সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল রফিক-উল হক আর নেই

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২০, ১১:৫২

সাহস ডেস্ক

দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল রফিক-উল হক আর নেই। রাজধানীর আদ-দ্বীন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সকাল সাড়ে ৮টায় তিনি মারা যান বলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. অধ্যাপক নাহিদ ইয়াসমিন নিশ্চিত করেছেন।

শনিবার (২৪ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

সুপ্রিম কোর্ট বারের প্রেসিডেন্ট ও অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জানান, আজ দুপুর ২টার দিকে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন প্রাঙ্গণে রফিক-উল হকের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তাকে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হবে।

এর আগে শুক্রবার (২৩ অক্টোবর) এক ভিডিও বার্তায় হাসপাতালের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাহিদ ইয়াসমিন বলেন, গত ১৫ তারিখ থেকে স্যার (রফিক-উল হক) আমাদের এখানে ভর্তি আছেন। স্যার এখন লাইফ সাপোর্টে আছেন। স্যারের অবস্থা অপরিবর্তিত। স্যার এখন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আছেন। স্যারকে দেখতে গণ স্বাস্থ্যের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার এসেছিলেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ( ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সাহেব খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন। আরও অনেক ব্যারিস্টার, শুভাকাঙ্ক্ষী খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। তার শারীরিক অবস্থা জানতে চেয়েছেন।

তিনি বলেন, স্যারের রক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করেছি। কিন্তু তাতে কোনো একটা উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে কথা বলেছি। ওনারা দেখেছেন। ওনারাও বলেছেন স্যারের শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

ব্রিটিশ ভারতে ১৯৩৫ সালের ২ নভেম্বর কলকাতায় জন্ম ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের। তার শৈশব থেকে থেকে শুরু করে শিক্ষা জীবনের প্রায় পুরোটাই কলকাতায় কেটেছে। পরে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে চার দেশের নাগরিক হতে হয়েছে তাকে।

কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংস্পর্শে আসেন রফিক-উল হক। বেকার হোস্টেলে যে কক্ষে বঙ্গবন্ধু থাকতেন তার পাশের কক্ষেই থাকতেন তিনি। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও কারমাইকেল হোস্টেলে কিছুদিন বঙ্গবন্ধুর সহচর্যে তিনি ছিলেন। 

ছাত্র জীবন থেকেই অসামান্য মেধাবী ছিলেন রফিক-উল হক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সময় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ক্রিমিনাল ল-তে প্রথম হয়ে স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন তিনি। হিন্দু ল নিয়ে ব্যারিস্টারি পড়েছেন। সেখানেও দ্বিতীয় হতে হয়নি তাকে। সপ্তাহান্তে খণ্ডকালীন চাকরি করে ব্যারিস্টারি পড়ার খরচ চালিয়েছেন। স্বাভাবিক গতিতে তিন বছরে ব্যারিস্টারি শেষ করার কথা থাকলেও মাত্র দেড় বছরের মধ্যে সবগুলো কোর্সে পাস করেছিলেন। তাকে দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দ ল পড়ানো শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পরীক্ষক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন।   

পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন রফিক-উল হক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পর পর দুবার জিতেছিলেন তিনি। সোশ্যাল সেক্রেটারি হয়েছিলেন। পরে পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। তখন ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কেন্দ্রীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি। রাজনীতির সূত্রে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে, সুযোগ পেয়েছেন একসঙ্গে কাজ করার।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের বাবা মুমিন উল হক পেশায় ডাক্তার হলেও চব্বিশ পরগনা মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। কলকাতা শহরও তখন এর অন্তর্গত ছিল। তিনি চব্বিশ পরগনা জেলা মুসলিম লিগের সভাপতি ছিলেন। ডাক্তারি, জমিদারি ছেড়ে গণমানুষের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে নিঃস্ব হতে হয়েছিল তাকে।

ঢাকার ফার্মগেটে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের দাদার গড়া প্রতিষ্ঠান। ঢাকা শিশু হাসপাতাল গড়ে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ব্যরিস্টার রফিক-উল। এই হাসপাতালের জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। লটারির টিকিট বিক্রি করে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার খরচের বড় একটা অংশ সংগ্রহ করেন তিনি। এছাড়া সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছে কোনো ফি নিতেন না বলে এই হাসপাতালের জন্য আশির দশকে ৫০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছিলেন। শিশু হাসপাতাল ছাড়াও সুবর্ণ ক্লিনিক, আদ-দ্বীন, বারডেম, আহসানিয়া মিশনি ক্যান্সার হাসপাতালসহ অনেক চিকিৎসাধর্মী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। নিজের উপার্জিত অর্থে গাজীপুরের চন্দ্রায় ১০০ শয্যার সুবর্ণ-ইব্রাহিম জেনারেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন।  

পেশায় আইনজীবী হলেও পারিবারিক কারণে চিকিৎসা পেশার সঙ্গে গভীর সংযোগ ছিল ব্যারিস্টার রফিক-উলের। তার বাবা ছাড়াও স্ত্রী ফরিদা হকও ডাক্তার ছিলেন। ১৯৬০ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। এ ছাড়া রফিক-উল হকের ভাই-বোনদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন ডাক্তার। বিশ্ব থেকে গুটি বসন্ত রোগ নির্মূলে বিশেষ অবদান ছিল ডা. ফরিদা হকের। এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বর্ণ পদক দিয়ে তাকে সম্মানিত করেছিল। কাউ পক্স নির্মূলের জন্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে।

১৯৯০ সালে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে সরকারের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা হয়েও কোনো বেতন নেননি তিনি। ১৯৬০ সালে কলকাতায় প্রথম মামলা থেকে শুরু করে মাঝে দীর্ঘ ৬০ বছর আইন পেশায় যুক্ত থেকেছেন। এর মধ্যে ১/১১ এর সময় দুই শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনেরই আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের একমাত্র ছেলে ব্যারিস্টার ফাহিম-উল হকও আইন পেশায় যুক্ত। পুত্রবধূ রোকেয়া হকও যুক্ত রয়েছেন একই পেশায়।

আইন পেশায় প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার সুযোগ থাকলেও বস্তুগত বিষয়ে কখনোই আগ্রহ ছিল না ব্যারিস্টার রফিক-উলের। নিজের ও স্ত্রীর উপার্জিত প্রায় সব টাকা মানব সেবায় দান করে দিয়েছেন। সম্পদ বলতে যে বাড়িটিতে তিনি থাকতেন তা তার শাশুড়ি মেয়েকে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ঢাকায় আর দুটি ফ্ল্যাট তার নামে আছে। এখান থেকে পাওয়া ভাড়ার টাকায় শেষ জীবনের খরচ চালিয়েছেন তিনি।

রফিক-উল হকেরা চার ভাই-বোন। আপন তিন ভাই। বড় ভাই পুলিশ কমিশনার ছিলেন। মেজ ভাই ছিলেন ডাক্তার। একমাত্র বোনও মারা গেছেন বেশ আগেই। তাদের সবার মৃত্যুর কারণ ছিল ক্যানসার।

দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেত্রীদ্বয়ের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। সব সময়ই তিনি দুই নেত্রীর মধ্যে বৈরি সম্পর্কের অবসান চেয়েছিলেন। এই আক্ষেপ সঙ্গে নিয়েই বিদায় নিতে হলো তাকে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত