চাঁদপুর লোহাগড়া পিরোজপুর মুক্ত দিবস আজ

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৮:৩৩

সাহস ডেস্ক

চাঁদপুর, যশোরের লোহাগড়া ও পিরোজপুর মুক্ত দিবস আজ ৮ ডিসেম্বর। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন র‌্যালি, আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল ও শহীদদের কবর জিয়ারতসহ বিভিন্ন কর্মসূচির গ্রহণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

চাঁদপুর : দীর্ঘ ৯ মাস পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর শত্রু মুক্ত হয়।

লাকসাম ও মুদাফ্ফরগঞ্জ মুক্ত হবার পর তৎকালীন চাঁদপুর মহকুমা দিকে এগোতে থাকে হানাদার বাহিনী। ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ গভীর রাত পর্যন্ত হাজীগঞ্জের বলাখাল এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তি বাহিনীর দীর্ঘ যুদ্ধ হয়। ভারতের মাউন্ট্নে ব্রিগেড ও ইস্টার্ন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যৌথ আক্রমণ চালায়।দিশেহারা হয়ে পাকিস্তান ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল রহিম খান চাঁদপুর থেকে পলায়ন করেন। ৩৬ ঘন্টা তীব্র লড়াইয়ের পর ৮ ডিসেম্বর ভোরে জেলার হাজীগঞ্জ মুক্ত হয়। এর পর পাক হানাদার বাহিনী চাঁদপুরের উপর দিয়ে নদী পথে পালিয়ে যায়। তখন পাক হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল আব্দুর রহিম মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে আহত হয়। মাঝ নদী থেকে হেলিকপ্টার যোগে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর সকালে মিত্র বাহিনীর ট্যাঙ্কার লেঃ কর্নেল সুট্টির নেতৃত্বে চাঁদপুরে প্রবেশ করে। মিত্র বাহিনী চাঁদপুরে প্রবেশের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা চাঁদপুরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। ৮ ডিসেম্বর সকাল থেকে পাক হানাদার বাহিনী চাঁদপুর থেকে পালিয়ে যায়। প্রথমে চাঁদপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গণে ও পরে চাঁদপুর সদর থানা প্রাঙ্গণে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বিএলএফ কমান্ডার মরহুম রবিউল আউয়াল কিরন। এভাবেই ৮ ডিসেম্বর চাঁদপুরকে শত্রু মুক্ত করা হয় বলে জানান জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এম এ ওয়াধুদ।

দিবসটি উপলক্ষে আজ বিকেলে চাঁদপুরে মুক্তিযোদ্ধারা সমাবেশ করবেন। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আয়োজনে আজ বিকেল ৩টায় সংসদের জেলা কার্যালয়ের সামনে মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে মিছিল নিয়ে অঙ্গীকার বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর বিজয় মেলা প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

লোহাগড়া : ১৯৭১ সালের এ দিনে ৮ নং সেক্টরের অধীনে লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধারা সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে লোহাগড়া থানাকে পাক হানাদার মুক্ত করে উড়িয়েছিলেন বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা। লোহাগড়া থানা মুক্ত দিবস উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে র‌্যালি, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে আলোচনাসভা, দোয়া মাহফিল,শহীদদের কবর জিয়ারত এর আয়োজন করা হয়েছে।

লোহাগড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এর সাবেক কমান্ডার ফকির মফিজুল হক জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধে লোহাগড়া ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের অধীন। মধ্য নভেম্বরে মুক্তিযোদ্ধারা সমগ্র উত্তর অঞ্চল শত্রুমুক্ত করেন। এর পর মুক্তিযোদ্ধারা দক্ষিণাঞ্চলের প্রবেশ দ্বার লক্ষ্মীপাশায় অবস্থিত থানা আক্রমণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ৮ ডিসেম্বর ভোর ৫ টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ ইউনুস আলী, থানা মুজিব বাহিনীর প্রধান সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত শরীফ খসরুজ্জামান, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফার রহমান বিশ্বাস, আবুল হোসেন খোকন, মো: কবির হোসেনের নেতৃত্বে প্রায় দু’শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে পশ্চিম দিক দিয়ে থানা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিত আক্রমনে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাক বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় থানায় অবস্থানরত পাক হানাদার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য অস্ত্র গোলা বারুদ ফেলে থানার পূর্ব দিক দিয়ে পালিয়ে যায়। শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা ও পাক বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ। ৫ ঘন্টা ব্যাপী এ যুদ্ধ চলাকালে থানা অভ্যন্তরে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন উপজেলার কোলা গ্রামের অধিবাসী মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান ও যশোর সদর উপজেলার জঙ্গল-বাঁধাল গ্রামের মোস্তফা কামাল।

উল্লেখ্য যে, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানকে লোহাগড়া থানা চত্বরে কবর দেওয়া হয় আর মোস্তফা কামালকে ইতনা স্কুল চত্বরে কবর দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে তৎকালীন থানার ওসি সিরাজুল ইসলামসহ সূধী মহলের সহযোগিতায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের কবরটি টাইলস্ দিয়ে বাঁধানো হয়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামালের কবরটি ইতনা স্কুল চত্বরে রয়েছে।

থানা আক্রমণের সময় মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে কুখ্যাত রাজাকার ও পুলিশ সদস্য খালেক ও নড়াইলের আশরাফ রাজাকারসহ ২০ জনকে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে গ্রেফতার হয় ১০ জন পুলিশ সদস্যসহ ২২ জন রাজাকার। মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল সংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে নিজেদের আয়ত্বে আনেন। সকাল ৯ টার দিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ ইউনুস আলী থানায় স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দেন। থানা হানাদার মুক্ত হওয়ার খবরে উলাসিত মানুষজন স্বতস্ফুর্ত ভাবে আনন্দ মিছিল সহকারে রাস্তায় নেমে আসে। ৮ ডিসেম্বর সারা দিনই লোহাগড়া থানার বিভিন্ন এলাকায় জনতা বিজয় মিছিল করে। আমাদা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইউনুস গাজী বলেন, মুক্তিযুদ্ধে লোহাগড়ায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানানোর লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বরণে লোহাগড়ায় স্মৃতিসৌধ বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

পিরোজপুর : পিরোজপুর মুক্ত দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এ দিনে পিরোজপুর পাকহানাদার, রাজাকার ও আলবদর মুক্ত হয়। এই দিনে ঘরে ঘরে উড়েছিল লাল সবুজের বিজয় পতাকা। পিরোজপুরের ইতিহাসে এ দিনটি বিশেষ স্মরণীয় দিন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুর ছিল মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের অধীন সুন্দরবন সাব-সেক্টর মেজর জিয়াউদ্দিনের কমান্ডের আওতায়।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার ১৮ ঘন্টার মধ্যে পিরোজপুরের আওয়ামী লীগের নেতৃতাধীন মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্র গুলি নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করে ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়।

১৯৭১ সালের ৩ মে পিরোজপুরে প্রথম পাক বাহিনী প্রবেশ করে। শহরের প্রবেশদ্বার হুলারহাট নৌ-বন্দর থেকে পাকবাহিনীরা প্রবেশের পথে প্রথমেই তারা মাছিমপুর ও কৃষ্ণনগর গ্রামে শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। তারপর ৮টি মাস স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা ও রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা, সংখ্যালঘু ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকজনদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া হয়। হত্যা করা হয় ৩০ সহ¯্রাধিক মুক্তিকামী নারী-পুরুষ শিশুকে।

পিরোজপুরকে হানাদার মুক্ত করতে সুন্দরবনের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ৭ ডিসেম্বর রাত ১০টায় পিরোজপুরের দক্ষিণপ্রান্ত পাড়েরহাট বন্দর দিয়ে শহরে প্রবেশ করতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর এ আগমনের খবর পেয়ে পাক হায়নারা শহরের পূর্বদিকের কচানদী দিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যায়। এর আগে স্বরূপকাঠী পেয়ারা বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের গড়ে তোলা দূর্গে পাকবাহিনী আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে পাকবাহিনী পর্যুদস্ত হতে থাকে। অবশেষে ৮ ডিসেম্বর পিরোজপুর ছেড়ে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা পিরোজপুর অঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সম্ভ্রম লুটে নেয় প্রায় কয়েক হাজার মা-বোনের। পিরোজপুর মুক্ত দিবস উদযাপন পরিষদ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। সকাল সাড়ে ৯ টায় টাউন ক্লাব স্বাধীনতা চত্বর থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা শেষে শহীদ ভাগিরথী চত্বরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি স্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্বাধীনতা মঞ্চে স্মৃতিচারণ। সন্ধ্যা ৬টা ১ মিনিটে মোমবাতি প্রজ্জলন ও আলোর মিছিল। এছাড়া উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সন্ধ্যা ৭ টায় টাউন ক্লাব স্বাধীনতা মঞ্চে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত