সবার নজর এখন ডাকসুতে

প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০১৯, ২৩:৫৯

সাহস ডেস্ক

টানা ২৮ বছর পর হতে যাচ্ছে দেশের ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন।

আগামীকাল ১১ মার্চ (সোমবার) সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে ডাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণ।

এইদিনটি নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন প্রায় ৪৩ হাজার শিক্ষার্থী। কেবল শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষক সমাজ, সাবেক শিক্ষার্থী, নেতাকর্মীদের এখন চোখ ডাকসুর দিকে। সকলের দাবি, এতদিনের লড়াই সংগ্রামের ফসল যে ডাকসু নির্বাচন সেটি যেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।

গত ২৮ বছর ৫ মাস ধরে ডাকসুর কোনও কার্যক্রম নেই। স্বাধীন দেশে গত ৪৭ বছরে এ নির্বাচন হয়েছে মাত্র সাতবার। সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। এর দীর্ঘ আট বছর পর ১৯৯৮ সালে ডাকসুর কমিটি ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ২৮ বছরেও সেই নির্বাচন আর হয়নি।

ডাকসু ভবিষ্যতের জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির কারখানা। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এবং পরবর্তীতে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ। ৬৯-এর অগ্নিঝরা দিনে ডাকসুর নেতৃত্বে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। স্বাধীন বাংলার পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব। স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসুর ভিপি হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান। এছাড়া স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সুলতান-মুশতাক পরিষদ ও আমান-খোকন পরিষদের ভূমিকা সর্বজনবিদিত।

এবার ডাকসুর ২৫টি পদে ১২টি প্যানেল থেকে ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট ২২৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে ভিপি (সহ-সভাপতি) প্রার্থী ২১ জন এবং জিএস (সাধারণ সম্পাদক) প্রার্থী ১৪ জন। এর সঙ্গে ১৮টি হল সংসদে ১৩টি পদে মোট ২৩৪টি পদে প্রার্থী ৫০৯ জন।

২০ ফেব্রুয়ারি ডাকসুর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। আর ৫ মার্চ প্রকাশ করা হয় সম্পূরক ভোটার তালিকা। এতে মোট ভোটার সংখ্যা ৪২ হাজার ৯২৩টি। দীর্ঘ ২৮ বছর পর হতে চলা এই নির্বাচনে সোমবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের একটানা ভোট গ্রহণ হবে। ১৮টি হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।

আসন্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার আহ্বান জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষক বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে শিক্ষকরা বলেন, আমরা অঙ্গীকার করছি যে, নির্বাচনের দিনে স্বেচ্ছাসেবী পর্যবেক্ষক দল হিসেবে ভোটকেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করবো এবং আমাদের অভিজ্ঞতা জাতির সঙ্গে শেয়ার করবো। এ সংক্রান্ত একটি আবেদনপত্র ডাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তার (চিফ রিটার্নিং অফিসার) কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এই নির্বাচনটি ঠিকঠাক মতো অনুষ্ঠিত হলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হবে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, ডাকসু না থাকাতেই ছাত্র রাজনীতিতে অছাত্ররাও ঢুকে পড়েছে। এই পরিস্থিতির অবসান প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এ নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবরই সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির দিতে তাকিয়ে থেকেছে। যদিও এটি বার্ষিক হিসেবে দেখা উচিত। এ জন্যে সরকারের ওপর নির্ভর করা উচিত নয়।’

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘সম্প্রতি নির্বাচনকে জাতীয়ভাবে বিকৃত ব্যবস্থা হিসেবে চাপিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। আইয়ুব খান পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করতে পারেনি। এবারেও একধরনের চেষ্টা আছে। তবে আমি বিশ্বাস করি অতীতের ইতিহাস ঐতিহ্য জারি রেখে ঢাবি শিক্ষার্থীরা সেই অপচেষ্টা প্রতিহত করবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘কেবল এবারই না, বছর বছরে ভোট হতে হবে। এটা এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজ না, কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজ। ভোটের তারিখ একাডেমিক ক্যালেন্ডারে নির্ধারিত থাকতে হবে। এটি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় কলেজেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দিন আহমেদ এখনকার শিক্ষার্থীদের চোখে ডাকসুকে দেখতে চান উল্লেখ করে বলেন, ‘পরিবেশ বদলে গেছে। এখন তোমাদের চোখ দিয়ে দেখছি। এখন যা ঘটছে ২৮ বছর আগে কেউ এসব চিন্তা করতো না।’

তিনি আরো বলেন, ‘গত দেড় দশক ধরে দেখছি, যারা ক্ষমতায় থাকে তারা হল দখল করে নেয়। অন্য দলগুলো হলে ঢুকতেই পারে না, হলের বাইরে থাকে। এ পরিস্থিতিতে আমরা ভালো কিছু আশা করি, কী আর করবো।’ অতীতের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিয়ন ব্যবস্থা জন্মের পরের বছরই শুরু হয়েছিল। সেসময় ছোট্ট লিফলেটে কার রেজাল্ট কেমন সেটাসহ পরিচয় লেখা থাকতো, আমতলার মিটিংয়ে কীভাবে কে কী বলে সেটাই ক্যানভাস এর ধরন। হলে হলে দৌড়াতে হতো না। যারা ক্ষমতায় আছে আর যারা যেতে চায় সবার আচরণ এক হয়ে গেছে।’

ডাকসু’র দাবি প্রাণ পায় আদালতে
উচ্চ আদালতে করা দুটি রিট আবেদনের কারণে দীর্ঘদিন পর ডাকসু নির্বাচনের জট খুলেছে। ২০১২ সালের ২১ মার্চ হাইকোর্টে রিট করেন ঢাবির ২৫ শিক্ষার্থী। একই বছরের ৮ এপ্রিল এই রিটে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলে ডাকসু নির্বাচন করার ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এরপর গত বছরের ১৭ জানুয়ারি রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ছয় মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। এরপরেও নির্বাচন সম্পন্ন না করায় ঢাবি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গত সেপ্টেম্বরে আদালত অবমাননার আবেদন করা হয়। সেসময় ছয় মাসের মধ্যে অর্থাৎ ১৫ মার্চের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে বলে হাইকোর্টকে চিঠি দিয়ে আবেদন দাখিল করলে আদালত অবমাননার আবেদনটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপরও ১ অক্টোবর ঢাবি কর্তৃপক্ষ ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে। ওই দিনই চেম্বার আদালত বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। এরপর ৬ জানুয়ারি ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন করতে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে থাকা স্থগিতাদেশ আপিল বিভাগ প্রত্যাহার করে নিলে হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে, ১৫ মার্চের মধ্যেই ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত