তিন দাবীতে তাজরীনের আহত শ্রমিকদের অবস্থান : প্রশাসন নির্বিকার

প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২০, ১৩:৪৫

বাংলাদেশের ঢাকা মহানগরীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সংঘটিত মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অনেকেই ভুলতে বসেছেন। এদিন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম মারাত্মক অগ্নিকান্ডের ঘটনা যাতে মোট ১১৭ জন পোষাকশ্রমিক নিহত হয় ও ২০০ জনের অধিক আহত হয়। ভয়ানক এই দুর্ঘটনায় ঐ পোশাক কারখানার নয়তলা ভবনের ছয়তলা ভস্মীভূত হয়ে যায়। সরাসরি আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় ১০১ জন পোষাকশ্রমিক ও আগুন থেকে রেহাই পেতে ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু হয় আরও ১০ জনের।

ঘটনার পরপরই অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক প্রকাশ করেন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। তিনি সন্দেহ করেন যে পরিকল্পিতভাবে অগ্নি অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। তাজরিনের শ্রমিকদের বড় একটি অংশের ধারণাও তাই।

এই ঘটনার পর দীর্ঘ আটটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। আহত দুইশতাধিক শ্রমিকের চিকিৎসা বাবদ সরকারের তরফ থেকে সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেওয়া হয়, বিজিএমইএ'র পক্ষ থেকে বলা হয় প্রত্যেক আহত শ্রমিককে এক লক্ষ টাকা প্রদান করা হবে, এছাড়া বায়ারদের অনেকেই সহায়তার আশ্বাস দেয় শ্রমিকদের। গত আট বছরে এইসব প্রতিশ্রুতির একটিও ঠিকমত পূরণ করা হয়নি। অল্প কয়েকজন সহায়তা পেলেও অধিকাংশ শ্রমিকই কিছুই পাননি।

এতো সময়ে শ্রমিকদের একটি অংশ যাদের ভিটেমাটি আছে তারা ফিরে গেছেন গ্রামে। বাকিদের ভেতর যারা কম আহত ছিলেন তারা অনান্য পোশাক কারখানায় কাজ করছেন কিন্তু ৪৫ জন আহত শ্রমিকদের অবস্থা এতোটাই বেহাল যে তারা কিছু করে খেতে পারছেন না। আট বছর বাদেও তাই তারা এখনো চেয়ে আছেন সরকারের দিকে।

তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও সুচিকিৎসার দাবিতে অবস্থান এখন প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার কর্মসূচি পালন করেছেন ভুক্তভোগী শ্রমিকরা। গত ৪৮ দিন ধরে দিনরাত এই শ্রমিকেরা এখানে অবস্থান করছেন। আহত শ্রমিকদের ভাষ্যমতে গত সাতটি বছর হাত পেতে, আশেপাশের বাসাবাড়ির ছোটখাটো কাজ করে তারা কোনরকমে খেয়ে না খেয়ে জীবন যাপন করলেও করোনা পরিস্থিতিতে এই ৪৫টি পরিবার তাদের পরিজনদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের প্রায় সাত মাসের বাড়ি ভাড়া বকেয়া। অনেকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। অনেকের পরিবারে অন্যকোনও উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নেই। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে অসুস্থতায় অন্য কোনও কাজও করা সম্ভব হয় না অনেকের পক্ষে। তাই যতক্ষণ না আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে ততক্ষণ তারা প্রেসক্লাবেই অবস্থান করবেন বলে জানান।

কয়েকজন শ্রমিকদের আহাজারি করে বলতে শোনা যায়, কেন তারা সেদিন ছাদ থেকে লাফ দিতে গেলেন? আগুনে পুড়ে মরে গেলেও তো এতো কষ্ট সহ্য করতে হয় না। পাশে দাঁড়ানো আরেক নারী শ্রমিক বলেন তিনি ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিলেন যেন পরিবার লাশটা খুঁজে পায়।

এই শ্রমিকদের দেখিয়ে দেখিয়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আবার টাকা তুলে পালিয়ে গেছে। একটি প্রতিষ্ঠান এই পক্ষাঘাতগ্রস্থদের দিয়ে আরেকটি ছোট গার্মেন্টসের লাইন গড়ে তোলার আশ্বাস দেখিয়ে শ্রমিকদের সম্মিলিত সঞ্চয় দিয়ে মেশিনপত্র কিনিয়ে নিজেরাই হাওয়া হয়ে যায়। হতবিহবল মানুষগুলো নিজেদের এমন খারাপ অবস্থার উপর আরও একবার প্রতারিত হলেন! প্রতিবছর তাদের ডেকে নিয়ে শোক দিবস পালন করানো হয়। আগুনের ভিডিও দেখানো হয়। এরপর সবাই নীরবতা পালন করে সবাই চলে যান। কেউ আর ফিরে দেখেন না শ্রমিকদের দিকে।

এইসব শ্রমিকদের সন্তানদের স্কুলের বেতনভাতাদি পরিশোধ করতে না পারায় অনেককেই স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। এদিকে প্রেসক্লাবে অবস্থান করতে করতে এই অসুস্থ মানুষগুলো আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। আমাদের অনেক শ্রমিকরাই বলেন রাস্তার পাশে বলে চলা ড্রেনের ময়লার গন্ধে টেকা যায় না। রাতে পোকামাকড়ের কামড়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তবুও তারা ফিরতে রাজি নন। তাদের কথা মারা গেলে এখানেই মারা যাবেন।

 

এখানে খাওয়াদাওয়ার ব্যাবস্থা কি? জানতে চেয়ে জানলাম প্রথম দিকে কয়েকদিন না খেয়ে থেকেছেন। কোনদিন মাজারের অল্প খিচুড়ি সবাই মিলে ভাগ করে খেয়েছেন। কখনো কেউ কিছুটা ভাত আলুভর্তা দিয়ে গেলে সেটাই সবাই মিলে খাচ্ছেন। শেষ কবে মাছ দেখেছেন সেটা অনেকের মনে নেই। করোনার সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের বলছেন তারা যেহেতু স্থানীয় ভোটার নন তাই সাহায্য তাদের কপালে জুটবে না।

সরকারের তরফ থেকে দেওয়া করোনাকালীন অর্থ সাহায্য পেয়েছেন এমন একজনও খুঁজে পাওয়া যায় নি।

এই মানুষগুলো যে শারীরিকভাবে অসুস্থ সেটা তাদের দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। কারো হাত ভাঙা, কারো হাত-পা দুটোই ভাঙা। কারো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ পুড়ে গেছে। কারো হাড়ে ফাটল ধরেছে কারো মেরুদণ্ড ভাঙা। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে অনেকের। প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে কাঁদলেন।

তিন দাবীতে তারা অনড় থেকে অবস্থান চালিয়ে যাবেন। এখন আর কোথাও যাবার যায়গা নেই এই মানুষদের। তাদের ভাষ্যমতে 'মরলে এখানেই মরমু'। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত