কর্নেল তাহেরের চিঠি: 'প্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা'

প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০১৯, ১৬:৩০

সাহস ডেস্ক

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৪ নভেম্বর নিজের জন্মদিনে কামালপুর দখলের সম্মুখ সমরে গুরুতর আহত হন তাহের। বাম পা হাঁটুর উপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে খানিকটা সুস্থ হয়ে ২৮ নভেম্বর তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখেন। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ গড়ার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন।

ঐতিহাসিক চিঠিটি পাঠকদের জন্য তুলে দেওয়া হলো।  

বেস হসপিটাল, ২৮ নভেম্বর, ১৯৭১ ইং

প্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা,
বর্তমানে আমি অনেক ভালো। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে আরো বেশ সময় লাগবে। কামালপুরে কিছুক্ষণের জন্য যা দেখেছি তা অপূর্ব। তোমরা সম্মুখযুদ্ধে যে রণকৌশলের পরিচয় দিয়েছ তা যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল। কামালপুরের যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের ও রণকৌশলের স্বাক্ষর। তোমরা নিয়মিত বাহিনীকেও হারিয়ে দিয়েছ। যতদিন না আবার আমি তোমাদের মধ্যে ফিরে আসি, আশা করি সংগ্রাম চালিয়ে যাবে সাফল্যের পথে। আমাদের সাফল্য হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি নিয়মিত সৈন্যদের হত্যা করা। গেরিলা যুদ্ধের নীতি ও তোমাদের করণীয় সম্বন্ধে আবার তোমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি। 

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নীতি-শত্রুকে খুঁজে বের কর এবং হত্যা করো। এই নীতির ওপর ভিত্তি করে এবারের যুদ্ধ গড়ে উঠেছে। এই নীতির যদি কোথাও ব্যতিক্রম হয়, তবে তোমরা শত্রুর হাতে মার খাবে। ব্যাধ যখন শিকারে বের হয় সে শিকারকে খুঁজে বেড়ায় এবং অনুসরণ করে তাকে হত্যা করে। তেমনিভাবে তোমাদের মধ্যে সে ব্যাধের শিকারি মনোভাব যদি না জাগে, তবে শত্রুকে হত্যা করতে পারবে না। শত্রুকে খুঁজে বের করে হত্যা করতে হলে তোমাদের সব সময় চলার মধ্যে থাকতে হবে। এই চলার মধ্যে থাকাই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ নিরাপত্তা। গুপ্ত ঘাঁটি সম্বন্ধে তোমাদের মনে অনেক ভ্রান্ত ধারণা আছে। বাংলাদেশে গুপ্ত ঘাঁটি স্থাপন করা বেশ কঠিন। তোমাদের অবস্থান সম্বন্ধে শত্রুর কাছে খবর পৌঁছাবেই শত্রুর ছড়ানো চরদের মাধ্যমে। কাজেই বলি, কোনো জায়গায় যদি খোলাখুলি বেশি দিনের জন্য অবস্থান করো তবে তোমরা তোমাদের নিরাপত্তা বিপন্ন করবে। 

তোমাদের জানতে হবে আমাদের শত্রু কে? এ ক্ষেত্রে তোমাদের মনে অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। আমাদের প্রধান শত্রু পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনী। এই বাহিনী আমাদের বাংলাদেশ জবরদখল করে আছে, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে, নারী-পুরুষ-শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করছে ও নারীদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালাচ্ছে। পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীকে যদি আমরা বিনাশ করি, তাহলে বাংলাদেশ মুক্ত হবে। রাজাকার, আলবদর ও দালালরা পাকিস্তানি বাহিনীর উপস্থিতিতে সৃষ্টি হয়েছে। এ পরগাছাদের ওপর, শত্রু পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীর ওপর আঘাত হানো প্রচণ্ডভাবে। যখন পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে থাকবে না, তখন দেখবে রাজাকার, আলবদর ও দালালরা বাংলাদেশে থেকে সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নিয়েছে। যেসব বাঙালি ভ্রান্ত পথে রয়েছে তাদেরকে পথ দেখানো তোমাদের কর্তব্য। রাজাকার, আল বদরদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন কর এবং তাদেরকে দলে দলে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করতে বল। 

জনসাধারণের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্ক সম্বন্ধে তোমাদের কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। তোমরা স্বাধীন বাংলার জন্য যুদ্ধ করছো। কাজেই তোমরা ভাব জনসাধারণের কাছ থেকে যা খুশি তাই নিতে পারবে। ২৬ মার্চের পর জনসাধারণের যে বিপুল সমর্থন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই সমর্থন ছিল বলেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন তোমাদের উচিত এই জনসমর্থনকে আরও সুদৃঢ় করা। এই সমর্থনকে তোমাদের অনেকেই নষ্ট করতে পারে। জনসাধারণের কাছ থেকে তোমরা যদি টাকা, পয়সা, খাবার, আশ্রয় ছিনিয়ে নাও তবে জনসমর্থন নষ্ট হয়ে যাবে এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কোন পথ থাকবে না। তোমরা যুদ্ধ করছো জনসাধারণের জন্য। বাংলাদেশ স্বাধীন করা, জনগণকে অভাব, দুঃখ, অশিক্ষা থেকে মুক্ত করা এ যুদ্ধের লক্ষ্য। তোমাদের আচরণের মধ্যে দিয়ে যেন জনসাধারণের মাঝে সেই লক্ষ্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

জনগণকে নিয়েই একটা দেশ। বাংলার অগণিত কৃষক যারা দেশের সর্বপ্রধান শ্রেণী, তাদের মুক্তির জন্য এ যুদ্ধ। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনগণকে মুক্তির আলো দেখাও, তাদেরকে শিক্ষিত করো, যেন স্বাধীন বাংলাকে তারা একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে তুলতে পারে। যখনই তোমরা কারো বাড়িতে আশ্রয় নাও, তোমাদের উচিত তাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজে সাহায্য করা। এ কাজ তোমাদের কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম করবে এবং তারা পরিস্কার বুঝতে পারবে তোমরা কাদের জন্য যুদ্ধ করছো। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ জুলুম করে, মেয়েদের শালীনতা নষ্ট করে তবে তাদেরকে জনসাধারণের দ্বারা বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে দ্বিধা করবে না। শৃঙ্খলা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সফল হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধে তোমরা অনেকে একত্রে থাকছো। কাজেই তোমাদের একটা দলীয় শৃঙ্খলার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। 

সর্বস্তরের যুদ্ধে নেতার আদেশ পালন করা, এক অপরের কাজে সহায়তা করা এই শৃঙ্খলার ভিত্তি। এই শৃঙ্খলা না থাকলে তোমরা সমবেতভাবে কোনো কাজ সমাধা করতে পারবে না। দলের কেউ যদি এই শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে তবে তাকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। দ্বিতীয় প্রকার শৃঙ্খলা হলো ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা। এ ব্যক্তিগত শৃঙ্খলাই তাকে সব অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, তার মনে সাহস জোগায় এবং তাকে এক আদর্শ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ব্যক্তিগত শৃঙ্খলার ওপর তোমাদের সবার জোর দেওয়া উচিত। 

তোমরা তরুণ। তোমরা একটি পবিত্র ইচ্ছা নিয়ে বাংলাদেশে স্বাধীন করতে নেমেছো। বাংলাদেশ তোমাদের জন্য গর্বিত। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব তোমাদের। 

জয় বাংলা
মেজর আবু তাহের 

সহায়ক বই: মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের, ড. মো. আনোয়ার হোসেন। প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত