‘ধর্মীয় উত্তেজনা-উন্মাদনা ছড়িয়ে তারা জঙ্গিবাদকেই প্রসারিত করতে চায়’

প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২৩:০১

ধর্মীয় উত্তেজন-উন্মাদনা ছড়িয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীরা জঙ্গিবাদকেই প্রসারিত করতে চায় বলে মন্তব্য করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার। ঝুমন দাসের জামিনের পর থেকে তার বাড়িতে নিরাপত্তাজনিত কারনে পুলিশের পাহাড়ার বিষয়ে সাহস২৪ এর সাথে আলাপকালে এমন মন্তব্য করেন তিনি।

ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অভিযোগ তুলে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের সমালোচনায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ঝুমন দাসের নামে। চলতি মাসের ২৩ তারিখ ১৯১ দিন পর সিলেট এলাকার বাইরে না যাওয়ার শর্তে জামিন পান তিনি। স্থানীয়রা জানান, জামিন পাওয়ার পর থেকেই ঝুমন দাসের বাড়িতে প্রতিনিয়ত টহল দিচ্ছে শাল্লা থানা পুলিশের একটি বাহিনী।

রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সাধারণ জনগণের জান মালের নিরাপত্তায় বাড়ি বাড়ি পুলিশি টহল আদৌ নিরাপত্তাজনিত সংকট মোকাবেলায় কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করবে তা নিয়ে সন্দিহান দেশের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। এই ঘটনার জের ধরে দেশে জঙ্গিবাদ এবং তার মদদদাতাদের চড়াও হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

দেশের অন্যতম একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার। জঙ্গিবাদ নির্মূল ও এ সংক্রান্ত সংকট নিরসনে কাজ করছেন তিনি। ঝুমন দাসের বিষয়টি নিয়ে সাহস২৪ এর মুখোমুখি হয়েছেন মোহাম্মদ আলী শিকদার।

প্রশ্ন সাহস২৪: ঝুমন দাসের জামিনের পরদিন থেকেই নিরাপত্তাকে এই রাষ্ট্রের একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক হয়ে আপনি কীভাবে দেখছেন?

উত্তর: বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের উৎপত্তির জায়গাটার মূল হলো ধর্মীয় অন্ধত্ব এবং উগ্রবাদ। সেখান থেকেই জঙ্গিবাদের উৎপত্তি। ধর্মীয় অন্ধত্ববাদ, উগ্রবাদ এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার এই সমস্ত মাধ্যমেই কিন্তু জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে বাংলাদেশে। এই ঝুমন দাসের বিষয়টি নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। এই যে মামুনুল হক এবং হেফাজতে ইসলাম সুনামগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ চালিয়েছিলো তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করেছিলো। সুতরাং তারা ধর্মীয় উত্তেজনা-উন্মাদনা ছড়িয়ে তারা জঙ্গিবাদকেই প্রসারিত করতে চায়। উৎসাহিত করতে চায়।

তার (ঝুমন) যে পোস্ট (ফেসবুক স্টেটাস) ছিলো সেটাতো কোনও অপরাধ নয়। পত্র পত্রিকায় এর থেকে কঠিন লেখাও লেখা হচ্ছে। যেকোনও বিষয়ে একজন দ্বিমত পোষণ করে অন্য কারও বক্তব্য খণ্ডন করে তার বক্তব্য যাতে মানুষ না শোনে, প্রভাবিত না হয়। এ তো একেবারে স্বাভাবিক একটি বিষয়। গণতন্ত্র কি! চরম স্বৈরাচারী দেশেও এ কোনও সমস্যা না।

এই যে হেফাজত বা জামাত বলেন এই উগ্রবাদী গোষ্ঠী। তারা একটা 'ওসিলা' (উপলক্ষ) খোঁজে। সুতরাং তারা এটাকে ভিন্নভাবে 'কালারিং' করে প্রচার করে মানুষকে উত্তেজিত করেছে। পরে এই হিন্দু পুরো সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। সুতরাং এটি অত্যন্ত নেক্কারজনক ঘটনা। এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্য এটি কলঙ্কজনক। আমরা এইজন্য মুক্তিযুদ্ধ করিনি। দেশে এইটুকু মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি না থাকে এবং করলেই যদি তার উপর আক্রমণ হয়; তাহলে দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে?

এই যে ঝুমন দাসের উপর মামলা হলো। প্রায় ৭-৮ মাস জেলে থাকতে হলো। জেল তো মানুষের একটা দুঃসহ জীবন। সে জীবনটাও ঝুমন কাটালো। তারপরে ভিত্তিহীন এ মামলায় আটকে রাখার যুক্তি নাই দেখে তাকে হাইকোর্ট থেকে জামিন দেওয়া হলো। এখন সে বাড়িতে যাবে। বাড়িতে গেলে তার নিরাপত্তা নেই। এরকমই একটি ধারণা পাওয়া যাচ্ছে পুলিশের তৎপরতা এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড দেখে। এই যদি হয় আমাদের রাষ্ট্রীয় মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। তাহলে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক, বেদনাদায়ক এবং অগ্রহণযোগ্য। সুতরাং আজকে এই ধর্মান্ধ উগ্রবাদী এই গোষ্ঠীর যে উত্থান এবং বিস্তার ঘটেছে এটি যদি আমরা রোধ করতে না পারি তাহলে কিন্তু আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম সেই বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত কঠিন কাজ হবে।

বাংলাদেশের মানুষকে এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনকে (ঝুমন দাসের বাড়ি পাহাড়া যদি দেওয়ার প্রয়োজন হয়, হুমকি থাকে সেটি আরেকটি বিষয়) যেখান থেকে হুমকিটা আসছে, নিশ্চই তারা জানে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা আছে পুলিশ আছে- হুমকিটা কারা দেয়, কোথায় থেকে আসে? তাহলে সেই হুমকিদাতাদের কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না? কতদিন পর্যন্ত এবং কত ঝুমন দাসকে তারা পাহাড়া দিবে। এটাতো অসম্ভব কাজ। অবাস্তবও। 

তাহলে বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার জায়গাটি কোথায় দাঁড়াচ্ছে। সেই জায়গা থেকে আমাদের যদি বাচতে হয়। তাহলে এই উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। এখন এটা এই যে এত বছর ধরে যাত্রাটাতো হঠাৎ করে বা একদিনে হয়নি। সেটা শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ধীরে ধীরে তারা বিস্তার করে সারাদেশে একটা শক্তি দেখানোর জায়গায় চলে আসছে। এখন পুলিশরা তাদেরকে গ্রেফতার না করে ভিক্টিমদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করে।

সাহস২৪: ধর্মীয় উষ্কানিতে একটা সম্প্রদায়ের উপর চড়াও হওয়া এর সাথে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মদদে মামলা হওয়া এবং এমন হেনস্তার বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই?

উত্তর: রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রকে এই ঘটনায় নির্জীব এবং নির্লিপ্ত দেখেছি আমরা। সুনামগঞ্জের ঘটনায়ও দেখেছি। তারপরেও গত মার্চ মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায়ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন নির্লিপ্ত এবং ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে 'রোগী মারা যাওয়ার পরে ডাক্তার আসার ঘটনার' মত পরিস্থিতিও কিন্তু আমরা দেখেছি। এখান থেকে মুক্তি পেতে হলে এই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহীনির সর্বোচ্চো ব্যবস্থাটাই নিতে হবে। এর কোনও বিকল্প আপাতত নেই। কিন্তু বাংলাদেশের সমগ্র মানুষের মধ্যে কিন্তু এই উপলব্ধিটা থাকতে হবে।

সাহস২৪: ঝুমন দাসসহ আরও যারা এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আছেন। কিংবা সংখ্যালঘু নির্যাতন বা ধর্মীয় উগ্রবাদীতার এই 'প্র্যাক্টিস' থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর: এক নম্বর পদক্ষেপ হলো, আইনের প্রয়োগ। আইনের মাধ্যমে বিচারটা ত্বরান্বিত করতে হবে। যথোপোযুক্ত শাস্তি তাদেরকে দিতে হবে। তারা অপরাধী। সেইটা কিন্তু একেবারেই অনুপস্থিত। ২০১২ সালে চট্টগ্রামের রামু বোদ্ধ মন্দিরে যে ঘটনা ঘটলো। ওলমোস্ট সিমিলার। সে ঘটনায় প্রকৃত যারা দোষী ছিলো তাদেরকে কি বিচারের আওতায় আনা হয়েছে? শাস্তি হয়েছে? দুই-পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছিলো। কেউ হয়তো জামিন পেয়েছে। 

কেউ হয়তো পায়নি। ২০১২ সাল থেকে আজকে ৯ বছরে এত বড় অপরাধের কোনও বিচার হলো না। সে বিচার কবে হবে কেউ জানে না। তার পরে রংপুরের দিকে মন্দির ভাঙচুর সেগুলোরও বিচার হয়নি। এছাড়া বহু বহু ঘটনা আছে যার কোনও বিচার হয়নি।

সারাবিশ্বের স্বীকৃত কনভেনশন, অপরাধ করলে তার দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। যাতে করে অন্যান্য অপরাধীরা ভবিষ্যতে এমন অপরাধ করতে গেলে দুইবার ভাবতে হয়। যে এই অপরাধ করলে রক্ষা পাওয়া যাবেনা। এখন এই অপরাধ করলে যদি প্রধম দুইজন পাঁচজনকে গ্রেফতার করলো, কাউকে করলোনা। একটা তদন্ত চলছে তদন্তও শেষ হয়না। চার্জশীটও হয়না। সে চার্জশীট আদালতে গেলে দশ-বারো-বিশ বছরেও শেষ হয়না। 

এই যদি হয়, তাহলে কীভাবে কি করবেন! এর তো শর্টকাট কোনও রাস্তা নেই। এটা করতে হবে আইনের মাধ্যমে, আইনের উপর ভিত্তি করে, আইনানুগভাবেই এর দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

আর দ্বিতীয় যেটা হচ্ছে, আমরা দেখেছি বিগত সময়ের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের ভেতরে কিছু লোকজন আছে তাদের মধ্যেই ধর্মীয় উন্মাদনা কাজ করে। তারা কিন্তু পরোক্ষভাবে কখনও প্রত্যক্ষ্যভাবে এইসব অপকর্মের সাথে জড়িত হয়। যেটা ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুর ঘটনায় আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছিলাম। তখনকার যে থানার ওসি প্রত্যক্ষভাবে মানুষদের জড়ো করে, বক্তৃতা করে বোদ্ধ উপাসনালয়ে ভাঙচুর করেছিল। ওসির কিন্তু চাকরীও যায়নি। সুতরাং এই রকম যদি চলে 'স্কট ফ্রি'। তাহলে এর কোনও প্রতিকার নাই। প্রশাসনতো ধর্ম নিয়ে চললে হবে না। প্রশাসনকে তো রাষ্ট্রের আইনানুসারে চলতে হবে। রাষ্ট্রের তো আইন কানুন আছে। আইনানুসারেতো এইসব গুরুতর অপরাধ। সেটাতো হচ্ছে না। বিচার যারা করবেন সেই ব্যক্তিবর্গ আদালত, পিপি, উকিল, পুলিশ তদন্ত কর্মকর্তা কোনও জায়গায়ই তো কাজটা হচ্ছে না। সেখানে মনিটরিংয়ের কোনও ব্যবস্থাও তো আমরা দেখছিনা। সেটা করতে হবে। এর শর্টকাট রাস্তা নাই। আপনি গুলি করে মানুষকে মেরে ফেলতে পারেন না। এটা একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। 

আমাদের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এই ধর্মান্ধ উগ্রবাদীতার বিস্তারে যেনও তারা না যায়। এলাকায় এলাকায় যেনও ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ সমাজের মধ্যে গড়ে উঠে সেটা রাষ্ট্র থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। সচেতন নাগরিকদেরও এদিকে এগিয়ে আসতে হবে।

সাহস২৪.কম/এসটি/এসকে.

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত