পিটিয়ে হত্যার পর পুড়িয়ে মারা নিহত ব্যক্তি কেমন ছিলেন

প্রকাশ | ৩০ অক্টোবর ২০২০, ১৮:৪৭ | আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২০, ১৩:৩৮

অনলাইন ডেস্ক

লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাকে পিটিয়ে হত্যা এবং পরে তার লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা হতবাক করেছে সাধারণ মানুষকে। সেই শহিদুন্নবী জুয়েল আসলে অত্যন্ত ধার্মিক ও সহজ-সরল ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় এবং নিয়মিত কোরআন-হাদিস পাঠ করতেন।

নিহত ব্যক্তির ভাই তৌহিদুন্নবী জানান, ঘটনার দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) সকালে তার ভাই মোটরসাইকেলে করে এক স্কুলের বন্ধুর বাড়িতে যান। সেখান থেকে তারা বেরিয়ে গেলেও কখন কী উদ্দেশ্যে পাটগ্রামে গিয়েছিলেন, সেটা কেউ জানাতে পারেননি।

পরে সন্ধ্যার দিকেও তিনি বাড়িতে না ফেরায় এবং মোবাইলে কোন সাড়া না দেয়ায় খোঁজখবর শুরু করা হয়। এসময় ওই বন্ধুর কাছে খবর নেয়া হলে তিনি পাটগ্রামের সেই সহিংস পরিস্থিতির কথা জানান। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া গণপিটুনির ভিডিওটি দেখে মি. তৌহিদুন্নবী নিশ্চিত হন যে হামলার শিকার ওই ব্যক্তি আর কেউ নন, তারই আপন ভাই জুয়েল।

যার পুরো নাম আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহীদুন নবী জুয়েল। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ এবং তার বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশি বলে জানা গেছে। এদিকে স্বামীর এমন আকস্মিক মৃত্যুতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন নিহত শহীদুন নবী জুয়েলের স্ত্রী এবং তার দুই সন্তান। তার বড় মেয়ে জেবা তাসনিম এবার এইসএসসি পাস করেছে। ছেলে তাশিকুল ইসলাম ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

শুক্রবার সকালে শালবনে তার বাসভবনে গিয়ে দেখা যায়, খবর পেয়ে এলাকাবাসীসহ আত্মীয়-স্বজনরা ছুটে এসেছেন। পরিবারের স্বজনদের কান্না ও আহাজারিতে ভারী হয়ে আছে পরিবেশ। স্বজন ও এলাকাবাসীর দাবি, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে চাকরি চলে যাওয়ায় তার একমাত্র উপার্জনপথ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছিলেন। ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খেতেন নিয়মিত।

জুয়েলের জন্ম ও বেড়ে ওঠা রংপুর জেলাতেই। রংপুর জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন তিনি। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সায়েন্সে ভর্তি হন। সেখানেই সম্পন্ন করেন তার অনার্স এবং মাস্টার্স। পড়াশোনা শেষে, রংপুরের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের লাইব্রেরি সায়েন্সের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি মূলত সেখানকার লাইব্রেরির ইনচার্জ হিসেবে কাজ করতেন। টানা ২৪ বছর সেই চাকরি করেছেন তিনি।

গত বছর অবসরে যাওয়ার পর মি. জুয়েল নিজস্ব ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন। না হলে নতুন কোন চাকরিতে যোগ দেয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে জানিয়েছেন তার ভাই। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে কোন দিকেই কোন গতি করতে পারছিলেন না। এমন অবস্থায় মি. জুয়েল কিছুটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে জানান মি. তৌহিদুন্নবী। তবে তার এই মানসিক হতাশা গুরুতর কিছু ছিল না বলেও তিনি নিশ্চিত করেছেন।

ব্যক্তিজীবনে সহজ, সরল, অমায়িক ও ধর্মভীরু মানুষ হিসেবে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ছিলেন মি. জুয়েল। তাই তার এমন নৃশংস মৃত্যুর ঘটনা কেউই যেন স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না।

এ ব্যাপারে মি. তৌহিদুন্নবী বলেন, জুয়েল এক কথায় সহজ আর সাদা মনের মানুষ ছিল। স্বভাবে ও একটু চঞ্চল। কিন্তু ইদানিং মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল সে। সকালে বেরিয়ে যেতো, কোথায় যেতো বলে যেতো না, ফোন ধরত না, অনেকদিন ধরে ঘরে বসে আছে, নির্দিষ্ট কোন পেশা নেই। এ জন্যই হয়তো মানসিক চাপ ছিল। তবে সেটা গুরুতর কিছু না। এমনিতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো।

ধর্মগ্রন্থের পাশাপাশি মি. জুয়েল নানা ধরণের বই পড়তেন বলে জানিয়েছেন মি. তৌহিদু্ন্নবী। ইংরেজি ভাষায় তার ভালো দখল ছিল বলেও তিনি জানান।

পরিসংখ্যান বলে ২০১১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত গণপিটুনিতে বাংলাদেশে প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে - যেগুলোর কোনটায় ছেলেধরা বা ডাকাত সন্দেহে, আবার কোন কোন ঘটনায় সামান্য চোর সন্দেহেও পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে।