উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলায় চা উৎপাদন শুরু

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২১, ১৩:৫২ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২১, ১৫:৫৪

অনলাইন ডেস্ক

প্রায় ৬ কোটি কাঁচা চা পাতা থেকে ১ কোটি ২০ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় চলতি মৌসুমে (১ মার্চ) চা উৎপাদন শুরু হয়েছে।

এর আগে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চা কারখানায় চা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে চা পাতা উত্তোলন বন্ধ ছিল। বর্তমানে চা বাগানগুলোতে পাতা কম হওয়ায় দুয়েকটি চা কারখানা চালু হয়েছে, তবে মার্চের মাঝামাঝি থেকে পুরোপুরি সব চা কারখানায় চা উৎপাদন শুরু হবে।

এ বছর প্রায় ৬ কোটি কাঁচা চা পাতা থেকে ১ কোটি ২০ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে চা বোর্ড অফিস জানিয়েছে। চা চাষের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের জেলাসমূহের মানুষের যেমন একদিকে দারিদ্র বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হচ্ছে, তেমনি ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে।

পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ড অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় ১০ হাজার ১৭০ একর জমিতে চা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি নিবন্ধিত ও ১৭টি অনিবন্ধিত চা বাগান এবং ৭ হাজার ৩১০ জন ক্ষুদ্র চা চাষি চা উৎপাদন করছেন। চা উৎপাদন মৌসুমে ৪২টি অকশন (নিলাম) হয়ে থাকে।

পঞ্চগড়ে উৎপাদিত তৈরি চা চায়ের নিলাম বাজারে চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলে অকশন হয়ে থাকে। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত ৩৯ থেকে ৪০টি অকশন সম্পন্ন হয়েছে।

গত চা উৎপাদন মৌসুমে পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় ৮ হাজার ৬৮০ একর জমিতে চা চাষ করা হয়েছিল। ৫ কোটি ১২ লাখ কাঁচা চা পাতা উৎপাদন হয়েছে। পঞ্চগড়ের কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট, মৈত্রী টি কারখানা, নর্থবেঙ্গল সেন্ট্রাল চা কারখানা, করতোয়া চা কারখানা, গ্রীণ কেয়ার চা কারখানা, তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি, বাংলা টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি, ইম্পেরিয়াল টি এস্টেট, স্যালিল্যান্ড টি এস্টেট, মরগেন টি এস্টেট, সাজেদা রফিক টি এস্টেট, নাহিদ টি এস্টেট, ফাবিহা টি এস্টেট, পপুলার টি এস্টেট, গ্রীণ ফিল্ড টি এস্টেট, এমএমটি এস্টেট, উত্তরা গ্রীণ টি এস্টেট, মলি টি এস্টেট ও সবুজ এগ্রো টি এস্টেটসহ ১৮টি চা কারখানায় চা প্রক্রিয়াজাত করে গত বছর ৯৫ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতিতেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদন হয়েছে।

পঞ্চগড়ের মৈত্রী টি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মোজাহিদুল হান্নান নিপুন জানান, তাদের চা কারখানা একটি বৃহৎ কারখানা। বিক্রম ইন্ডিয়া লিমিটেডের এই চা কারখানায় দৈনিক ৮০ হাজার কেজি কাঁচা পাতা প্রয়োজন। এই কারখানায় সর্বনিম্ন ২০ হাজার কেজি কাঁচা চা পাতা প্রয়োজন হয়।

পঞ্চগড় সদরের করতোয়া চা কারখানার নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম, তেঁতুলিয়ার ইম্পেরিয়াল টি এস্টেটের ম্যানেজার মো. মিজানুর রহমান, পঞ্চগড় সদরের স্যালিল্যান্ড টি এস্টেটের ম্যানেজার মো. আব্দুস সালাম বলেন, চা উৎপাদন মৌসুম শুরু হয়েছে। কাঁচা চা পাতার ওপর নির্ভর করে চা কারখানা চালু করা হয়ে থাকে। দুয়েকদিন কাঁচা চা পাতা সংগ্রহ করা হবে। এরপর থেকে কারখানা চালু করা হবে। তবে মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে অধিকাংশ চা কারখানায় চা উৎপাদন শুরু হবে।

তেঁতুলিয়ার গ্রিন কেয়ার চা কারখানার ম্যানেজার মো. মনজুর আলম বলেন, কাঁচা চা পাতা মজুদের কাজ শেষ হলে কারখানা চালু হবে। পাতা সংগ্রহ চলছে। আমার কারখানায় দৈনিক ১০ হাজার কাঁচা চা পাতা থেকে সবোর্চ্চ ৫০ হাজার কেজি কাঁচা চা পাতা প্রয়োজন হয়।

জেমকন গ্রুপের কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের চায়ের বাণিজ্যের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) সৈয়দ শোয়েব আহমেদ জানান, জেমকন গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট পঞ্চগড়ে অর্গানিক চা চাষ করছেন। কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটটি ২০০৩ সালে পঞ্চগড়ে চা বাগান স্থাপন করেন। কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটে চা আবাদের জন্য প্রায় সাড়ে ৪ হাজার একর জমি রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ৫০০ একর জমিতে অর্গানিক চা চাষ করছেন। কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের নিজস্ব চা কারখানাটি তাদের নিজেদের চা বাগানের পাতা দিয়ে অর্গানিক চা তৈরি করে আসছেন। তারা বাইরের চা বাগানের পাতা ক্রয় করেন না। প্রথমে সপ্তাহে একদিন এরপর সপ্তাহে তিন দিন এভাবে চা উৎপাদন শুরু হবে।

তিনি জানান, চায়ের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের হয়ে একমাত্র জেমকন গ্রুপের কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট ব্রান্ডিং করছে। জেমকন গ্রুপের মেড ইন বাংলাদেশের গ্লোবাল ব্রান্ড ‘টিটুলিয়া’ নামে উৎপাদিত অর্গানিক চা ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানে বাজারজাত করা হচ্ছে।

শোয়েব আহমেদ জানান, জেমকন গ্রুপ দেশ, অঞ্চল ও প্রোডাক্ট এই তিনটি ব্রান্ডিং করছে। আন্তর্জাতিক অর্গানিক টি গার্ডেন সার্টিফিকেটসহ ৬টি আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেট রয়েছে।

তৃতীয় চায়ের চা চাষ এলাকা হিসেবে পঞ্চগড়ে চায়ের নিলাম বাজার স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছেন চা চাষি ও চা কারখানা মালিকরা। এখানে নিলাম বাজার করা হলে চায়ের প্রকৃত বাজার সম্পর্কে চা চাষিদের আর কোন সমস্যায় পড়তে হবে না।

পঞ্চগড় সদর উপজেলার আলী আহসান প্রধান নাহিদ, জেলার আটোয়ারী উপজেলার সোনাপাতিলা এলাকার ক্ষুদ্র চা চাষি মতিয়ার রহমান, পঞ্চগড় জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদাত সম্রাট, পঞ্চগড় জেলা স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুল হক খোকন বলেন, পঞ্চগড়ে প্রতিবছর চা চাষ ও চায়ের উৎপাদন বাড়ছে। চায়ের গুনগতমানও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা ১৬ টাকা থেকে ১৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে উৎপাদন খরচের বিবেচনায় চা পাতার মূল্য আরও বাড়ানো প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে পঞ্চগড়ে চায়ের নিলাম বাজার স্থাপন করা হলে চা চাষিরা উপকৃত হবে।

পঞ্চগড়স্থ বাংলাদেশ চা বোর্ড আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, প্রতি বছর পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় চা আবাদি জমির পরিমাণ বাড়ছে। গত বছর ৮ হাজার ৬৮০ একর জমিতে চা আবাদ করা হয়েছিল। এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ১৭০ একর জমি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এবং বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. জহিরুল ইসলামের ব্যবস্থাপনায় ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে পঞ্চগড়সহ উঞ্চরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুলে’ চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে চা আবাদ বিষয়ে চাষিদের মাঠে গিয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে একটি করে এ পর্যন্ত ২৫টি ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সম্পন্ন হয়েছে।

তিনি বলেন, স্বল্পমূল্যে উন্নত জাতের চারা ও আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ করে চা চাষ সম্প্রসারণের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এছাড়া চাষিদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধান দিতে ইতিমধ্যে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপস চালু, পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ে পেস্ট ম্যানেজমেন্ট ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। চা চাষিদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, চাষের নানান রোগবালাই ও পোকা দমনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

ইউএনবি