোনার অল্প সময়ের মধ্যেই প্রক্টরিয়াল বডি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। তখন নেতাকর্মীরা প্রক্টরের পদত্যাগসহ প্রক্টর বিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। পরবর্তীতে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করলে সেখানেও প্রক্টর উপস্থিত ছিলেন।

প্রক্টরিয়াল বডির একজন কাজী এম. আনিছুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান প্রক্টরের নেতৃত্বে প্রক্টরিয়াল বডি আগের তুলনায় অনেক এক্টিভ। যেকোনো সময় শিক্ষার্থীদের বিপদে আমরা ছুটে যাচ্ছি। প্রক্টরের ব্যাপারে যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’ 

একজন প্রাক্তন সহকারী প্রক্টর বলেন, ‘আগের প্রক্টরকে বিলুপ্ত কমিটির নেতা ইলিয়াস নিজের ইচ্ছেমত চালিয়েছে, তার মাধ্যমে নানা সুবিধা নিয়েছে, ক্যাম্পাসে নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রেখেছে। নতুন প্রক্টর নিয়ম অনুযায়ী ক্যাম্পাস চালাচ্ছেন। তার সাথে সে কিংবা তার নেতাকর্মীরা আঁতাতে যেতে পারছে না বলেই তার বিরুদ্ধে লেগেছে।’

এ বিষয়ে প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা এই ঘটনায় মামলা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মামলার জন্য শিক্ষার্থীদের একটি লিখিত লাগে। তারা তা দেয়নি। পরে জানলাম শিক্ষার্থীদের পক্ষে থেকে একটি মামলা করা হয়েছে। আমরা হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করতে সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রাখছি।’ অভিযোগের তীর প্রসঙ্গে ওমর সিদ্দিকী বলেন, ‘বিভিন্ন সময় নিয়োগসহ টেন্ডারের দাবী নিয়ে এসেছিল তারা। কিন্তু আমরা বাধা দেওয়ায় এই মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ করছে।’

সাহস২৪.কম/এএম.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত