দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে সেবার মান হ্রাস পাচ্ছে উবারের

প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১২:২০

রাজধানীর বাসিন্দাদের নানা বাজে অভিজ্ঞতা থেকে স্বস্তি দিতে বছর তিনেক আগে অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে রাজপথে নেমেছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং কোম্পানি উবার। কিন্তু দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও যথাযথ তদারকি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে সেবার মান হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিশ্বখ্যাত কোম্পানিটি গুণগত সেবা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং ঢাকার ভয়াবহ যানজটের সাথে তাদের ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ ও আন্তর্জাতিক মানের সেবার সাথে আপোষ ঘটিয়েছে।

অযোগ্য ও নিম্নমানের যানবাহন নিবন্ধন করা, যাত্রীদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে অস্বীকার করা, সময় নষ্ট করার পর তাদের যাত্রা বাতিল করতে বলা, যাত্রীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং ট্রাফিক বিধি লঙ্ঘন করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে উবার চালকদের বিরুদ্ধে।

গত ২২ আগস্ট এক উবার চালকের বিরুদ্ধে রাজধানীর দারুসসালাম থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন এমএম গোলাম শওকত নামে এক ব্যক্তি। জিডিতে ওই ব্যক্তি লেখেন, তিনি উবার থেকে নামার সময় ১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও মালামালসহ একটি ব্রিফকেস নিতে ভুলে গেছেন। পরে তিনি চালককে ফোন দিয়েও তা ফেরত পাননি। তিনি এখনো টাকা বা মূল্যাবান জিনিসপত্র কোনোটাই ফিরে পাননি।

ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা দারুসসালাম থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাহবুবুর রহমান জানান, উবার কর্তৃপক্ষ দ্রুততার সাথে জবাব না দেয়ায় তারা এখনো ওই চালককে ট্র্যাক করতে পারেননি। আমি নিজে ওই চালকের সাথে কয়েকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু প্রত্যেকবার তার নম্বর বন্ধ পেয়েছি। পরে আমি উবারের উত্তরা অফিসের সাথে যোগাযোগ করেছি,  কিন্তু তারাও এখনো ওই চালকের বিস্তারিত তথ্য দেয়নি।

২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর বাংলাদেশে চলতে শুরু করে অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা উবার। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও সম্প্রতি অনেক ব্যবহারকারী কোম্পানিটির সেবা নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছেন।

উবারের সেবা নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আব্দুল আজিজ নামে এক ব্যক্তি বলেন, এদের এমন অনেক গাড়ি আছে যেগুলো রাইড শেয়ারের জন্য উপযোগী নয়। যাত্রাপথে অনেক সময়ই বিকল হয়ে যায় আবার অনেক চালক গাড়িতে এসি ছাড়তে চান না।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহবুব আলম বলেন, উবার আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অনেক সহজতর করে দিয়েছে। কিন্তু চালকদের খারাপ ব্যবহারের কারণে কোম্পানিটি তাদের ইমেজ হারাতে বসেছে।’

তাসমিন সুলতান নামে এক গৃহবধূর অভিযোগ, অনেক চালকের পথ চেনার দক্ষতা নেই। এটা অনেক ভোগান্তির সৃষ্টি করে। আবার অনেক চালক খারাপ ব্যবহার করেন এবং যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা চেয়ে বসেন।

এ বিষয়ে নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা উবার থেকে গুণগত ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সেবা প্রত্যাশা করি। শুরুর দিকে কোম্পানিটি ভালো সেবা দিলেও ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করেছে। কোম্পানিটির সেবা নিয়ে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে মাঝে মধ্যেই হতাশার কথা শুনতে পাই। কোম্পানিটির বেশিরভাগ চালকই গুণগত সেবা দেয়ার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। এ জন্য প্রায়ই তারা যাত্রীদের সাথে খারাপ ও প্রথাগত ব্যবহার করে থাকেন।

খারাপ আবহাওয়া বা ব্যস্ততম সময়ে উবারের ভাড়া বৃদ্ধি পায় জানিয়ে অধ্যাপক নজরুল বলেন, কোম্পানিটি থেকে আস্থা হারানোর জন্য এটাও একটা বড় কারণ। আবার নগরবাসীর জন্য গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং কোম্পানির কাজকর্মে সরকারেরও শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থা থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

অপর নগর বিশেষজ্ঞ ইকবাল হাবিব বলেন, রাইড শেয়ারিং কোম্পানির কার্যক্রমে সরকারের তদারকি বা নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে দেশের বিদ্যমান পরিবহন খাতের সংস্কৃতির সাথে আপোষ করায় উবারের মান খারাপ হয়েছে। উবার কর্তৃপক্ষ যখন বুঝতে পারে যে বাংলাদেশে তাদের ইচ্ছামতো কিছু করা সম্ভব তখন তারা মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিতের পরিবর্তে কেবল অর্থ উপার্জনে মনোনিবেশ করা শুরু করেছে। তাই নগরবাসীর জন্য গুণগত সেবা নিশ্চিতে সরকারকে অবশ্যই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

রাইড শেয়ারিং অ্যাপের মাধ্যমে কতগুলো গাড়ি নিবন্ধন করা যাবে সরকারকে সেটাও নির্ধারণ করে দেয়া উচিত বলে মনে করেন হাবিব।

অভিযোগ প্রসঙ্গে উবারের বাংলাদেশ প্রধান জুলকার কাজী ইসলাম জানান, তারা সেইসব যানবাহনেরই নিবন্ধন দেন, যেগুলো সরকার রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। তবে মানহীন যানবাহনকে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা আমাদের রয়েছে এবং সেগুলো আমাদের সেবা থেকে বের করে দিচ্ছি।

তিনি আরও জানান, তাদের কোম্পানি এখন ১৯৯২ সালের পরে আসা মডেলের গাড়িগুলোকেই কেবল নিবন্ধন দিচ্ছে। পর্যায়ক্রমে মডেলের উন্নতি ঘটানো হবে। তবে আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিশ্চিত করার ব্যর্থতা স্বীকার করে জুলকার বলেন, তারা উন্নতির চেষ্টা করছেন।

চালকদের ব্যবহার পরিবর্তনে আমরা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। অভিযোগ পেলে আমরা চালকদের সাথে কথা বলে উদ্বুদ্ধ করছি। তবে তারপরও যারা ব্যবহার বা আচারণে পরিবর্তন আনছেন না তাদের এ প্লাটফর্ম থেকে বের করে দিচ্ছি।

ইউএনবি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত