চলে গেলেন প্রাণ-প্রকৃতির একজন জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া

প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২১, ২৩:১৫

সাহস ডেস্ক

 

প্রখ্যাত প্রাণীবিজ্ঞানী মো. আনিসুজ্জামান খান চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার পথে বাসের মধ্যে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ঘুমের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিল আহমদ।

সোমবার (০৭ জুন) সাউদিয়া পরিবহনের (চট্ট-মেট্রো-ব-১১-১০৩৭) একটি গাড়িতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ফিরছিলেন তিনি।

পুলিশ জানায়, সাউদিয়া পরিবহনের বাসটি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি রেস্টুরেন্টে খাবার বিরতির সময় সুপারভাইজার তাকে ডাকলে তিনি সারা না দিলে পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি শুভ রঞ্জন চাকমা এসব তথ্য নিশ্চিত করে জানান, বিকাল ০৫ টায় বাসের সুপারভাইজারের ফোন পেয়েই সেখানে উপস্থিত হই। পরে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

তিনি আরো জানান, প্রয়াত মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান খানের স্ত্রী ও পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই হস্তান্তর করা হয়।

প্রাণ-প্রকৃতির জন্য নিবেদিত প্রাণ, পরিবেশ রক্ষায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরলস কাজ করে যাওয়া উদ্যমী প্রাণিবিজ্ঞানী মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান খান। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তাঁর বর্তমান কর্মস্থল বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের সহকর্মী ও সুহৃদজনের মধ্যে। প্রিয় সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীর এমন আকষ্মিক মৃত্যু যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে তাদের।

তার মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বাংলাদেশ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জনাব কবির বিন আনোয়ার। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “তার মৃত্যুতে দেশের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো”।

এছাড়া আনিসুজ্জামান খান এর মৃত্যুতে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের কর্মীবৃন্দ এবং প্রাণ-প্রতিবেশ নিয়ে কাজ করে যাওয়া বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা।  

জন্ম
আনিসুজ্জামান খান এর জন্ম ১৯৫৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, পিতা মৃত জোয়াহের আলী এবং মাতা মৃত আয়েসা খাতুন। বড় ভাই ডঃ মোহাম্মদ আলী রেজা খান একজন বিখ্যাত প্রাণীবিজ্ঞানী ও পাখি বিশেষজ্ঞ। মানিকগঞ্জের এই কৃতি সন্তান বেশ কিছু বছর ধরে ঢাকাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক।

শিক্ষা ও কর্মজীবন
আনিসুজ্জামান খান ১৯৭৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) এবং একই বিভাগ থেকে ১৯৭৮ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে জুয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্টোরি কর্তৃক আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। একই বছর মালয়েশিয়াতেও আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণে অংশ নেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন), ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার আয়োজিত কর্মশালা ও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে নিজের জ্ঞান ও সক্ষমতাকে সমৃদ্ধ করেন তিনি।

বিগত ৩০ বছরেরও অধিক সময় ধরে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষায় নিরলস কাজ করে গেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, নিজের দক্ষতা ও পরিশ্রমের জোরে ছাড়িয়ে গেছেন দেশের সীমানাও। ১৯৯০ সাল থেকে অদ্যাবধি ইকোলজিস্ট/বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থা, বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক সহ অন্যান্য দাতা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত দেশের বিভিন্ন জাতীয় প্রকল্পে। সর্বশেষ তিনি দেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

জাতীয় প্রকল্প ছাড়াও তিনি ২০১৫ সাল থেকে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইসাবেলা ফাউন্ডেশন এর চিফ সায়েন্টিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের সাথে যুক্ত থাকা অবস্থায় তিনি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কিছু প্রকল্পে কাজ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-সেন্ট মার্টিনস্‌ দ্বীপে প্রাকৃতিক সম্পদ সমীক্ষা এবং সাগরতলে পরিচ্ছন্নতা অভিযান, সোনাদিয়া দ্বীপের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং রিসার্চ ষ্টেশন, কর্ণফুলী নদীর জীববৈচিত্র্য অনুসন্ধান ও পুনরুদ্ধার, সাঙ্গু-মাতামুহুরি নদীর জীববৈচিত্র্য অনুসন্ধান ও পুনরুদ্ধার, হালদা নদী মৎস্য ও জলজ জীববৈচিত্র্য গবেষণা ও সংরক্ষণ, উপকূলীয় পোল্ডার এলাকায় জরিপ ও গবেষণা, কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরি নদীতীর বনায়ন কার্যক্রম, পার্বত্য চট্টগ্রামের টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে পানির উৎস চিহ্নিতকরণ ও পুনরুজ্জীবন, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে অভিযান ও গবেষণা।

দেশের বাইরে দুবাই মিউনিসিপ্যালিটির পরিবেশ অধিদপ্তরে তিনি দুবাই সরকারের ঊর্ধ্বতন প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইইউসিএন বাংলাদেশ এর জীববৈচিত্র্য কোষে তিনি সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

পেশাগত সনদ ও সদস্যপদ
আনিসুজ্জামান খান তার সামাজিক উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অশোকা ফেলোশিপের আজীবন সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। এছাড়াও পেশাগত দক্ষতার বলে তিনি বহু জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থার উপদেষ্টা ও সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আজীবন সদস্য- বোম্বে ন্যাচারাল হিস্টোরি সোসাইটি, ভারত, আজীবন সদস্য- ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটি অব বাংলাদেশ, সদস্য- আইইউসিএন কমিশন অন ইকোসিস্টেম, উপদেষ্টা-রিভার ফাউন্ডেশন, উপদেষ্টা- সাইভ আওয়ার সি (এসও এস), প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ন্যাচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্ট (ন্যাকম) ইত্যাদি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত