সারাদেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০১৯, ১৮:২১

সারাদেশে বন্যায় এখন পর্যন্ত ২০ টি জেলা প্লাবিত হয়ছে। সুরমা ও কুশিয়ারা ব্যাতীত দেশের প্রায় সকল নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের মতে দেশে এবার ভয়াবহ বন্যার আশংকা না থাকলেও মাঝারি মানের প্লাবনের শংকা রয়েছে। তাদের মতে আগামী সপ্তাহের মাঝে বন্যার পানি কমে গেলেও আগস্ট মাসে তা বেড়ে বর্তমানের চেয়ে অধিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে গত ১৫ জুলাই বিভিন্ন নদ-নদীর ৯৩টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ২৬টি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। আবার আগের দিনের তুলনায় ৬৮টি পয়েন্টের পানির স্তর বেড়েছে এবং ২২টি পয়েন্টে কমেছে। ওই সূত্র অনুসারে গতকাল সকাল ৯টার পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টার হিসাবে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ২০৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের দেওয়ানগঞ্জে সর্বোচ্চ ১৫০, দুর্গাপুরে ১৩৫, নাকুয়াগাঁও ও ভৈরব বাজারে ১৩০, নরসিংদী ১০৯, কমলগঞ্জে ১০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৬ জেলার ৫৩টি বন্যাকবলিত উপজেলায় ১০ জুলাই থেকে পানিতে ডুবে সাতজন, সাপের কামড়ে দুজন ও বজ্রপাতে তিনজনের মৃত্যুর খবর তাদের কাছে এসেছে। এ ছাড়া অসুস্থ ও আহত হয়েছে এক হাজার ২২৫ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ডায়রিয়া। আর বন্যাকবলিত এলাকায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক হাজার ২৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্র ঘিরে এক হাজার ৫৪৩টি মেডিক্যাল টিম কাজ শুরু করেছে।

সারাদেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি সংক্ষিপ্ত আকারে নিচে তুলে ধরা হল-

বিপৎসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার উপরে যমুনা; প্লাবিত সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জের কাজিপুর পয়েন্টে যমুনা বিপৎসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে।  উপজেলার নতুন নতুন এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্রবল স্রোতে নাটুয়ারপাড়া এলাকা রক্ষা বাঁধের মাথায় দেখা দিয়েছে ধস। গতকাল দুপুর পর্যন্ত বাঁধের প্রায় ৩০০ মিটার ধসে গেছে। বাঁধের ভাঙা অংশে দুপুর থেকে জিও ব্যাগ ফেলে ধস রক্ষার চেষ্টা চলছে।

সুনামগঞ্জে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

সুনামগঞ্জের দিরাই, শাল্লা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুরের বিভিন্ন গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। অপরিবর্তিত আছে সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশার বন্যা পরিস্থিতির।

সরকারি হিসাবে এক লাখ চার হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। দিরাই ও শাল্লা উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকার প্রায় দুই হাজারেরও বেশি ঘর-বাড়ি এবং কিছু পাকা ও আধা পাকা রাস্তা তলিয়ে গেছে। ৩৫টি বিদ্যালয় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

বানিয়াচংয়ের হাওর প্লাবিত; ভেঙ্গে গেছে বাঁধ

হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে। এতে বোনা আমন ধানের জমি, রোপা আমন ও আমনের বীজতলা তলিয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে বানিয়াচংয়ের মার্কুলি বাজারের একাংশ তলিয়ে গেছে। বানিয়াচংয়ের কড়চা গ্রামের পাশে নিকলীর ঢালা ভেঙে বিপুল বেগে পানি ডুকে পড়ছে হাওরে। হবিগঞ্জে গতকাল দুপুরে খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমার ১৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং কুশিয়ারার পানি ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শহররক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে।

বিশ্বনাথে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত; ডুবেছে বীজতলা

সিলেটের বিশ্বনাথে সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সুরমা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লামাকাজি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কয়েকটি গ্রামের রাস্তাঘাট, স্কুল মাঠ এরই মধ্যে পানির নিচে। বাড়ির বসত ঘরে এখনো পানি ওঠেনি, তবে ছুঁই ছুঁই করছে। সিলেটের বিয়ানীবাজারে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর সবকটি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উপজেলার ১৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

অপরকল্পিত নগরায়ণ; পানিবন্দী মানুষ

কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া পৌর এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা, অপরিকল্পিত বাসাবাড়ি নির্মাণ ও পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে ফেলায় এ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে বাড়িঘর, স্কুল-কলেজের মাঠ, ফসলি জমি, আমন ধানের বীজতলা, পানের বরজ ও ফিশারিসহ রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। নেত্রকোনার কলমাকান্দায় ভেসে গেল সাত কোটি টাকার মাছ।

চার নদ-নদীতে বিপর্যস্ত জামালপুর; শিশুর মৃত্যু

যমুনা নদীসহ জামালপুরে ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরাম ও ঝিনাই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত ১৫ জুলাই বিকেল থেকে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়েছে। এ উপজেলায় এক লাখ ৩৩ হাজার ২২১ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত। বন্যার পানিতে ডুবে গতকাল উপজেলার পৃথক স্থানে তিন শিশু মারা গেছে। মেলান্দহ উপজেলার গ্রামে নবম শ্রেণির এক ছাত্র বাড়ির পাশে বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে পানির স্রোতে ডোবায় পড়ে নিখোঁজ হয়েছে।

শ্রীবরদী প্লাবিত; ডুবে গেছে ১৫ গ্রাম

শেরপুরের শ্রীবরদীর ছয়টি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ১৪ জুলাই রাত থেকে বর্ষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এতে পানিবন্দি হয়েছে চার হাজার পরিবার। কাঁচা ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, রোপা আমন ধানের বীজতলা, সবজি তলিয়ে গেছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।

দিনাজপুরে নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই; প্রধান ৩ নদী দায়ী

দিনাজপুরে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। প্রধান তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। ডুবে গেছে নতুন আমনের বীজতলা। কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। গতকাল দুপুরের পর উপজেলা চত্বরের কোথাও হাঁটু সমান আবার কোথাও কোমর সমান পানি দেখা গেছে। সরকারি খাদ্য গুদামের ভেতরে পানি ঢুকে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুই উপজেলায় ৯ ইউনিয়নের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।

আবারো যমুনা; বগুড়ায় পরিস্থিতির আরো অবনতি

বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নদীর পানি ২৮ সেন্টিমিটার বেড়েছে। সোমবার সকাল ৬টায় যমুনার পানি বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এতে ধুনট, সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ৬১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। তলিয়ে গেছে পাট, আউশ ধানসহ বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। গবাদি পশুর খাবার সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

তিস্তার পানি হ্রাস; কাটেনি বিপদ

গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি অব্যাহত বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ১১২ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদীর পানি ৭৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

অন্যদিকে তিস্তার পানি কিছুটা হ্রাস পেলেও এখনো বিপৎসীমার দুই সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় বন্যার কারণে ১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে। তিস্তা নদীর পানি কমছে। পানিবন্দি এলাকায় প্রয়োজনীয় ত্রাণ, শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

কুড়িগ্রামের উলিপুরে বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। জানা গেছে, ১৫ জুলাই দুপুরে ব্যাপারীপাড়া গ্রামের মাহবুব আলীর ছয় বছরের হাবিবুল্যাহ ছেলে বাড়ির পেছনে অন্য এক শিশুসহ খেলতে গিয়ে বন্যার পানিতে পড়ে যায়।

পাহাড়ি ঢল; রয়েছে ভারী বর্ষণও

ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট ও ফুলপুর উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ধোবাউড়ার সাতটি ইউনিয়নের ৪৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি আছে।

এদিকে হালুয়াঘাট উপজেলায় কৈচাপুর, সদর হালুয়াঘাট, গাজীরভিটা, বিলডোরা, শাকুয়াই, নড়াইল, ধারা, ধোরাইল, আমতৈল, স্বদেশী এবং বিলডোরা ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। ফুলপুর উপজেলায় ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ের ঢলে প্রায় আটটি ইউনিয়নের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভোলার চরফ্যাশনে সপ্তাহখানেক ধরে একটানা বর্ষণে এলাকায় বেশ কয়েকটি গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। লাখ লাখ টাকার মাছ ভেসে যাচ্ছে।

বান্দরবানে পরিস্থিতির উন্নতি;সড়ক যোগাযোগ অষ্টম দিনের মতো বিচ্ছিন্ন

বান্দরবান জেলায় স্মরণকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড পরিমাণ (২১৪ মিলিমিটার) বৃষ্টিপাতে সব কিছু প্লাবিত করার পর গত ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। ১৫ জুলাই সকাল নাগাদ শহরের সব জায়গায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে অষ্টম দিনের মতো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে  অবরুদ্ধ অবস্থায় কাটাচ্ছে বান্দরবানবাসী।

সাহস২৪.কম/জুবায়ের/রনি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত