যুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধা কচুয়ার খালেক বালি

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২০, ১৮:১১

নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা প্রস্তুত করা যায়নি৷ প্রত্যেক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটা নতুন সরকার আসে, নতুন করে একটা তালিকা প্রস্তুত করা হয়৷ভুয়া বা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয় বলে বাতিল করা হয় কিছু নাম৷ স্বাধীনতার পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে এই বিতর্ক চলে আসছে৷  তবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই তালিকায় নাম লেখাতে অনেকের তৎপর। সুকৌশলে এই সুবিধা নিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে অংশ্রগ্রহণ  না করেও অনেক অসাধু চক্র। এমনও রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্থানীয় দাঙ্গা হাঙ্গামায় নিহতরাও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় স্থান পেয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। 

সর্বশেষ চলতি বছরের জুনে এক প্রজ্ঞাপনে বিমান বাহিনীর ৮১ ও বিজিবির ১ হাজার ১৩৪ জনসহ মোট ১ হাজার ১৮১ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে৷ নতুন করে ৪১ জেলায় ১ হাজার ২৫৬ জনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে৷ এই অন্তর্ভুক্তি আর বাদ দেওয়াতেও তৈরী হয়েছে নতুন বিতর্ক৷

বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার হাজারাখালী গ্রামের সশস্ত্র বাহিনীর তালিকা ভুক্ত হয়েছেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা খালেক বালী। অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে স্থানীয় ডাকাতদের হাতে নিহত হয়েও গেজেট ভুক্ত হয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায়। তবে এলাকায় এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার পরিবার পরিচিত শহীদ পরিবার হিসেবে।

অনুসন্ধানে  জানা গেছে, মৃত  খালেক বালী ৭১ এর পূর্ববর্তী সময়ে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর খুলনায় পেপার  মিলে সিকিউরিটি গার্ডের চাকুরী করতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রাণ ভয়ে খুলনা থেকে গ্রামে ফিরে আসেন একই গ্রামের বাসিন্দা মোঃ আফছার শিকদার এর সাথে গুড়ের ব্যবসা শুরু করেন। মাস দুয়েক একই সাথে গুড়ের ব্যবসা করার সময়  খালেক বালী এবং মোঃ আফছার শিকদার কচুয়া উপজেলার দৈবজ্ঞাহাটি/ বাধাল বাজার গুড় বিক্রি শেষে বাড়ী ফেরার পথে রাত গভীর হওয়ায় একই উপজেলার রাড়ীপাড়া ইউনিয়নের সাইনবোর্ড সংলগ্ন খালীশাখালীস্থ খালেক বালীর শ্বশুরবাড়ী (শ্বশুর মৃত এন্দে আলী খান) রাত্রী যাপন করেন। দূর্ভাগ্যক্রমে, ঐ রাতে খালেক বালীর শ্বশুরবাড়ী ডাকাতি হয়। খালেক বালী ডাকাতদের চিনে ফেলায় ডাকাতরা তাকে তুলে নিয়ে হত্যা করে তার শ্বশুরবাড়ী এন্দে আলী খানের বাড়ির অদূরে কালভারটের নিচে ফেলে দেয়। ভাগ্যক্রমে মোঃ আফছার শিকদার প্রাণে বেঁচে যান। এরপর মোঃ আফছার শিকদার কিছুদিন পর ভারতে পারি জমান এবং ৪ দিনের ট্রেনিং নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এবং মুক্তিযুদ্ধ শেষে প্রায় তিন মাস পর গ্রামে ফিরে আসেন। খালেক বালি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কোথাও অংশ গ্রহণ করেন নাই বরং ডাকাতদের হাতে নিহত হয়েও সুযোগ সন্ধানী মৃত খালেক বালীর ছেলে বাশার বালী ও তার চাচা শফি বালী (মৃত) সুকৌশলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অর্থের বিনিময়ে খালেক বালীর নামে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর তালিকাভুক্ত করেন। সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর এবং ডাকাতদের হাতে নিহত হয়েও তিনি সশস্ত্র বাহিনীর তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। 

মুক্তিযুদ্ধ না করেও সুকৌশলে নেয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যে সুযোগ সুবিধা বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে তা  ভোগ করছে তার পরিবার। খালেক বালি ডাকাতদের হাতে নিহত হবার পর তিনি রাজাকারের হাতে নিহত হয়েছেন বলেও ব্যাপক প্রচার চালানো হয় তার পরিবারের পক্ষ থেকে। অথচ বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বিশেষ ট্রাইব্যুনালে রাজাকারদের বিচার করলেও খালেক বালিকে কোন রাজাকার ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে তার কোন অভিযোগ দায়ের করেনি পরিবারটি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৎকালীন হাজরাখালীর ইউপি সদস্য এবং খালেক বালীর ভাই সফিউদ্দিন বালী (শফি বালী) অর্থের বিনিময়ে নিতান্তই নিজ ব্যক্তি সুবিধা নিয়ে অত্যন্ত সুকৌশলে পরবর্তীতে খালেক বালীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রচার চালায় এবং পরবর্তীতে সশস্ত্র বাহিনীর তালিকাভুক্ত করে। প্রকৃত পক্ষে, ডাকাতদের হাতে খালেক বালীর মৃত্যু হয়। যা হাজরাখালী গ্রাম, রাড়ীপাড়া ইউনিয়ন তথা কচুয়া উপজেলাব্যাপী অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে। যা অত্র এলাকার ষাটোর্ধ্ব  মানুষ ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধারের সাথে আলাপকালে জানা গেছে। 

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু দিকে  ডাকাতদের হাতে নিহত খালেক বালী একজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রকৃতপক্ষে অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ভূক্তি হয়ে বে-আইনীভাবে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা'দের সব রকম সুবিধা ভোগ করছেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খ্যাত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা মৃত খালেক বালীর ছেলে মোঃ বাশার বালী শহিদ। এতে অত্র এলাকার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মনে চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। 

এলাকাবাসীর একটাই চাওয়া, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার পাক আর গেজেট ভুক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খ্যাত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা মৃত খালেক বালীর মত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে এই সুবিধা যারা নিচ্ছেন তাঁদের কে আইনের আওতায় এনে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

এ বিষয়ে একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হাকিম বালী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তারাই এখন কোণঠাসা। খালেক বালি ৭১ পূর্ববর্তী সময়ে খুলনায় চাকরি করত ৭১ এর শুরুর দিকে গ্রামে এসে গুড়ের ব্যবসা শুরু করে । সম্ভবত এপ্রিল পরবর্তী সময়ে ডাকাতদের হাতে নিহত হবার পূর্ব পর্যন্ত সে গুড়ের ব্যবসা করে গেছে।মৃত্যুর আগে সে কোথাও যুদ্ধ করে নাই। ডাকাতদের হাতে মারা গিয়েও তার ছেলে শহিদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায়। তিনি অসুন্ধান করলে আরও তথ্য পাওয়া যাবে বলে অনুসন্ধান করার আহ্বান জানান। 

একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হানিফ খাঁন জানান, মৃত খালেক বালী তৎকালীন সময়ে ৭১ পূর্ববর্তীতে আর্মিতে চাকরি করতেন পরে আর্মি থেকে চাকরি ছেড়ে খুলনায় পেপার মিলে চাকরি নেন। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে গ্রামে এসে গুঁড়ের ব্যবসা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি গ্রামের কয়েকজন যুবক দের নিয়ে হাজরাখালী গ্রামের স্কুল মাঠে বাশের লাঠি নিয়ে খেলাধুলা করেছে। গুঁড়ের ব্যবসা করে ফেরার পথে সে শ্বশুর বাড়িতে ডাকাতদের হাতে নিহত হয়। তিনি কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হলেন তা আমি নিজেও জানলাম না। আমরা এলাকার যেসব মুক্তিযোদ্ধা আছে তারা কে কোথায় যুদ্ধ করেছি সবাই জানে অথচ খালেক বালি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা তা পরবর্তীতে  আমি জেনেছি।  

হাজরা খালী গ্রামের বাসিন্দা ও মুক্তিযোদ্ধা বাদশা কাজী বলেন, খালেক বালিকে আমি চিনতাম, একজন গুড়ের ব্যবসায়ী হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে সে গুড়ের ব্যবসা করতেন। পরে ডাকাতদের হাতে নিহত হবার খবর পাই। কিন্তু তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা তা পরপর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের যে সুযোগ সুবিধা সরকার দিয়েছে সেই ভাতা নেয়ার সময় আমি জানতে পারি। আমি কোথাও দেখি নাই তিনি যুদ্ধ করেছেন। এদের মত মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে আজ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা। সরকারের কাছে তিনি দাবি করেন সঠিক তদন্ত হলে প্রকৃত সত্য বেড়িয়ে আসবে। 

এ বিষয়ে খালেক বালীর ছেলে বাশার বালী শহীদ বলেন, আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ৯ নম্বর সেক্টরে সে যুদ্ধ করেছেন। হাসেম রাজাকার ও সুলতান ডাকু সহ ২২ জন রাজাকার তার বাবাকে হত্যা করে। সে সময় আবার বাবার বন্ধু আফসার শিকদারও সঙ্গী ছিলেন তিন সব জানেন। যুদ্ধপরাধের দায়ে হাসেম রাজাকারকে যখন আটক করা হয় তখন তার বাবার হত্যার বিষয়ে কোন সাক্ষী তার পরিবারের পক্ষ থেকে কেন দেয়া হয়নি জিজ্ঞেস করলে তিনি কচুয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমান জানেন বলে ফোন কেটে দিন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খালেক বালীর তৎকালীন গুড়ের ব্যবসায়ের পার্টনার এবং ডাকাতদের হাতে নিহত হবার সময়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা আফসার শিকদার বলেন, সেদিনের রাতের সেই ঘটনা আজও আমাকে পীড়া দেয়। আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমত ছিল বলে আমি বেঁচে ফিরেছি। খালেককে ডাকাতরা তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে। এরপর বেশ কদিন আমি অসুস্থ থাকি ভয়ে। পরবর্তীতে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে ৯ নাম্বার সেক্টরে যুদ্ধ করি। তিনি স্মৃতি হাতরে বলেন খালেক বালি যখন ডাকাতদের হাতে নিহত হন তখন সম্ভবত এপ্রিল কিংবা মে মাস হবে। তবে খালেক বালী কোথায় মুক্তিযোদ্ধা করেছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই তার আগেই তো খালেক  মারা যায় কোথাও মুক্তিযুদ্ধ করে নাই তবে হাজেরাখালী গ্রামের স্কুল মাঠে তিনি এলাকার যুবক দের নিয়ে লাঠি খেলা শিখিয়েছিল। 

খালেক বালীর ছেলে বাশার বালী রাজাকারেরা তার বাবা কে হত্যা করেছে যা আপনি সাক্ষী' এ বিষয়ে তিনি জানান, সে যে ডাকাতদের হাতে মারা গেছে প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে শুধু এটাআমিই নই এলাকার সবাই জানে। 

কচুয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমান জানান, খালেক বালী মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট ভুক্ত নয় সে সশস্ত্র বাহিনীর তালিকাভুক্ত। ৯ নম্বর সেক্টরে তিনি যখন থানা কমান্ডার ছিলেন তখন খালেক বালি যুদ্ধ করেছে এখানে। আপনি খালেক বালীকে যুদ্ধ করতে দেখেছেন জিজ্ঞেস করলে আমি দেখি নাই বলে তিনি জানান। হাজরাখালী গ্রামের জীবত চার মুক্তিযোদ্ধা খালেক বালীকে কোথাও মুক্তিযুদ্ধ করতে দেখে নাই এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হামিক বালী, আফসার শিকদার, হানিম খান এবং বাদশা কাজীর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফেকেট নিয়ে ঝামেলা আছে বলে ফোন কেটে দেন। এর পর একাধিক বার ফোন করা হলেও তিনি আর রিসিভ করেন নাই।  

এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, আগামী ১৬ ডিসেম্বরের অগেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। যাচায়-বাছাই শেষে ৫ থেকে ৭ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা বাদ যাবে। এখনও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে খুঁজে বের করা হচ্ছে। আশা করি ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকৃতি মুক্তিযোদ্ধাদের একটা চিত্র তুলে ধরতে পারব।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত