ইউরোপের স্বপ্ন, শিক্ষার্থীদেরও জীবন হচ্ছে বিপন্ন

প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১৬:৫৭

নুর উদ্দিন, সুনামগঞ্জ

ফ্রান্স, ইতালী, গ্রিস, তুর্কিসহ ইউরোপ ও মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অভিবাসনের জন্য পায়ে হেঁটে বা জলপথে যেতে গিয়ে জীবন বিপন্ন হচ্ছে সুনামগঞ্জের যুবক ও শিক্ষার্থীদেরও। গেল চার মাসে এভাবে ঝুঁকি নিয়ে স্বপ্নের দেশে উপার্জনের জন্য যেতে গিয়ে দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ৯ জানুয়ারি তুর্কি সীমান্তে পাহাড়ের উপর বরফের নীচে চাপা পড়ে শান্তিগঞ্জের এক কলেজ ছাত্রের মৃত্যু ঘটেছে। পরের দিন সন্ধ্যায় এই মর্মান্তিক ঘটনার খবর বাড়ি পৌঁছালে পরিবারের সদস্যদের কান্নায় শান্তিগঞ্জের ঠাকুরভোগ গ্রামে হৃদয় বিদারক পরিবেশ তৈরি হয়। নিহত শিক্ষার্থী তানিল আহমদের মা সেলিনা বেগম ছেলের এমন মৃত্যু সইতে না পেরে বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন।

স্থানীয়রা জানান, ঠাকুরভোগ গ্রামের মৃত গিয়াস উদ্দিনের চার ছেলের মধ্যে বড় ছেলে তানিল আহমদ। সে দিরাই কলেজের বিবিএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিল। এলাকায় কৃতি ফুটবলার হিসাবে পরিচিতি ছিল তার। এলাকার প্রাণোচ্ছল এই তরুণ সংসারের দারিদ্রতা ঘুচানোর স্বপ্ন নিয়ে গেল নভেম্বর মাসে দুবাই যায়। গ্রামের ছেলে ইরান প্রবাসী দালাল শাহিন মিয়ার প্ররোচনায় পড়ে তুর্কি যাবার উদ্দেশে গেল সপ্তাহে ইরান যায়। ওখান থেকে পাহাড়ের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটেই তুর্কির উদ্দেশে রওয়ানা দেয় তানিল। এরপর কয়েকদিন নিখোঁজ ছিল সে। তুর্কিতে থাকা তানিমের বন্ধু একই এলাকার ঠাইলা গ্রামের বাসিন্দা মাসুম আহমদ দেশে থাকা স্বজনদের জানায়, তানিম পাহাড়ে ঠান্ডায় মারা গেছে।

তানিমের আত্মীয় মঈনুল আহমদ জানান, তানিমসহ বেশ কিছু লোক পাহাড়ের উপর দিয়ে তুর্কি যেতে রওয়ানা দিয়েছিল। পথে ঠান্ডায় মারা যায় সে। ওখানকার সীমান্ত পাড় হতে না পেরে ফেরার সময় তার সঙ্গে থাকা অন্যরা তার মৃতদেহের ছবি তুলে আনে। তানিমের লাশ দেশে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের শ্রীধরপাশার কলেজ ছাত্র একুয়ান ইসলামের লাশ লিবিয়া থেকে দেশে আসে। গত বছরের ১৩ এপ্রিল লিবিয়া প্রবাসী দালাল আলী হোসেনের সঙ্গে সাত লাখ টাকা চুক্তিতে লিবিয়ায় যান শ্রীধরপাশা গ্রামের তরিকুল ইসলামের ছেলে কলেজছাত্র একুয়ান ইসলাম। সেখানে পৌঁছার পর দালাল চক্র তাকে আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালায়। একুয়ানকে বাঁচাতে দালাল চক্র তার পরিবারের কাছে আরও টাকা চায়।

ছেলেকে বাঁচাতে ২৩ এপ্রিল একুয়ানের বাবা আরও সাত লাখ টাকা পাঠান দেশে থাকা আলী হোসেনের বাবা আবুল মিয়া ও মা আছমা বেগমের মাধ্যমে। গেল বছরের ১৫ জুন আরও ৫ লাখ টাকা দিয়ে একুয়ানকে ইতালিতে পাঠানোর চুক্তি হয় তাদের সঙ্গে। ১৬ জুন খবর আসে, একুয়ান মারা গেছেন। পরে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ২৯ সেপ্টেম্বর একুয়ানের লাশ দেশে আনা হয়। সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর ৩ অক্টোবর একুয়ানের বাবা তরিকুল ইসলাম বাদী হয়ে জগন্নাথপুর থানায় মামলা করেন। এরপর হবিগঞ্জ জেলা সদরের বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন মোহনপুর এলাকা থেকে আলী হোসেনের বাবা আবুল মিয়া ও মা আছমা বেগমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

শিক্ষার্থী ও তরুণদের ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দেবার লোভনীয় কথা বলে বিপদে ফেলছে লিবিয়া, ইরান ও তুকির্তে থাকা সুনামগঞ্জের কিছু দালালচক্র। এদের সহযোগিতা করে তাদের এদেশে থাকা স্বজনরা। ঠাকুরভোগের তরুণের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় পুরো এলাকার মানুষ দালালের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন জানালেন পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লুৎফুর রহমান জায়গীরদার খোকন। তিনি বলেন, ইউরোপ পাঠানোর কথা বলে অনেক প্রতিভাবান তরুণের জীবন বিপন্ন হচ্ছে।

সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রিপন কুমার মোদক বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে, ছোট ছোট নৌযানে সাগর পাড়ি দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীরা জীবন বিপন্ন করছে। এসব বিষয়ে পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। ওপেন হাউস ডে, উঠোন বৈঠকে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে।

সাহস২৪.কম/এএম.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত