আমাদের গেরিলারা: অপারেশন সেপ্টেম্বর

প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০১৯, ১৪:৩৫

ফুলার রোডের আবাসিক এলাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স কোয়ার্টার। এগারো নম্বর বিল্ডিং এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে মিলন। সন্ধ্যার পর লোকজন খানিক কম। ওর এক পকেটে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, উপরে ঢোলা জামা দিয়ে ঢাকা। অন্য পকেটের মধ্যে দুটি ডেটোনেটর। ওর কোন ভয়ডর নেই! 'মাল' দুইডা মোহনের কাছে পৌছে দিতে হবে।

খুররম বিল্ডিং এর দিকে এগিয়ে যায় খুব সাবধানে। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ কোমরে বাঁধে আর ডেটোনেটর দুইটা পকেটে নেয়। পাশেই একটা বড় কড়ই গাছ।ওটার নীচে অন্ধকারে দুইটা ছায়া মূর্তি। খুররম ক্ষীন কন্ঠে বলে ওঠে 'জয় বাংলা' ছায়ামূর্তি দুইটাও 'জয় বাংলা' বলে প্রতি উত্তর দেয়।

সলিমুল্লাহ হলের পূর্বপাশে, তেঁতুল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ংকর এক ট্রান্সফর্মার! এক আলমারি সমান উচ্চতা ওটার। সারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলো দেয়, এই ট্রান্সফর্মার ধ্বংশ করতে হবে। পাকীদের বোঝানো দরকার গেরিলারা এখনো শেষ হয়ে যায় নাই। এই অপারেশনের মাষ্টার মাইন্ড মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, ঢাকা মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আর তিন এই তিন সদস্যের গেরিলা দলের নেতা মোহন!

ঢাকা শহরে সন্ধ্যার পরই রাতের কার্ফূ! কোন মানুষের চলাচল নেই এর মধ্যে শুধু মিলিটারী ট্রাকগুলো ঘড়ঘড় করে এগিয়ে চলে নতুন কোন লাশের নেশায়!

সেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখ, উনিশশো একাত্তর। সতেরো বছরের কিশোরের চোখে কোন ভয়ডর নেই! গুটি গুটি পায়ে পলাশীর ছোট গলি দিয়ে খুররম এগিয়ে যাচ্ছে। ওর সাথে দলের নেতা মোহন আর ওর আরেক বন্ধু মঞ্জু। গেট দিয়ে বের হতে পারে নাই।গেটের পাশে দোতলা প্যাগোডা বিল্ডিং সেখানে থাকে এক অবাঙ্গালী পরিবার। এক মেজরের আগমন ঘটেছে সেখানে, মেজর সাহেব দু'একদিন পরপরই এই বাড়ীতে আসে। আজ খুররমদের ভাগ্য খারাপ তাই মেজর সাহেবের আগমন ঘটেছে আর তার গাড়িটিও মুল গেইটে রাখা, ড্রাইভার মনের সুখে গান গাইছে। তাই খুররম, মঞ্জু আর মোহন পেছনের দেয়াল টপকে বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। মেইন রাস্তায় উঠে ডানে বায়ে তাকায় কোন যানচলাচল নেই। দূরে কোথাও কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওঠে, ওরা তিনজনে আবার আড়ালে চলে যায়।

অপারেশন এর টাইম সাড়ে আট, এখনো সময় আছে প্রায় আধা ঘন্টা। তাই ওরা আস্তে আস্তে ইকবাল ( বর্তমান জহুরুল হক হল) হলের ভিতরে মাঠের মধ্যে চলে যায়। মাঠের পশ্চিম কোনায় গিয়ে বসে থাকে নি:শব্দে। মোহন বলে, 'মঞ্জু তুই চইলা যা, লোক যত কম হইব, ততই ভালো'। মঞ্জুর মন সায় দেয় না যেতে তারপরেও পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে ও বিদায় নিয়ে চলে যায়। গেরিলা দল তিনজন থেকে দুইজনে পরিনত হয়। মোহন আর খুররম।

সলিমুল্লাহ হলের গেটের অবাঙ্গালী দারোয়ান আশেপাশে নেই। খুররমের কোমরে বাধা এক্সপ্লোসিভ আর ডেটোনেটর গুলোকে মোহন নিয়ে নেয়। কাজ শুরু করে ওরা। তাড়াতাড়ি খুব তাড়াতাড়ি। মোহন পকেট থেকে পিস্তল বের করে খুররমের হাতে দেয়। খুররমের দায়িত্ব মোহনকে কাভার দেয়া। স্টীলের ট্রান্সফর্মার, ওটার গায়ে প্লাস্টিক একপ্লোসিভ লাগে না!তাছাড়া ওদের পূর্ব অভিজ্ঞতাও নেই। মোহন তাড়াহুড়ো করে।

- ওই কিরে লাগাছ না ক্যা?
- এইডাতো লাগে না, স্টীলের, আমি কি করুম।
- তাইলে এক কাজ কর ট্রান্সফর্মারের নীচের দিকে লাগা।
- আইচ্ছা তাই করতেসি।

মোহনের একাগ্রতা এক্সপ্লোসিভ লাগানোতে। ওদের আগ্রহ ট্রান্সফর্মার ধ্বংশের। পাকিস্থানীদের বোঝাতে হবে গেরিলারা এখনও মরে নাই।

হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয় হলের দারোয়ান! ওর কাঁধে বন্দুক, আওয়াজ তোলে 'ইধার কৌন হে'! 'তুমারা মুক্তি লোগ?'! খুররমকে এই ব্ল্যাক আউটের সময় এখানে দেখে দারোয়ান অবাক হয়েছে। খুররম তাকে সময় দেয় না, গিয়েই পিস্তল তাক করে। দারোয়ানও তার বন্দুক ফেলে হাত তুলে দাঁড়ায়। খুররম ওকে বলে দেয় কাউকে যেন না বলে আমরা এখানে আছি।আর বন্দুকটা নিয়ে নেয়। এটাই ছিল ওদের ভুল সিদ্ধান্ত!

মোহনের এদিকে কোন খেয়াল নেই, ও ব্যস্ত আছে এক্সপ্লোসিভ লাগানোতে। ঘড়ঘড় আওয়াজে ওদের হঠাত খেয়াল হয়। ট্রান্সফর্মারের নীচ থেকে মাথা উচু করে সামনে তাকায় মোহন। ওদের আর পালাবার সুযোগ নেই, পাকিস্থানী সৈন্যবাহি দুটি ট্রাক, একটি জিপ আসছে পলাশীর ওদিক থেকে, ওদের থেকে মাত্র একশ গজ দূরে। দুই কিশোরের ভেতরের পানি শুকিয়ে যায়, ওরা জানেনা ওরা এখন কি করবে!

বর্ষায় বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড় গুলোকে এখন ওদের কাছে মায়ের গর্ভের মত নিরাপদ মনে হয়! দুইজনে শুয়ে পড়ে ওই ঝোপের মধ্যে। মোহন এখনও এক্সপ্লোসিভ লাগাতে পারে নাই। আর্মির দুটি ট্রাক আর একটি জীপ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে আলোয় ভেসে যাচ্ছে রাস্তা। আর্মিদের হেলমেট দেখা যাচ্ছে, ওদের কথা বার্তাও শোনা যাচ্ছে। ট্রাকের উপরে গানার দাঁড়িয়ে আছে! দুই কিশোর সবই দেখছে, একটু নড়াচড়াই ওদের মৃত্যু নিয়ে আসবে। ওরা দু'জন দাত কামড়ে পড়ে থাকে নিজেরাই নিজেদের হৃদপিন্ডের আওয়াজ শোনে!

আর্মিরা চলে যায়, ওদের দ্যাখে নাই! মোহন কাজে লেগে যায়। এক্সপ্লোসিভ লাগানো শেষ। ডেটোনেটর বসিয়েছে। সিগারেট ধরায় খুররম। মোহন ওর কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে জোরসে দুই টান মেরে ডেটোনেটরে আগুন ধরায়, নীলচে আলো হিস হিস করে জ্বলতে থাকে। চারিদিক নীলাভ হয়ে ওঠে, দুই কিশোর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। সময় তিরিশ সেকেন্ড, পালাতে হবে ওদের!

ওরা দেয়াল টপকিয়ে দৌড়তে থাকে ফুলার রোড ধরে। পেছনে যাওয়ার উপায় নেই কারন ছেড়ে দেয়া অবাঙ্গালী দারোয়ান রাজাকারদের কাছে খবর পৌছে দিয়েছে। সবাই শব্দ করে আসছে সলিমুল্লাহ হলের দিকে।ডানে দেয়াল- বামে দেয়াল! ওরা শুধু দৌড়াচ্ছে,সামনের দিকে। সামনে থেকে যদি রাজাকার কিংবা বিহারী অথবা আর্মির কেউ দেখে ফেলে তাহলে ওদের আর পালাবার পথ নেই। তবুও ওরা দৌড়াচ্ছে। খুররম কয়, 'মোহন ঠিক কইরা লাগাইছোত? ফুটবো তো?'। মোহন কয়, ' দৌড়া, কথা কইছ না'!

ওরা ফুলার রোডের টিচার্স কোয়ার্টারের গেটে পা দিবে ঠিক এমন সময়, 'বুম'! চারিদিক হঠাৎ আলোয় ভরে যায়, তারপর অন্ধকার! দুই কিশোর কোয়ার্টারের ভিতর অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, কেউ জানতেও পারে না ওরা কারা ছিল!

জাহানারা ইমাম তাঁর ডায়েরীতে এ ঘটনাই লিখেন এইভাবে, ' টেবিলে এফতার সাজাচ্ছি শরীফ, জামী, মাসুম ওযু করে এসে জড় হচ্ছে, হঠাৎ কানে এল একটা শব্দ, বু- ম- ম- ম! শরীফ শিওরে উঠলো, বড় পরিচিত শব্দ, গত এক মাসে খুব কম শুনেছি এ শব্দ। আজ শব্দটা বেশ পরিষ্কার, জোরালো।

হাসি হাসি মুখ নিয়ে শরীফ এসে বসলো একটা চেয়ারে, মৃদু স্বরে বললো, শুনলে?

'শুনলামতো বেশ দূরে মনে হল'

'এখন থেকে কাছেও শুনবে'

'তার মানে?'

'নতুন চালান এসেছে' 
তিনি ভাবেন এদেশ স্বাধীন হবেই।

পাদটীকা: খুররম ভাই একজন মাইন ইঞ্জিয়ার, এখন অবসর যাপন করছেন। তিনি একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। আমি, আরিফ রহমান আর জয় হাসান অপু মিলে উনার কাছ থেকে ৫ সেপ্টেম্বরের এই অপারেশনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তার উপর ভিত্তি করে লেখা এই 'গেরিলা-২' পর্বটি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত