বিবিসি বাংলায় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার

‘ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু, এসব গুজব’

প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০১৯, ২৩:৩৭

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘গণমাধ্যমে ডেঙ্গু বিষয়ক খবর অনেক বেশি প্রকাশিত হচ্ছে এবং এর ফলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে, আর সেটাই সমস্যা সৃষ্টি করছে।’

আজ ৬ আগস্ট (মঙ্গলবার) বিকেলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটু উচ্চবিত্ত যারা, সেই সব জায়গাগুলোতেই এর প্রকোপ বেশি। আমাদের সব সময় লক্ষ্য থাকে বস্তি এলাকা, ড্রেন এ সব দিকে। মশা মারা কিন্তু নিয়মিত একটা ব্যাপার।’

বিবিসির নারী সাংবাদিক মানসী বড়ুয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গণতন্ত্র, ডিসেম্বরের নির্বাচন, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, পদ্মা সেতুতে কাটা মাথা, ডেঙ্গু পরিস্থিতি, এডিস মশার ওষুধ কেনায় ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘মশার ওষুধ কেনার ব্যাপারে টেন্ডার করা হয়। যারা টেন্ডারে উপযুক্ত হয়, তারা কিনে নিয়ে আসে এবং সেগুলো ব্যবহারও হয়। তবে কোন ওষুধ এডিস মশার ওপরে কাজ করে, সেই ব্যাপারে বিভক্তিকরণ করা হয়নি বা সেই ধরনের সতর্কতা ছিল না।’

বিবিসির প্রশ্ন, সরকারি হিসাবেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং এর সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে কীভাবে ভবিষ্যতে মশা নিয়ন্ত্রণ আরও সুষ্ঠুভাবে করা যায়?

জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং সরকারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে আহ্বান করা হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশেই একটা পরিচ্ছন্নতা অভিযান দরকার।’

তিনি বলেন, ‘কারো ঘরের কাছে বা ঘরে কোথাও যদি পানি জমা থাকে এবং সেখানে মশার লার্ভা তৈরি হয়, তবে তাদের জরিমানা করা হবে। মানুষ যদি আগামীর জন্য প্রস্তুত থাকে, তবে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি হবে না।’

বিবিসির প্রশ্ন, যে সব দেশ দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ তাদের একটি, কিন্তু এর সুফল সব পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে কিনা? জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই পৌঁছাচ্ছে। সেভাবেই আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি। ২০০৫ বা ২০০৬ সালের দিকে আমাদের দারিদ্র্যের হার ৪১ ভাগের ওপরে ছিল। আজকে সেটা ২১.৪ ভাগে নেমে এসেছে। মাত্র ১০ বছরের মধ্যে আমরা সেটা অর্জন করতে পেরেছি। মানুষের মাথাপিছু আয় যেখানে ৪০০-৫০০ মার্কিন ডলার ছিল, আজকে সেখানে প্রায় ২ হাজার মার্কিন ডলারে উঠে এসেছে। প্রবৃদ্ধি আমরা এখন ৮.১ শতাংশ অর্জন করতে পেরেছি।’

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন বেশ নাজুক অবস্থায় আছে এবং ঋণখেলাপিরা হাজারো কোটি টাকা নিয়ে তা আর ফেরত না দেওয়া সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যতটা প্রচার হয় বিষয়টা ততটা না। ঋণ নিয়ে সেটা ফেরত না দেওয়া—এই কালচারটাও আমাদের এখানে শুরু হয় সামরিক একনায়কদের (মিলিটারি ডিক্টেটর) আমলে। আমরা যখন ক্ষমতায় এসেছি আমরা চেষ্টা করেছি, আমরা অনেক টাকা উদ্ধার করেছি। তারপরও কিছু মানুষের প্রবণতা থাকে যে টাকা নিলে মনে হয় সেটি আর ফেরত দিতে হবে না।’

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের নানা প্রশ্ন সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশে এখন ৪৪টি বেসরকারি টেলিভিশন আছে। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করছে। স্বাধীনতা না থাকলে তারা আমার বিরুদ্ধে বা সরকারের বিরুদ্ধে এত অপপ্রচার করছে কীভাবে?’

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অনেক কেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোট পড়া নিয়ে সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেটা এখন কোনো কেন্দ্রে গোনার দিক থেকে হয়তো পেয়েছে। কোনো কেন্দ্রে হয়তো হতে পারে। কিন্তু আমাদের ট্রাইব্যুনাল আছে, সেখানে মামলা করতে পারে, কোর্টে মামলা করতে পারে। নির্বাচন কমিশনও মামলা করতে পারেন। তাঁরা তদন্ত করে দেখছেন।’

ভোট দিতে না পারা এবং আন্দোলন সংক্রান্ত বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ যদি সত্যিই ভোট দিতে না পারত, তাহলে তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ আন্দোলনে নামত এবং আমরা ক্ষমতায় থাকতে পারতাম না।’

সাক্ষাৎকারে পদ্মা সেতুতে মানুষের কাটা মাথা লাগার গুজব এবং এর জেরে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যুর বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা গুজব ছড়াচ্ছে, এরকম কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ এ সময় তিনি গুজবে কান না দেয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও অমানবিক কায়দায় অত্যাচারের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এমন মানসিকতা আমাদের নেই এবং আমরা সেটি করি না। ঘটনাচক্রে কিছু ঘটতে পারে। বরং গত ১০ বছরে আমাদের অবস্থান দেখলে বোঝা যাবে আমরা কিন্তু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পেরেছি।’

তিনি বলেন, ‘একশ্রেণির মানুষ হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে ‘অপপ্রচার’ চালাচ্ছে। এরা সেই মানুষ যারা সারাক্ষণ খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আমাদের পেছনে লেগেই আছেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার নিজের কথাই চিন্তা করুন, যখন আমি আমার মা-বাবাসহ সবাইকে হারালাম, গুলি করে মারা হলো। কই আমি তো বিচার পাইনি। খুনিদের বিচার না করে তাদের ইনডেমনিটি দেওয়া হলো। অর্থাৎ অপরাধকে প্রশ্রয় দিলেন। উল্টো তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে। যে দেশে অপরাধকে স্বীকৃতি দিয়েই একটা সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, সেই দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। হেফাজতে মানুষ হত্যা করার সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী আমার দলের নেতা-কর্মীরা।’

নির্যাতনের সংস্কৃতি বন্ধে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। এখন ঠিক ওইভাবে হেফাজতে মৃত্যু হয় না। নির্যাতনও সেভাবে করা হয় না।’

আন্তর্জাতিকভাবে অপরাধীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহে কিছু নিয়ম রয়েছে, এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর বাইরে কিছু করা হয় না। আওয়ামী সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।’

শেখ হাসিনা আরো উল্লেখ করেন, ‘স্বাধীনতার পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতিকে হত্যার ঘটনার পর থেকে অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়ার সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। অসাংবিধানিক সরকারের সময় যারা বেশি সুযোগ ভোগ করেছে বা ক্ষমতাটা যারা উপভোগ করেছে, তারা কখনোই চায়নি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে রয়েছেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর এই সাক্ষাৎকার নেন বিবিসি বাংলার সাংবাদিক মানসী বড়ুয়া।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত