'মসজিদের ভেতরে শহিদুন্নবী জুয়েলকে থাপ্পড় মারেন আবুল হোসেন'

প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২০, ১৩:০৫

সাহস ডেস্ক

লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে মো. শহিদুন্নবী জুয়েল (৫০) নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাকে পিটিয়ে হত্যা এবং পরে তার লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা হতবাক করেছে সাধারণ মানুষকে। হত্যাকাণ্ডের শিকার ওই ব্যাক্তির বাম গালে প্রথমে দুইটি থাপ্পড় মারার কথা স্বীকার করেছেন স্থানীয় আবুল হোসেন (৩৮)।

শুক্রবার (৩০ অক্টোবর) রাতে থাপ্পড় মারার কথা স্বীকার করে আবুল হোসেন বলেন, মসজিদের ভেতরে থাপ্পড় মারার পর সেখান থেকে তাকে বের করে আনা হয়। পরে সেখান থেকে জুয়েলকে উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলে স্থানীয়রা গণপিটুনি দিয়ে হত্যার পর লাশ সড়কে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলে।

আবুল হোসেন বুড়িমারী ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামপুর এলাকার হাবু মিয়ার ছেলে। তিনি বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের পূর্ব-দক্ষিণে রুমেল মার্কেটের ডেকোরেটর ব্যবসায়ী। বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের একজন নিয়মিত মুসল্লি তিনি।

নিহত ব্যক্তির ভাই তৌহিদুন্নবী জানান, শহিদুন্নবী জুয়েল আসলে অত্যন্ত ধার্মিক ও সহজ-সরল ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় এবং নিয়মিত কোরআন-হাদিস পাঠ করতেন। ঘটনার দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) সকালে তার ভাই মোটরসাইকেলে করে এক স্কুলের বন্ধুর বাড়িতে যান। সেখান থেকে তারা বেরিয়ে গেলেও কখন কী উদ্দেশ্যে পাটগ্রামে গিয়েছিলেন, সেটা কেউ জানাতে পারেননি।

আবুল হোসেন বলেন, আসরের নামাজ শেষে মসজিদের আঙিনায় বুড়িমারীর বড় রেজোয়ানের ছেলে রিয়াদ (৩৩), তার দুই ম্যানেজার, অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ও আমি উপস্থিত ছিলাম। এ সময় রিয়াদের সঙ্গে জমির পাওনা টাকার বিষয়ে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ মসজিদের ভেতরে খাদেম জুবেদ আলীর সঙ্গে জুয়েলের বাকবিতণ্ডার শব্দ শুনে আমি এগিয়ে যাই। বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে খাদেমকে গালিগালাজ করছিলেন নিহত জুয়েল। আমি তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি র‌্যাবের লোক বলে দাবি করেন। একেক সময় একেক পরিচয় দেওয়ায় আমার সন্দেহ হয়। এ সময় আমি প্রচণ্ড রাগের মাথায় তার বাম গালে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে মসজিদের বাইরে নিয়ে এসে বারান্দার সিঁড়িতে বসিয়ে নাম-ঠিকানা জানতে চাই। তার সঙ্গে থাকা অপর ব্যক্তি আমাদের জানান, তারা রংপুর থেকে এসেছেন। একজন-দুইজন করে প্রায় ২৫-৩০ জন মানুষ জড়ো হয়। আমি প্রথমে চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাতকে ফোন করি। তিনি বাইরে থাকার কথা জানিয়ে ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলামকে ডাকতে বলেন। এরপর হাফিজুল ইসলামকে ফোন করে ডেকে আনি এবং ওই দুই ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল, খাতা-কলম ও দুইটি জ্যাকেটসহ তার হাতে তুলে দিই। এরপর আমি ভাবতে পারিনি পরিস্থিতি এমন হবে। আমি নিজেও এমন ঘটনা পছন্দ করি না।

গুজব ছড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল হোসেন বলেন, মেম্বারের হাতে তাদের তুলে দেওয়ার পরই মসজিদ কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম প্রধান আসেন। পরে তিনিও ইউনিয়ন পরিষদে যান। কিন্তু কীভাবে কথাগুলো ছড়িয়ে পড়লো এবং মানুষ জড়ো হলো তা আমি বলতে পারি না। মেম্বারের হাতে ওই দুই ব্যক্তিকে তুলে দেওয়ার পর আমি আর ওদিকে যাইনি।

আপনি মারধর না করলে হয়তো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না, এমন বক্তব্যের বিষয়ে তিনি কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।

এদিকে সন্ধ্যার দিকেও তিনি বাড়িতে না ফেরায় এবং মোবাইলে কোন সাড়া না দেয়ায় জুয়েলের খোঁজখবর নেয়া শুরু করা হয়। এসময় ওই বন্ধুর কাছে খবর নেয়া হলে তিনি পাটগ্রামের সেই সহিংস পরিস্থিতির কথা জানান। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া গণপিটুনির ভিডিওটি দেখে মি. তৌহিদুন্নবী নিশ্চিত হন যে হামলার শিকার ওই ব্যক্তি আর কেউ নন, তারই আপন ভাই জুয়েল।

যার পুরো নাম আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহীদুন নবী জুয়েল। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ এবং তার বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশি বলে জানা গেছে। এদিকে স্বামীর এমন আকস্মিক মৃত্যুতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন নিহত শহীদুন নবী জুয়েলের স্ত্রী এবং তার দুই সন্তান। তার বড় মেয়ে জেবা তাসনিম এবার এইসএসসি পাস করেছে। ছেলে তাশিকুল ইসলাম ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

শুক্রবার সকালে শালবনে তার বাসভবনে গিয়ে দেখা যায়, খবর পেয়ে এলাকাবাসীসহ আত্মীয়-স্বজনরা ছুটে এসেছেন। পরিবারের স্বজনদের কান্না ও আহাজারিতে ভারী হয়ে আছে পরিবেশ। স্বজন ও এলাকাবাসীর দাবি, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে চাকরি চলে যাওয়ায় তার একমাত্র উপার্জনপথ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছিলেন। ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খেতেন নিয়মিত।

বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বলেন, আমার ইউনিয়ন পরিষদের আসবাবপত্র, গ্রিল, দরজা-জানালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা পরিষদের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ঘটনা তদন্তে এবং প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা কাজ করছি।

লালমনিরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এজন্য কিছুটা সময় নিয়ে মামলা রুজু করা হবে। জড়িতদের গ্রেপ্তারে মাঠে নেমেছি। আমরা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। এর পর মামলা করা হবে। এসব বিষয়ে পুলিশ ও সিআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছে। সব বিষয়ে তদন্ত চলমান রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত