২০ বছরে ৭০ টি বাঘ হত্যা, বাঘ শিকারি ‘বাঘ হাবিব’ আটক

প্রকাশ : ০১ জুন ২০২১, ১৮:৩৯

সাহস ডেস্ক

সুন্দরবনে দুর্ধর্ষ বাঘ শিকারি বাঘ হাবিবকে আটক করেছে পুলিশ। শনিবার (২৯ মে) ভোর রাতে পুলিশের হাতে আটক হন দুর্ধর্ষ এই বাঘ শিকারী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বনবিভাগ ও স্থানীয়দের কাছে বাঘ হাবিব নামেই পরিচিত তিনি। বাঘ শিকার করাই তার নেশা।

বিভিন্ন সূত্রমতে, গত ২০ বছরে কমপক্ষে ৭০টি বাঘ মারা পড়েছে তার হাতে। তার নামে রয়েছে ৯টি বন অপরাধের মামলা। এর মধ্যে তিনটিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। এতোগুলো মামলাও শিকারের নেশা থেকে ফেরাতে পারেনি তাকে। সুন্দরবনে বাঘ হাবিবের প্রবেশ নিষিদ্ধ, তবুও গোপনে ঢুকে একের পর এক শিকার করেন বাঘ-হরিণ-কুমির।

আটক বাঘ হাবিব ওরফে হাবিব তালুকদারের (৫০) বাড়ি বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন মধ্যে সোনাতলা গ্রামে। তারা বাবার নাম কদম আলী তালুকদার। বাঘ হাবিব বর্তমানে বাগেরহাট জেলা কারাগারে বন্দি রয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বাঘ হাবিব দীর্ঘদিন ধরে পলাতক ছিলেন। মাঝেমধ্যে গোপনে বাড়িতে এসে অন্যের ঘরে ঘুমাতেন। শনিবার ভোর রাতে প্রতিবেশী রফিকুলের বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে অবস্থান করছিলেন হাবিব। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে  ঐদিন রাত আড়াইটার দিকে শরণখোলার মধ্য সোনাতলা গ্রামে অভিযান চালিয়ে রফিকুলের বারান্দা থেকে  তাকে আটক করা হয়।

কে এই বাঘ হাবিব
তার বাবা কদম আলী তালুকদার সুন্দরবনের এক সময়ের দুর্ধর্ষ বনদস্যু ছিলেন। ৫ থেকে ৬ বছর আগে মারা যান সাবেক বনদস্যু বাবা। বনের পাশে বাড়ি হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করতেন তারা। সেই থেকে বনের সব এলাকা তার নখদর্পণে। তাছাড়া, বাবা বনদস্যু হওয়ায় জন্মসূত্রেই অপরাধী এই বাঘ শিকারী হাবিব। তার গোটা পরিবারই বন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। বন্যপ্রাণি শিকারের সহযোগী হিসেবে এখন কাজ করেন তার ছেলে হাসান (২০) ও জামাই মিজান (২৫)। তাদের নামেও একাধিক মামলা রয়েছে।

হাবিবের নামে যতো মামলা
তার নামে মামলা রয়েছে মোট ৮টি। গত ২০ বছর ধরে ৭০ টির মতো বাঘ হত্যা করলেও তার নামে বাঘ শিকারের ৩টি এবং হরিণ শিকারের ৫টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৩টিতে রয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। এর পরও তিনি বাঘ-হরিণ শিকার থেকে ফিরতে পারেননি।

বাঘ শিকার করেই চালান বাঘের মামলা
হাবিব এসব মামলা ও গ্রেপ্তারী পরোয়ানা মাথায় নিয়ে নিজের বাড়িতে থাকতেন না। বেশিরভাগ সময় বনেই কাটে তার জীবন। মাঝেমধ্যে রাতে এলাকায় এসে অন্যের বাড়িতে ঘুমাতেন। কোনো মামলাকেই পাত্তা দেন না। এ বছরের ১৯ জানুয়ারি শরণখোলার রাজৈর বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি বাঘের চামড়াসহ গাউস ফকির নামে এক পাচারকারী আটক হয়। ওই চামড়াটিও হবিবের হাতে শিকার হওয়া বাঘের। ওই মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছে। এর চার দিনের মাথায় ২৩ জানুয়ারি একই এলাকা থেকে ১৯টি হরিণের চামড়াসহ দুই পাচারকারীকে আটক করে র‌্যাব। সেখানেও এই শিকারী হাবিব জড়িত। বনের বাঘ, হরিণ, কুমির শিকার করেই এসব মামলা পরিচালনা করেন এই দুর্ধর্ষ হাবিব।

কিভাবে বাঘ-হরিণ-কুমির শিকার করেন হাবিব
ছাগল অথবা মুরগির মাংসের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে বনের যে সব এলাকায় বাঘের বিচরণ সেসব স্থানে রেখে দেওয়া হয় বিষটোপ। বাঘ ওই বিষ মেশানো মাংস খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেক সময় মৃত আবার আহতাবস্থায়ও ধরে তার চামড়া ও কঙ্কাল সংগ্রহ করা হয়। এভাবে বাঘ শিকার করেন তিনি। ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে তার চামড়া সংগ্রহ করে মাংস বিক্রি করে দেন। এছাড়া, ফাঁদ ও মাংসের টোপ দিয়ে কুমির শিকার করে থাকেন।

বনবিভাগ জানায়, হাবিবকে বহু আগে থেকেই সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। কোনো বন অফিস থেকেই তার নামে পাস দেওয়া হয় না। তারপরও গোপনে বনে ঢুকে বন্যপ্রাণি শিকার করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার পরও এই অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন। এর পেছনে একাধিক শক্তিশালী চক্র জড়িত রয়েছে।

সুন্দরবন সুরক্ষায় নিয়োজিত কমিউনিটি প্যাট্রোলিং গ্রুপের (সিপিজি) ভোলা টহল ফাঁড়ি ইউনিটের দলনেতা মো. খলিল জমাদ্দার জানান, সুন্দরবনের বাঘ-হরিণ শিকার করা হাবিবের পেশা। ২০ বছর ধরে এই কাজ করছে সে। তার নামে বহু মামলা রয়েছে। বনের বাঘ-হরিণ শিকার করেই বন মামলা চালায় সে। কোনো বাঁধাই তাকে বাঘ শিকার থেকে ফেরাতে পারেনি। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করে তার ছেলে ও জামাই। হবিবের বাবাও একসময় সুন্দবনের বনদস্যু ছিল। ৫-৬ বছর আগে সে মারা যায়।

সুন্দরবন সহব্যবস্থাপনা কমিটির (সিএমসি) শরণখোলার সহসভাপতি মো. ওয়াদুদ আকন বলেন, হাবিব খুবই ভয়ঙ্কর লোক। তার গোটা পরিবার এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘ বছর ধরে সে বাঘ, হরিণ ও কুমির শিকার করে আসছে। সিএমসির এই নেতা বলেন, এসব বন্যপ্রাণির চামড়া, মাংস ও কঙ্কাল সে কার মাধ্যমে কোথায় বিক্রি করে বা এর পেছনে শক্তি ও অর্থদাতা কারা, এগুলো হাবিরের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিয়ে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ, কুমিরসহ বন্যপ্রাণি নিধন বন্ধ করা যাবে না।

শরণখোলা স্টেশন কর্মকর্তা (এসও) মো. আব্দুল মান্নান বলেন, বাঘ শিকারী হাবিব বনবিভাগ ও পুলিশে কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড। তার নামে বাঘ ও হরিণ শিকারের অপরাধে ৮টি মামলা রয়েছে। এর মধে বনবিভাগের ৭টি এবং পিরোজপুর আদালতে হয়েছে ১টি। এছাড়া, অন্যান্য অপরাধেও বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে বলে শুনেছি।

পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, হাবিব তালুকদার বাঘ হাবিব নামে বনবিভাগের তালিকাভুক্ত অপরাধী। সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে এ পর্যন্ত সে ৭০ টির মতো বাঘ হত্যা করেছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। 

শরণখোলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইদুর রহমান বলেন, বাঘ হাবিবের নামে শরণখোলা থানায় ৩টি ওয়ারেন্ট মুলতবি ছিল। তাকে দীর্ঘদিন ধরে খঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে সোর্সের মাধ্যমে তার অবস্থান সনাক্ত করে আটক করে শনিবার ভোরে তাকে আটক করা হয়।পরে দুপুরে হাবিবকে বাগেরহাট আদালতে প্রেরণ করলে আদালতের বিচারক তাকে জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত