স্বাধীনতার ৫০ বছর: বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি যেভাবে অর্জিত হয়

প্রকাশ | ২৬ মার্চ ২০২১, ১৪:৪৪

বিবিসি বাংলা

দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম আর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হবার পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ছাড়াও তৎকালীন সরকারের সামনে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা।

নানা বাধা-বিপত্তির পরও দেখা যায় স্বাধীন হবার মাত্র চার বছরেরও কম সময়ে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হয়েছিল আর শতাধিক দেশের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল।

১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর ভুটান ও ভারতের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের সূচনা হয়েছিল আর ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্য পদ প্রাপ্তি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

তৎকালীন ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করতে ভিন্ন এক বাস্তবতার মুখোমুখী হতে হয় বাংলাদেশকে। এর অন্যতম একটি কারণ ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশই প্রথম দেশ যেটি কিনা উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়া কোনো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। যে কারণে, বাংলাদেশের সরকারকে স্বাধীন দেশ হিসেবে নিজেকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেন, "তখন নতুন যারা উপনিবেশবাদ থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়, তারা চাচ্ছিলো না যে তাদের থেকে আবার কোনো জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতা পাক। সেখানেতো আমাদের একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ হচ্ছে পুরো জোট নিরপেক্ষ, এশিয়ান আফ্রিকান ব্লক এরা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে শক্ত একটা অবস্থান নিচ্ছিলো"।

বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিরোধিতা-অপপ্রচার ছাড়াও নানা কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকবেলা করতে হয়েছে। ওই সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও সমর্থনকে ঘিরে ভু-রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রকাশ্য হয়ে দেখা দেয়।

বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে একদিকে ভারত অন্যদিকে পাকিস্তানের সমর্থিত দুই ব্লকের বিভক্তি স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন থাকায় ভারত ও সোভিয়েতপন্থী দেশুগুলো শুরুর দিকেই স্বীকৃতি দেয়। বিজয়ের পর পরই ১৯৭২ জানুয়ারি মাসেই পূর্ব জার্মানি, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, মিয়ানমার, নেপাল, সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বীকৃতি দেয়।

শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে দায়িত্ব পালন করা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, "নতুন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়া একটা কঠিন জিনিস। কারণ সবাই মূল্যায়ন করে যে রাষ্ট্রটা যেটা দাবি করছে এদের অতীত কী, বর্তমান কী এবং ভবিষ্যৎ কী হতে পারে। এসবকে মূল্যায়ন করেই কিন্তু তারা স্বীকৃতি দেয়। সে কারণে স্বীকৃতি লাভ করা হলো নিজেদের সফলতার একটা প্রমাণ। সেটা আমরা করতে পেরেছিলাম।"

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাজ্যসহ সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া নেদাল্যান্ডস এবং জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এপ্রিল মাসে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে।

অন্যদিকে পাকিস্তান বাংলাদেশের বিপক্ষে নানা প্রচারণা চালায়। পাকিস্তানের সমর্থনে চীনপন্থী জোট এবং অনেক ইসলামি দেশের স্বীকৃতি আদায়ে বেগ পেতে হয় বাংলাদেশকে।

মওদুদ আহমদ তার 'বাংলাদেশ: শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল' নামক গ্রন্থে পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায় প্রসঙ্গে লিখেছেন, "শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি ভুট্টো নিজের জন্য সুবিধাজনক একটি সময়েই ব্যবহার করেন। তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টির গুরুত্ব সাফল্যজনকভাবে তুলে ধরে এই বলে অব্যাহতভাবে হুমকি প্রদান করতে থাকেন যে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে চীন আবার তার ভেটো অধিকার প্রয়োগ করবে।"

ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্যপদ লাভ এমনকি ইসালমিক দেশগুলোর স্বীকৃতি পাবার ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের ব্যাপক বিরোধীতার মুখে পড়তে হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে শর্ত হিসেবে "সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানের আনুগত্য প্রকাশকারী অবাঙালীদের প্রত্যাবাসনের বিষয়গুলো কূটনৈতিক আলোচনায় প্রাধান্য পায়।

বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো তখন বাংলাদেশ পাকিস্তান কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে কূটনৈতিক চাল এবং লবিং চালিয়ে যায়।

মওদুদ আহমদের লেখায়, "ভুট্টো দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন যে বাংলাদেশ কর্তৃক পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দীদের বিচার করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহৃত না হলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করা হবে না, বাংলাদেশ তথাপি আইন প্রণয়ন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রস্তুতি নিয়ে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি ত্বরান্বিত করার জন্য ভুট্টোর ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগের কৌশলেরই আশ্রয় নেয়।"

তবে শেষ পর্যন্ত ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং একই বছর জাতিসংঘের সদস্য পদ পায় বাংলাদেশ। এ সফলতা অর্জনে ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়। এক্ষেত্রে আলজেরিয়ায় চতুর্থ ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনকেও কাজে লাগায় বাংলাদেশ। এছাড়া পাকিস্তানের লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগদানের পূর্বশর্ত হিসেবেও পাকিস্তানের স্বীকৃতির বিষয়টি নিশ্চিত করে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান বলেন, শীর্ষ নেতৃত্বের আলজেরিয়া এবং পাকিস্তান সফর বেশকিছু ইসলামি দেশের স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

"আলজেরিয়ায় বঙ্গবন্ধু নিজেই গেলেন এবং উনিতো লোকজনকে মুগ্ধ করে ফেলতে পারতেন। ওখানে যখন উনি সবার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা সাক্ষাৎ হলো, তখন তাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে যেরকম মনোভাব ছিল তা পরিবর্তন হতে দেখা গেল। মুসলমান ব্লক থেকেও কিছু কিছু দেশ আমাদের সাপোর্ট দিতে শুরু করলো।"

অন্যদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ আর লড়াই-সংগ্রামের খবর বিশ্বব্যাপী প্রচার হয়েছিল। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই জাতিসংঘ সদনের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের আদর্শ ও মূলনীতিগুলো বিশ্ব দরবারে প্রচার চালায়- বলেন ওই সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা ড. কামাল হোসেন।

"সব প্রগতিশীল রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক করা, তাদের সমর্থন জানানো। যারা আন্দোলন সংগ্রাম করছিল স্বাধীনতার জণ্য তাদেরকে সমর্থন জানানো। যেমন আমরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের জন্ম হয়েছিল। সবাই দেখলো যে আমরা একটা প্রগতিশীল রাষ্ট্র, আমরা জনগণের পক্ষ হয়ে সব জায়গায় ভূমিকা রেখেছি, অতএব সে কারণে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা চারিদিকে বেড়ে গিয়েছিল, তাই আমরা দ্রুত এগুতে পেরেছিলাম।

স্বাধীন দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সবচে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তিকে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই একমাত্র চীন ছাড়া সবগুলো পরাশক্তিকেই বাংলাদেশ নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। প্রথমদিকে দুবার ভেটো দিলেও চীন ১৯৭৪ সালে আর বিরোধিতা করেনি। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে সেবছরই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়েছিলেন প্রধামন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।

যদিও জাতিসংঘের সদস্য পদ পেলেও সৌদি আরব আর চীন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৭৫ এর ১৫ই অগাস্টের হত্যাযজ্ঞের পর।