২২'শ টাকার কাঠের টেবিল কেনা হলো ২৫,০০০ টাকায়

প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:৩৫

সাহস ডেস্ক

সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন

কাঠের টেবিল কেনা হয়েছে ২,২০০ টাকা করে। আর সেই টেবিলের দাম দেখানো হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। দুর্নীতির এমন চিত্র উঠে এসেছে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। শুধু তাই নয়, হাসপাতালসহ বিভিন্ন খাতে সরকারি বরাদ্দের টাকা নিয়ে হয়েছে ব্যাপক অনিয়ম। এসব অনিয়মে জন্য অভিযোগের আঙুল উঠেছে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. খায়রুল ইসলামের দিকে। 

টেবিল ক্রয়ের বিল ভুয়া

নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের পাঁচটি টেবিল, চারটি পাদানি ও একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিল বাবদ ২ লাখ টাকা বিল দেখানো হয়েছে। সেখানে প্রতিটি টেবিল ২৫ হাজার টাকা এবং একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিল ৭৫ হাজার টাকা হিসেবে ক্রয় দেখানো হয়। হাকিমপুর উপজেলার মেসার্স বিদ্যুৎ ট্রেডার্স নামের একটি ফার্নিচার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের গত ১৯ জুনের ওই ভাউচার জমা দিয়ে বরাদ্দের ২ লাখ টাকা তুলে নেন ডা. খায়রুল ইসলাম। 

তবে বিলে দেখানো ফার্নিচার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ ট্রেডার্সের সত্ত্বাধিকারি মো. শফিকুল ইসলাম জানান, তিনি নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনো ধরনের আসবাবপত্র সরবরাহ করেননি।

হাসপাতালের সামনের বেলাল ফার্নিচারের সত্ত্বাধিকারি বেলাল হোসেন জানান, নবাবগঞ্জ উপজেলা ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম চলতি বছরের ১৯ অক্টোবর মেহগনি কাঠের ৩ ফুট ৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, ২ ফুট ৫ ইঞ্চি প্রস্ত এবং ২ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার পাঁচটি টেবিল তার কাছ থেকে কেনেন। প্রতিটি টেবিলের মূল্য ২ হাজার ২০০ টাকা এবং প্রতিটি পাদানির মূল্য ১ হাজার ২০০ টাকা করে রাখা হয়।

ডেঙ্গুর চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনায় অনিয়ম

সম্প্রতি সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিলে অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সেবার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ৫ আগস্ট ২ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও ডেঙ্গুর কিট ও চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয় বাবদ ২ লাখ টাকা বরাদ্দ পায়। 

ওই বরাদ্দের বিপরীতে জমা দেওয়া বিল ও ভাউচারে দেখা গেছে, ২ লাখ টাকার মধ্যে ৩০ হাজার টাকা ভ্যাট এবং ৪ হাজার টাকা কর জমা দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকার মধ্যে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালের ভাউচারে ১ সেপ্টেম্বর ২৪ হাজার ৭৮০ টাকার ৮৪ প্যাকেট, ৪ সেপ্টেম্বর ২৪ হাজার ৭৮০ টাকার ৮৪ প্যাকেট, ৫ সেপ্টেম্বর একই মূল্যের ৮৪ প্যাকেট ডেঙ্গু কিট ক্রয়সহ আরও ছয়টি ভাউচারের অন্যান্য ওষুধ ক্রয় দেখানো হয়। এর বিপরীতে ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকার বিল ভাউচার জমা দিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়।

তবে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালের বিপনন কর্মকর্তা গৌরাঙ্গ রায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালের কোনো ডেঙ্গু কিট নেই বা উৎপাদন করে না। তাই কোম্পানির ডেঙ্গুর কিট সরবরাহের কোনো প্রশ্নই আসে না। তিনি নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুটি ভাউচারে ৯৭ হাজার টাকার প্যারাসিটামল জাতীয় ট্যাবলেট ও স্যালাইন সরবারাহ করেছিলেন। 

গৌরাঙ্গ রায় বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিল উত্তোলনের প্রয়োজনের কথা বলে অতিরিক্ত সাতটি ফাঁকা ভাউচারে আমার কাছ থেকে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিলেন।

অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান থেকেও কেনা হয়েছে ওষুধ

চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি কেনার জন্য ৭২ হাজার টাকার বরাদ্দ দেওয়া হয়। ডা. খায়রুল ইসলাম বিরামপুর উপজলার রুবিনা ফার্মেসি অ্যান্ড মেডিকেল ইকুইপমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি ভাউচারে ১২০টি রক্তচাপ (বিপি)মাপার মেশিন ক্রয় দেখিয়ে বরাদ্দের টাকা উত্তোলন করে নেন। তবে সরেজমিনে বিরামপুরে রুবিনা ফার্মেসি অ্যান্ড মেডিকেল ইকুইপমেন্ট নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। 

এ বছরের ২১ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সাব-সেন্টার ও উপজেলার রোগীদের ওষুধ কেনার জন্য ১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। ডা. খায়রুল ইসলাম উপজেলার তিনটি সাব-সেন্টার এবং তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রত্যেকটির অনুকূলে ২৪ হাজার ৯৪৫ টাকা ওষুধ ক্রয়ের ভাউচার জমা দিয়ে বরাদ্দের অর্থ তুলে নেন।

তবে আফতাবগঞ্জ উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপসহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মো. তোজাম্মেল হক, দাউদপুরের দিলবার হোসেন জানান, তাদের কোনো ওষুধ দেওয়া হয়নি। সাদা কাগজে ওষুধ বুঝে পাওয়ার স্বাক্ষর দিতে চাপ দেন ডা. খায়রুল। কিন্তু তারা স্বাক্ষর দেননি। 

মালারপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার বুলবুল আহম্মেদ, কাঁচদহ কমিউনিটি ক্লিনিকের সাইফুল আলম এবং কচুয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কামরুজ্জামান জানান, তাদের কোনো ওষুধই দেওয়া হয়নি। নগদ ১০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। ডা. খায়রুল ইসলামের পরামর্শে তারা ২৪ হাজার ৯৯৫ টাকার ভুয়া বিল ভাউচার জমা দিতে বাধ্য হয়েছেন।

নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত স্টোরকিপার নূরে আলম সিদ্দিক এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মাহমুদ শরীফ জানান, ডা. খায়রুল ইসলাম কোনো প্রকার ডেঙ্গুর কিট, বিপি মেশিন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জমাই দেননি। চাকরির ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক তাদের কাছ থেকে স্টক লেজারে জমা দেখিয়ে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।

পরিচ্ছন্নতাকাজে বরাদ্দের টাকা কোথায় গেল

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে নবাবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঁচ দফায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদ ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। এর মধ্যে ৭৮ হাজার টাকা ভ্যাট এবং ১০ হাজার ৪০০ টাকা কর দেওয়া হয়। বাকি টাকা থেকে হাসাপাতাল পরিষ্কার ও কাপড় ধোয়া বাবদ ঠিকাদারের বিল দেওয়া হয় ৬৮ হাজার টাকা। এছাড়া ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় আগস্টে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ১৮ হাজার টাকা এবং একটি ট্যাংক পরিষ্কার বাবাদ ৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় থেকে শ্রমিক দিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি পরিষ্কার করা হয়। 

এ খাতে আর কোনো খরচ হয়নি বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মাচারী জানিয়েছেন। কিন্তু ডা. খায়রুল ইসলাম ভাউচার দেখিয়ে বরাদ্দের বাকি ৪ লাখ ৩১ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। 

এছাড়া জমা দেওয়া বেশ কয়েকটি বিল ও ভাউচারে দেখা গেছে গত ৫ আগস্ট উপজেলার আফতাবগঞ্জ, ভাদুরিয়া এবং দাউদপুর উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদ প্রতিটিতে ১৫ হাজার করে টাকা বরাদ্দ দেন ডা. খায়রুল ইসলাম। তবে উপজেলার আফতাবগঞ্জ উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপসহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার তোজাম্মেল হক, দাউদপুরের দিলবার হোসেন এবং আফতাবগঞ্জের শ্রী প্রাণনাথ তরফদার জানান, তাদের কাউকেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদ কোনো টাকা দেননি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. খায়রুল ইসলাম। 

ভাড়া দেন না সরকারি বাড়ির, অ্যাম্বুলেন্সচালক ব্যক্তিগত কাজে

ডা. খায়রুল ইসলাম নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করেন গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর। সরেজমিনে দেখা গেছে, তিনি সরকারি একটি কোয়ার্টারে বসবাস করছেন। ঘরে লাগানো রয়েছে এসি। বিধি অনুযায়ী তাকে বাড়ি ভাড়া বাবদ ১৩ হাজার ৮০০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, তিনি এ বছর সেপ্টেম্বর থেকে শুধু একটি সিটের ভাড়া বাবদ ১ হাজার ৩৮০ টাকা জমা দিচ্ছেন। 

স্থানীয় আব্দুর রহমান ও কুদ্দুস আলী জানান, খায়রুল ইসলাম হাসপাতালে যোগদানের পর থেকেই নানা ধরনের অনিয়ম করে আসছেন। ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ আসলেও তিনি পুরো টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়াও ২ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে টেবিল কিনে ২৫ হাজার টাকার বিল করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। 

তারা আরও জানান, খায়রুল ইসলাম হাসপাতালের এসি নিজ বাড়িতে ব্যবহার করছেন। হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স নষ্ট দেখিয়ে সেই চালককে ব্যাক্তিগত কাজে ব্যবহারসহ তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

‘যা কিছু করেছি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শেই করেছি’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. খায়রুল ইসলাম বলেন, যেহেতু আমি এই কর্মস্থলে একেবারেই নতুন; মেডিকেল কলেজে শিক্ষকতা পেশা থেকে এখানে এসেছি, আমি কখনও কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করিনি। যার কারণে এ বিষয়ে পূর্বের কোনো অভিজ্ঞতা আমার ছিলো না। আমি যা কিছু করেছি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারি সমর কুমার দেবের পরামর্শেই করেছি।

ডেঙ্গুর কিট এবং সেক্রেটারিয়েট টেবিল দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে পারেননি। সেই সঙ্গে ২ হাজার ২০০ টাকার টেবিল ক্রয় করে ২৫ হাজার টাকার ভাউচার দাখিলের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। 

তবে নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিস সহকারি সমর কুমার দেব জানান, তিনি কখনই অবৈধ কোনো কাজের পরামর্শ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে দেননি, বরং তাকেই অবৈধ কাজ করতে চাপ দিতেন ডা. খায়রুল ইসলাম।

সমর কুমার দেব বলেন, তিনি আমাকে নির্দেশনা দিয়েছেন, এভাবে সই-স্বাক্ষর নিয়ে বিল তৈরি করেন। এরপরে বিল ক্যাশ হবে, ওষুধ কিনবো। তারপরে ওনাদের ওষুধ বিলি করবো। এখন বিল ক্যাশ হওয়ার পরে উনি ওষুধ কিনেছেন কিনা এটি আমার জানা নেই।

দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ড. আব্দুল কুদ্দুস জানান, নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. খায়রুলের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত কমিটি করা হবে। তদন্তসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত