বিল শুকিয়ে মাছ ধরায় মাছের বংশ সমূলে ধ্বংস

প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১৭:০৯

নুর উদ্দিন, সুনামগঞ্জ

সুনামগঞ্জের হাওরজুড়ে বিল শুকিয়ে মাছ ধরার মহোৎসব শুরু হয়েছে। তাতে বোরো চাষের কৃষকরা পড়ছেন মহা সংকটে। সমূলে মাছের বংশ হচ্ছে ধ্বংস। বেপরোয়া কিছু মৎস্যজীবী ও ইজারাদাকে ঠেকানোরও যেন কেউ নেই।

জেলার শান্তিগঞ্জের পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের বিশাল দক্ষিণের হাওর এবং সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কালিপুর ও মল্লিকপুরের মাঝামাঝি হাওর (পুকুর ডুবি বড় নালা চান্দি) শুকিয়ে মাছ ধরায়  বিপাকে পড়েছেন হাজার হাজার কৃষক। এসব এলাকার বোরো কৃষকরা হা-হুতাশ করেই সময় পার করছেন।

সরেজমিনে গেলে কৃষকরা বিলাপ করে বলছিলেন, জমিনো (জমিতে) একফোঁটা পানি নাই। আগন (অগ্রহায়ণ) মাসে চৈত (চৈত্র) মাসের অবস্থা। জমিন (জমি) পাইট্টা (ফেটে) হাকরি (চৌচির) দিছে। কৃষকরা জানালেন, বাঁধ কেটে মৎস্য নিধন করতে গিয়ে পানি ছেড়ে দেওয়ার কারণে হাওরের হাজারো কৃষকদের এমন সর্বনাশ হয়েছে।

ভাঙা ছেড়ে দেওয়ায় কারণে চাষাবাদের আগেই পানি শুকিয়ে যাওয়ায় শান্তিগঞ্জের পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের বিশাল দক্ষিণের হাওরের প্রায় ১৫শ একর জমি শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে।

কৃষকরা জানালেন, এই জমি চাষাবাদ করতে হলে খরচ হবে দ্বিগুণেরও বেশি। জমির মালিকদের কাছ থেকে চুক্তিভিত্তিতে (রং-জমায়) জমি এনে ইতোমধ্যে একর প্রতি পাঁচ-ছয় হাজার টাকা খরচ করেছেন কৃষকরা। এখন জমিতে পানি নেই। এই অবস্থায় দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে হাজারো কৃষকের।

হাওরপাড়ের শত্রুমর্দন গ্রামের বর্গাচাষী ষাটোর্ধ্ব হিরা দেব নাথ বলছিলেন, ইবার (এবার) আনা খাইয়া (না খেয়ে) মরা লাগবো। জমিনে পানি নাই, কিলা চাষাবাদ করমু। একই গ্রামের অপর কৃষক রনজিত পাল বললেন, নিজের আছে মাত্র দেড় কেয়ার (৪৫ শতক) জমি। প্রত্যেক বছর ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সাত আট একর জমি বর্গা চাষ করেন। মাস খানেক আগে দুটি ব্যাংক থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ তুলেছেন। এই টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচও করে ফেলছেন। হাওরের পানি নেমে যাওয়ায় তার সকল জমি ফেটে চৌচির।

কৃষকরা বললেন, পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের প্রভাবশালী আইয়ুব উদ্দিন বুদ্ধি, আফিজুর রহমান, নূরুল ইসলাম ওরফে ছুলুক মিয়া মিলে প্রতি বছরই পিঁপড়াকান্দি সড়কের পাশের খাল নিলামে ডাক দেন। সব সময়ই তারা অগ্রিম পানি সেচে মৎস্য আরোহণের চেষ্টা করেছেন। সাধারণ কৃষকদের বাধার মুখে অন্যবছর তারা তা করতে পারেননি। এবছর এলাকার আবদুস সামাদ কাচা মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে হাওরের সব পানি ছেড়ে দিয়েছে তারা। এ কারণে তিন ইউনিয়নের হাজারো কৃষকের ১৫শ একর জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। পানি না থাকায় এ বছর অনাবাদি থাকবে এসব জমি। যেখানে প্রায় দুই হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হতো। অভিযুক্তদের উপযুক্ত শাস্তি, তদন্তের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ ও স্থায়ীভাবে পিঁপড়াকান্দি সড়কের পাশের খাল ও আশপাশের ডুবা নিলাম বন্ধের দাবি করেন কৃষকরা।

পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি ও শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার উজ্ জামানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন কৃষকরা। অভিযুক্ত আইয়ুব উদ্দিন, আফিজুর রহমান বলেন, আমাদের উপর আনিত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। এমনিতেই এবছর বিভিন্ন হাওরে পানি কম। তাছাড়া দক্ষিণের হাওরে আগুন খাড়ার দাঁড়াসহ আরো চারটি ভাঙা আছে, যে খাল আমরা নিলামে ডাক দিয়েছি তা দিয়ে পিঁপড়াকান্দি সড়কের কালভার্ট ও হাওরের বাঁধ সব সময় সংস্কার করি। আমরা বাঁধ দিয়ে কোনো পানি ছেড়ে দেই নি। রাজনৈতিকভাবে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে আমাদের উপর এমন অভিযোগ আনা হয়েছে।

ইজারাদারদের কাছ থেকে সাব লিজ গ্রহিতা আবদুস সামাদ ওরফে কাচা মিয়া বললেন, প্রতি বছরই হাওরে নির্দিষ্ট পরিমাণে পানি রাখা হয়। এবছরও রেখেছি। মূলত হাওরে আরো তিন-চারটি বাঁধ আছে, সেদিকে পানি নেমে গেছে। আমাদের উপর আনা অভিযোগ সত্য নয়।

শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার উজ্ জামান বললেন, এই বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছি। তিনি হাওর, বাঁধ, খালসহ সব জমি পরিদর্শন করে আমাকে জানাবেন। তদন্ত মোতাবেক অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাহস২৪.কম/এএম.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত