প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় লিবিয়ায় যেভাবে হত্যা করা হলো ২৬ বাংলাদেশিকে

প্রকাশ : ৩০ মে ২০২০, ১১:২৩

সাহস ডেস্ক

ভূমধ্যসাগরীয় দেশ লিবিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের এক সদস্যের সহযোগী ও স্বজনদের বর্বরোচিত আক্রমণে ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসী শ্রমিক নিহত হয়েছেন। লিবিয়ার জাতিসংঘ সমর্থিত সরকার জানিয়েছে, লিবিয়ার এক মানবপাচারকারীকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ২৬ জন বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে হত্যা করেছে ওই পাচারকারীর পরিবারের সদস্যরা। বাংলাদেশি বাদে মারা যাওয়া অন্য ৪জন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত।

হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া একজন আহত বাংলাদেশি নাগরিকের বয়ানের ভিত্তিতে লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রমবিষয়ক কাউন্সিলর আশরাফুল ইসলাম জানান, মারা যাওয়া ২৬ জনসহ মোট ৩৮ বাংলাদেশি ও কয়েকজন সুদানি নাগরিক প্রায় ১৫ দিন ধরে ওই অপহরণকারী চক্রের হাতে আটক ছিলেন। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদায় আটক করে রাখা হয়েছিল তাদের। সেখানেই ২৮ মে সকালে বন্দিদের ওপর গুলি চালায় অপহরণকারীরা।

যেভাবে অপহরণকারীদের কবলে পড়লেন তারা

মূলত ইতালিতে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে ওই ৩৮জন বাংলাদেশি লিবিয়ায় গিয়েছিলেন বলে জানান আশরাফুল ইসলাম। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জটিলতা শুরু হওয়ার আগে ডিসেম্বর মাসে তারা ভারত ও দুবাই হয়ে বেনগাজি বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর গত কয়েকমাস তাদেরকে লিবিয়ার ভেতরে গোপনে রাখা হয়েছিলো। উপকূলীয় অঞ্চল যুওয়ারা হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অভিবাসীদের নিয়ে ইতালির দিকে যাত্রা করার পরিকল্পনা ছিল পাচারকারীদের।

আশরাফুল ইসলাম বলেন, বছরের এই সময়টায় সাগর অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকায় এটিকেই সাগর পাড়ি দেওয়ার আদর্শ সময় বলে মনে করা হয়। তবে প্রচলিত পথে না গিয়ে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে বেশ বিপদসংকুল একটি পথে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো।

তিনি জানান, যুদ্ধকবলিত লিবিয়ায় একাধিক সরকার থাকায় ত্রিপলি হয়ে যুওয়ারা যাওয়ার প্রচলিত পথে নানা রকম তল্লাশি হয়। সেই পথ এড়িয়ে কম ব্যবহৃত মরুভূমির মধ্যকার রাস্তা দিয়ে অভিবাসীদের নিয়ে যুওয়ারা যাচ্ছিলেন পাচারকারীরা। কিন্তু ওই মরুভূমির পথ সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণাধীন, যারা সরকারহীনতার সুযোগ নিয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে অনেকদিন ধরে। সন্ত্রাসী ও অপহরণকারীদের একাধিক গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্বের ঘটনাও ঘটে থাকে। বেনগাজি থেকে মরুভূমির রাস্তায় যুওয়ারা যাওয়ার পথে তারা অপহরণকারীদের কবলে পড়েন।

কেন হত্যা করা হলো অভিবাসনপ্রত্যাশীদের?

আশরাফুল ইসলাম জানান, অপহরণের পর মিজদাতেই প্রায় ১৫ দিন অপহরণকারীদের জিম্মায় ছিলেন অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশি ও সুদানি নাগরিকরা। অপহরণকারীদের সাথে আটক হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তিপণ নিয়ে দর কষাকষি চলছিল। আটককৃতদের অনেকেই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলেও কাঙ্ক্ষিত মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হয় তারা। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আাটককৃতদের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে অপহরণকারীরা। একপর্যায়ে বাংলাদেশিদের সাথে থাকা সুদানি নাগরিকরা অপহরণকারী চক্রের এক সদস্যকে মেরে ফেলেন। এরপর অপহরণকারীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে ৩৮ বাংলাদেশির সবাই গুলিবিদ্ধ হন। মারা যায় ২৬জন।

গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় কয়েকজন ভেতরেই পড়ে ছিল, দুই-একজন আহত অবস্থায় বের হয়ে আসে। তাদের দেখে স্থানীয় লোকজন সেনাবাহিনীকে খবর দেয় এবং সেনাবাহিনী তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে।

শুক্রবার এক ভিডিওবার্তায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, আহত ১১ জনকে মিজদাহ থেকে ত্রিপোলিতে আনা হয়েছে। ছয়জন পুরোপুরি সুস্থ। তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক,তিনজনের অপারেশন হয়েছে, দুইজনের হবে। তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বুলেট ঢুকেছে। বুলেট বের করার চেষ্টা হয়েছে।

২৬ জনের মৃতদেহ মিজদাহ হাসপাতালের মর্গে আছে জানিয়ে মোমেন বলেন, আমরা আইওমের (ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন) সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, তাদের একটা ব্যবস্থা করার জন্য। আমরা দাবি করেছি, এদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য। আমরা দাবি করেছি, পাচারকারীদের শাস্তি দিতে এবং তার তথ্য আমাদের দিতে। আমরা সেগুলো সংরক্ষণ করব।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, যিনি পালিয়ে এসেছেন, তিনি বলেছেন, তারা একেকজন ৮ থেকে ১০ হাজার ডলার দিয়ে গিয়েছেন, ওরা আরও টাকা চাচ্ছিল এবং ওদেরকে খুব অত্যাচার করে। কিন্তু ওরা দিতে রাজি হয়নি, বচসা হয়। বচসার এক পর্যায়ে তাদের সঙ্গে থাকা একজন আফ্রিকান মূল পাচারকারীকে মেরে ফেলা হয়।

তিনি বলেন, মারার পরপর মূল পাচারকারীর পরিবার এবং বাকী পাচারকারীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। ওরা একই জায়গা ছিল। এলোপাতাড়ি গুলিতে আমাদের ২৬ জন ভাই মারা যায়। ১১ জন আহত হয়। কোনোমত বেঁচে ফেরা ওই ব্যক্তি প্রথম এসে যে ফার্মেসিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, পাচারকারীরা এসে সেটিও তছনছ করে।

ওই ব্যক্তির বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে মোমেন বলেন, কোনোমতে লুকিয়ে আছেন। উনি বলছেন, খবর পরে জানাবেন।

মানবপাচারকারীদের গুলিতে নিহত ২৬ বাংলাদেশির মরদেহ সেখানকার মিজদাহ শহরেই কবর দেয়া হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ওই ঘটনায় ২৬ বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১১ জন। হতাহতদের মধ্যে ‘নিখোঁজ বা মৃত’ হিসেবে ২৪ জনের এবং আহত হিসেবে ১১ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে।

স্থানীয় একাধিক বাংলাদেশি জানান, মরদেহগুলো পঁচে গন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ওই এলাকায় যুদ্ধাবস্থা চলমান থাকায় এবং হামলাকারী লিবিয়ান ওই গোষ্ঠী চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে থাকায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানে যেতে পারেননি।

হামলাকারীরা অন্য বাংলাদেশিদেরও খুঁজছে বলে জানান স্থানীয় বাংলাদেশিরা। তবে নিহত বাংলাদেশিদের স্থানীয়ভাবে দাফন করার বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

বেনগাজীর বাংলাদেশ কমিউনিটির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক জানান, লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের অবস্থা ভালো নয়। পরিস্থিতি এত খারাপ যে, এখনও অক্ষত অবস্থায় পালাতে সক্ষম হওয়া বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। হামলাকারীরা জীবিত বাংলাদেশিদের অবস্থান জেনে যাওয়ায় ওই অঞ্চলে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে এবং আশ্রয়দাতাসহ অনেকেই হুমকির মুখে থাকাতে উদ্ধার কাজে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মিজদাহ শহরে এখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান এবং এ অঞ্চলটি এখন দুটি শক্তিশালী পক্ষের যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে। কিছুদিন আগে ত্রিপোলিভিত্তিক এবং ইউএন সমর্থিত জিএনএ সরকার এই অঞ্চলটি দখল করে নিলেও জেনারেল হাফতারের নেতৃত্বাধীন পূর্বভিত্তিক সরকারি বাহিনী দুদিন আগেও শহরটিতে বোমাবর্ষণ করে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে লিবিয়ায় নিখোঁজ ও নিহতদের তালিকা করা হয়েছে। সেই নিহত ও নিখোঁজের তালিকায় মাদারীপুর জেলারই ১৬ জন রয়েছেন। মাদারীপুরের যেসব মানুষের নাম রয়েছে তারা হলেন, রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের রহিম, বিদ্যানন্দী গ্রামের জুয়েল ও মানিক, টেকেরহাট এলাকার আসাদুল, আয়নাল ও মনির, ইশিবপুর ইউনিয়নের সজীব ও শাহিন, সদর উপজেলার দুধখালী ইউনিয়নের শামীম।

শুধু জেলা মাদারীপুর লেখা তালিকায় রয়েছে জুয়েল, সৈয়দুল ও ফিরুজ। তবে এদের মধ্যে কে মারা গেছেন আর কে জীবিত বা নিখোঁজ আছেন তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি।

এছাড়া আহতদের তালিকায় রয়েছেন সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের ত্রিভাগদি গ্রামের খালেক বেপারির ছেলে ফিরোজ বেপারি, রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের কদমবাড়ির মোক্তার আলী শিকদারের ছেলে মোহাম্মদ আলী শিকদার ও ইশিবপুর ইউনিয়নের খলিল খালাসীর ছেলে সম্রাট খালাসী।  

রাজৈরের বিদ্যানন্দী গ্রামের জুয়েলের ভাই লিটন বলেন, আমার ভাই লিবিয়ায় গিয়েছিল। বিভিন্নভাবে শুনছি নিহত ও নিখোঁজের তালিকায় তার নাম রয়েছে। তবে আমরা এখনও জানতে পারিনি সে বেঁচে আছে, নাকি নিখোঁজ আছে।

‘নিখোঁজ বা মৃত’ ২৪ জন হলেন- গোপালগঞ্জের সুজন ও কামরুল; মাদারীপুরের জাকির হোসেন, সৈয়দুল, জুয়েল ও ফিরুজ, রাজৈরের বিদ্যানন্দীর জুয়েল ও মানিক, টেকেরহাটের আসাদুল, আয়নাল মোল্লা (মৃত) ও মনির, ইশবপুরের সজীব ও শাহীন, দুধখালীর শামীম; ঢাকার আরফান (মৃত); টাঙ্গাইলের মহেশপুরের বিনোদপুরের নারায়ণপুরের লাল চান্দ; কিশোরগঞ্জের ভৈরবের রাজন, শাকিল, সাকিব ও সোহাগ, রসুলপুরের আকাশ ও মো. আলী, হোসেনপুরের রহিম (মৃত) এবং যশোরের রাকিবুল।

আহত ১১ জন হলেন- মাদারীপুর সদরের তীর বাগদি গ্রামের ফিরোজ বেপারী (হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ), ফরিদপুরের ভাঙ্গার দুলকান্দি গ্রামের মো. সাজিদ (পেটে গুলিবিদ্ধ), কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শম্ভপুর গ্রামের মো. জানু মিয়া (পেটে গুলিবিদ্ধ), ভৈরবের জগন্নাথপুর গ্রামের মো. সজল মিয়া (দুই হাতে মারাত্মকভাবে জখম ও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন), গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বামনডাঙ্গা বাড়ির ওমর শেখ (হাতে মারাত্মকভাবে জখম ও আঙ্গুলে কামড়ের দাগ, দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ), টাঙ্গাইলের মহেশপুরের বিনোদপুরের নারায়ণপুরের মো. তরিকুল ইসলাম (২২), চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার বেলগাছির খেজুরতলার মো. বকুল হোসাইন (৩০), মাদারীপুরের রাজৈরের কদমবাড়ির মো. আলী (২২), কিশোরগঞ্জের ভৈরবের সখিপুরের মওটুলীর সোহাগ আহমেদ (২০), মাদারীপুরের রাজৈরের ইশবপুরের মো. সম্রাট খালাসী (২৯) এবং চুয়াডাঙ্গার বাপ্পী (মস্তিষ্কে গুলিবিদ্ধ, গুরুতর অবস্থা)। এরা সবাই ত্রিপোলি মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত