ঝুমন দাসের কারাবন্দীত্বের ১৪০ দিন

পঞ্চম বারের মত জামিন নাকচ

প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০২১, ১৫:৩০ | আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২১, ১৫:৪১

পঞ্চম বারের মত জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে ঝুমন দাসের। ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অভিযোগ তুলে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের সমালোচনায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয় সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ঝুমন দাসের নামে। আজকে ১৪০ দিন কারাবন্দী ঝুমন দাস। বার বার হাকিম এবং জেলা জজ আদালতে আবেদন করলেও নাকচ করে দিচ্ছেন আদালত।

আজ মঙ্গলবার তার জামিন নাকচ করেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ওয়াহিদুজ্জামান শিকদার।

বিষয়টি সাহস২৪কে নিশ্চিত করেছেন ঝুমন দাসের আইনজীবী দেবাংশু শেখর দাস।

আইনজীবী বলেন, 'আজকে (৩ আগস্ট) আবারও ঝুমন দাসের জামিন নাকচ করেছেন আদালত। ৫ আগস্ট কোর্ট খুললে আবার কোর্ট মিসকেস করে নতুন করে আবেদন করবো।'

এ বিষয়ে ঝুমন দাসের বড় ভাই নুপুর দাস বলেন, 'এবারও আবারও ঝুমনের জামিন হলো না। আমার ভাইটা আজ চার মাস থেকে জেলে বন্দি। ভাইকে ভয়ঙ্কর ওই কারাগারে রেখে আমরা কীভাবে শান্তিতে থাকতে পারি! রাষ্ট্র কেন আমাদের সাথে এমনটা করছে? আমরা কী অধিকার নেই নূন্যতম নাগরিক সুবিধার!'

আদালত সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার ভার্চুয়াল আদালতে ঝুমনের জামিন আবেদনের শুনানিকালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সামসুল আবেদিন আপত্তি জানান। তিনি বলেন, উচ্চ আদালত থেকে জামিন নাকচ হয়েছে। তাই এই আদালতে জামিন দেয়া ঠিক হবে না।

গত রোববার(১ আগস্ট) জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ঝুমন দাসের জামিন শুনানির দিন ঠিক করা থাকলেও বিচারক ওয়াহিদুজ্জামান শিকদার উপস্থিত না থাকায় শুনানির দিন পিছিয়ে মঙ্গলবার করা হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় প্রায় সাড়ে চার মাস ধরে কারাবন্দি ঝুমন। আটকের পর ঝুমনকে প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। 

পরে তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা। এই মামলায় হাকিম আদালত এবং জেলা জজ আদালতে বারবার জামিন আবেদন করেও মেলেনি কোনও আলোর দিশা। সর্বশেষ ১৬ মে ঝুমন দাসের জামিন আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয় সুনামগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। আদেশ কিম্বা কোনও নির্ধারণ করা হয়নি কোনও তারিখও। জজ কোর্ট থেকে কোনও আদেশ না পাওয়ায় ঝুমনের পরিবার যেতে পারছে না উচ্চ আদালতে।

প্রসঙ্গত, সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে চলতি বছরের মার্চের ১৫ তারিখ শানে রিসালত সম্মেলন নামে একটি সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। এতে বক্তব্য রাখেন হেফাজতের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে এর আগেই সমালোচনায় ছিলেন মামুনুল হক। দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। এ অবস্থায় দিরাইয়ের সমাবেশে এসে সরকারবিরোধী বক্তব্য দেন মামুনুল।

মামুনুল হকের সমালোচনা করে এই সমাবেশের পরদিন ১৬ মার্চ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন দিরাইয়ের পার্শ্ববর্তী উপজেলা শাল্লার নোয়াগাঁওয়ের যুবক ঝুমন দাস আপন। স্ট্যাটাসে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ আনেন মামুনুলের বিরুদ্ধে।

ঝুমনের এমন স্ট্যাটাসে ক্ষেপে যান হেফাজত ও মামুনুলের স্থানীয়া অনুসারীরা। মামুনুলের নামে সমালোচনাকে ইসলামের সমালোচনা ও অবমাননা বলে চালাতে থাকেন এলাকায় প্রচারণা। এতে এলাকাজুড়ে দেখা দেয় তুমুল উত্তেজনা।

বিষয়টি বুঝতে পেরে গ্রামের বাসিন্দারা ১৬ মার্চ রাতে পুলিশের হাতে তুলে দেন ঝুমন দাসকে। হেফাজতে ইসলামসহ স্থানীয় মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে ওই রাতেই স্থানীয় বাজারে বৈঠক করে প্রশাসন। এ সময় আটকের খবর জানিয়ে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে শান্ত থাকার আশ্বাস দেন উপস্থিত সবাই।

কিন্তু সারা দেশ যখন উৎসব উদযাপনে ব্যস্ত ঠিক ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সকালে কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে হামলা চালায় নোয়াগাঁও গ্রামে। লুটপাট ও ভাঙচুর চালায় ঝুমন দাসের বাড়িসহ হাওরপাড়ের হিন্দু গ্রামটির প্রায় ৯০টি বাড়ি ও মন্দিরে।

শাল্লার এই তাণ্ডবে অভিযোগ ওঠে- পুলিশ আগে থেকে আভাস পেয়েও কোনও ব্যবস্থা নেয় নি। এই গাফিলতির অভিযোগের ঘটনার তদন্তে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিনকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ সদর দপ্তরে ২৬ এপ্রিল তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেয় এই কমিটি।

প্রতিবেদনে হামলার ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ সুপারসহ (এসপি) ১১ জনকে বদলি এবং ৬ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

নোয়াগাঁও গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র দাস একটি নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঝুমন কোনো ধর্ম, রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী বক্তব্য দেয়নি। সে একজন ব্যক্তির সমালোচনা করেছে। এ কারণে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে জেলে রাখা অযৌক্তিক। আমরা তার মুক্তি চাই এবং যারা আমাদের গ্রামে হামলা ও লুটপাট করেছিল সবার গ্রেপ্তার চাই।’

ঝুমন দাসের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লেখালেখি করছেন অনেকেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে মানুষটা ধর্মীয় সম্প্রীতির পক্ষে কথা বলছে তাকে এভাবে হেনস্তার বিষয়টা আসলেই দুঃখজনক। এই মামুনুলদের মত ধর্ম ব্যবসায়ীরা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে আসছে। 

সেখান থেকে ঝুমন দাসদের মত যুবকরা ধর্মের নামে এসব সাম্প্রদায়ীক সমস্যা নিরসনে নিজেদের মত প্রকাশ করছে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে এতটুকু অধিকার ঝুমন দাসদের মত যুবকদের না থাকলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি অচিরেই বিনষ্ট হবে বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক সমাজ।