৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের হানাদার মুক্ত দিবস

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২০, ১৭:২০

সাহস ডেস্ক

সজিব তুষারঃ মৌলভীবাজার জেলা শহর। সিলেট বিভাগের প্রাণকেন্দ্র। নানান চড়াইউৎরাই পেড়িয়ে আজকের এই সবুজ শহর। চা বাগান আর সবুজের সমারোহে আজো যেন ধরে রেখেছে প্রকৃতির রঙ। আজ ০৮ ডিসেম্বর। চিরসবুজ শহরকেও যারা রক্তাক্ত করেছিল সেই পাকিস্তানি হানাদারের কবল থেকে মুক্তি দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মৌলভীবাজার মুক্ত হয়।

২৭ মার্চ সূর্য্য যখন মাথার উপর ঠিক সেই মূহুর্তে শহরের পশ্চিম দিকের কনকপুর থেকে একটি প্রতিরোধ মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসছেন বাংলার দামাল বাহীনি। অপর মিছিলটি আসে শহরের পূর্বদিকের বয়ে চলা মনু নদীর উপরে স্থাপিত চাঁদনীঘাট ব্রিজ হয়ে। হাতে ঝাড়ু, লাঠি- সোঁটা, দা, গাদা বন্ধুক যেন বিশালাকার এক স্ফুলিঙ্গ এগিয়ে আসছে বটবৃক্ষের মত পুঁতে রাখা হানাদার স্কোয়াডের দিকে। অন্য দিকে আগে থেকেই ঘাটি গেড়ে রেখেছিল পাকিস্তানী ফোর্স। আগত ওই মিছিল যেন কোন ভাবেই তারা মানতে পারছেনা। জেলা শহরে ছিলো তাদের ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার। সেই প্রতিরোধ প্রতিরোধের বুকে নির্বিচারে গুলি চালায়। শহীদ হন তারা মিয়া ও মো. জমির। শহীদ মো. উস্তার ও শহীদ সিরাজুল ইসলাম কলমদরকে চাঁদনীঘাট ব্রিজের কাছে প্রদর্শনী করে হত্যা করে পাঞ্জাবী-হায়েনারা।

সারাদিনের কর্মক্লান্তির শেষে মনু নদীর তীর ঘেঁষা সিএন্ডবি'র ইটখোলায় নিরীহ শ্রমিকরা ঘুমিয়ে ছিলো। নরপশুরা সাত শ্রমিককে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে। পরে তাদের শহরের শাহ মোস্তফা সড়কের বেরি লেকের কাছে ফেলে যায়। স্থানীয়রা তাদের একটি কবরে সমাহিত করে।

প্রকৃতির লীলাভূমি শ্রীমঙ্গল উপজেলার বর্তমান বিজিবি ক্যাম্পে ছিল পাক আর্মির ক্যাম্প। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা সুদর্শন, মুকিত, রানু, সমর, শহীদকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাদের লাশের হদিস আজো পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানী বাহীনির হত্যা, নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি কেউই। শহরস্ত পিটিআই ইন্সটিটিউটে তৈরি করে টর্চার সেল।

গণপরিষদ সদস্য আজিজুর রহমান, ব্যেমকেশ ঘোষ টেমা বাবুসহ অনেককে তুলে নিয়ে যায় সিলেট জেলে। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

সম্মুখ যুদ্ধ হয় শমশেরনগর, শেরপুর ও ধলই সীমান্তে। বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডেট মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে শেরপুরে বীরদর্পে লড়াই করেন মুক্তিযোদ্ধারা। পিছু হটে পাকবাহিনী। কারাগার ভেঙ্গে মুক্ত করা হয় আজিজুর রহমানকে।

দেশ স্বাধীন হবার শেষ সময়গুলো মুক্তিযোদ্ধাদের কতটা উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে, তা আমরা কতটাই উপলব্ধি করতে পারি! ২ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে সারা দেশ হানাদারমুক্ত করার একটি ছক তৈরি করা হয়। সে রাতেই মৌলভীবাজারের শমসেরনগর বিমানবন্দর ঘাটি ও চাতলাপুর বিওপিতে হানাদারদের ওপর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথভাবে আক্রমণ শুরু করে। ‘ডু অর ডাই’ এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যার উপর যে দায়িত্ব পড়েছিলো সে অনুযায়ী অগ্রসর হতে থাকে।

ভারত থেকে চাতলাপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে মুক্তিবাহিনী। প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হন মুক্তিযোদ্ধারা। এখানে প্রায় আড়াই’শ মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারান।

ইতিহাস থেকে পরীক্ষিত বাঙ্গালী কী থেমে যাওয়ার জন্যে এ যুদ্ধে নেমেছে! ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী শমসেরগর ঢুকে পড়ে এবং শমসেরনগরকে হানাদারমুক্ত করা হয়। ৪ ডিসেম্বর শমসেরনগরেই অবস্থান করে পরবর্তী কৌশল নির্ধারন করা হয়। সে বিকেলে শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে কালেঙ্গা পাহাড়ে এসে জড়ো হয়। সেখানে বড়টিলা এলাকায় পাকিস্তানিদের সঙ্গে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর প্রায় ১২৮ জন সেনা শহীদ হন। ৫ ডিসেম্বর থেকে হানাদার বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে শুরু করে। ০৭ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার থেকে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

ইতোমধ্যে মৌলভীবাজার মুক্ত হওয়ার খবর গ্রামেগঞ্জে পৌঁছে যায়। যে কোন অনাকাংখিত ঘটনা এড়াতে শহরের প্রবেশ মুখে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। কিন্তু ৮-ডিসেম্বর মানুষের বাঁধ ভাঙ্গা বিজয় উল্লাসের জোয়ার আর ঠেকানো যায়নি। ওই দিন মৌলভীবাজারের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনীর সদস্যরা।

উঁচু টিলার ওপর অবস্থিত মহকুমা মুনসেফ ভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড্ডয়ন করেন গণপরিষদ সদস্য আজিজুর রহমান। বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধারা। শত্রু মুক্ত হয়। বাংলাদেশের মানচিত্রের একটা অংশ পুরোপুরি বাঙালীর হয়। এই ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের স্বাধীনতা দিবস। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সহ নানান সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন নানান আয়োজনে দিবসটি পালন করেন। শহীদদের শ্রদ্ধার্ঘ দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের গান, কবিতা, নাটক পরিবেশন করা হয়।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত