আজ রেজাউল করিম মানিকের শহীদ হবার দিন

প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০১৮, ১১:১২

শাওন মাহমুদ

আজ ১৪ই নভেম্বর, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের পথে আত্মদানকারী, শহীদ রেজাউল করিম মানিকের শহীদ হবার দিন। দুই নম্বর সেক্টরের অধীন ঢাকা উত্তর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন শহীদ মানিক। ধামরাই ও সাভার অঞ্চল ছিল মানিক বাহিনীর অধীনে। কৌশলগত কারণেই এ অঞ্চলের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পাকি শকুনের দলের যোগাযোগ ও রসদ পরিবহনের অন্যতম রাস্তা ছিল ঢাকা আরিচা মহাসড়ক। শহীদ মানিক এবং তাঁর অধীনস্থ বাহিনী এ অঞ্চলে পাকিস্তানী সেনাদের ত্রাস হয়ে আবির্ভূত হন।

রেজাউল করিম মানিক ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস (সম্মান) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এতে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে নরসিংদীতে যান। পরে আগরতলা হয়ে পশ্চিম দিনাজপুরে পৌঁছেন। ঢাকার আরও বেশ কিছু ছাত্র-যুবক সেখানে সমবেত হন। তাঁরা সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। প্রশিক্ষণ চলাকালে দুই নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ (বীরউত্তম) তাঁদের কথা জানতে পেরে তাঁর সেক্টরে নিয়ে এসে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই দল ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ করে। ঢাকা (উত্তর) গেরিলা দল বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন পরিচালনা করে।

১৪ই নভেম্বর সকাল থেকেই গোপন আস্তানায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উত্তেজনা। সবাই নিজেদের অস্ত্র পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় গুলি গুছিয়ে রাখলেন। বিস্ফোরক দ্রব্য সব ঠিকঠাক আছে কি না তাও দেখলেন। সন্ধ্যার পর তাঁরা যাবেন একটি সেতু ধ্বংসের অপারেশনে।

মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আছেন মানিক (রেজাউল করিম মানিক), নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু (যিনি শহীদ মানিক পরবর্তী সময়ে ঢাকা উত্তর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন) মিলন, শফিউল, ওমর, হাকিম, ইফু ও তৌফিকসহ আরও কয়েকজন। তাঁরা সব দুই নম্বর সেক্টরের ঢাকা (উত্তর) গেরিলা দলের সদস্য।

দুপুরে মানিকসহ সবাই একসঙ্গে ভাত খেলেন। খেয়েদেয়ে সবাই বিশ্রাম নিলেন। কোনো অপারেশনে যাওয়ার আগে তাঁদের জন্য এটি বেশ প্রয়োজনীয়। কিন্তু শহীদ মানিকের জন্য ছিল সেটিই শেষ খাবার।

সন্ধ্যার পর তাঁরা রওনা হলেন। তাঁদের লক্ষ্য, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ধামরাই থানার অন্তর্গত ভায়াডুবি সড়কসেতু। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চলাচল বিঘ্নিত করার জন্য এই সেতু ধ্বংস করা খুবই জরুরি। দুই নম্বর সেক্টর থেকে নির্দেশ এসেছে ওই সেতু ধ্বংস করার। কারণ, এই সড়ক দিয়েই দেশের উত্তর-দক্ষিণের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ।

রাতের অন্ধকারে মানিকসহ অন্য গেরিলা যোদ্ধারা নিঃশব্দে পৌঁছালেন সেখানে। তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত বাহিনীরও কয়েকজন আছেন। সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য সেখানে সার্বক্ষণিক প্রহরায় আছে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা। অতর্কিতে তাঁরা আক্রমণ করলেন সেখানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকিস্তানিদের দিক থেকে প্রতিরোধ স্তিমিত হয়ে যায়। দুই-তিন জন নিহত হওয়ার পর বাকিরা পালিয়ে গেল। এরপর গেরিলারা সেতু ধ্বংসের কাজ শুরু করলেন। এমন সময় পাকিস্তানি সেনাদের একটি কনভয় সেখানে এসে তাঁদের আক্রমণ করে। তখন শুরু হয় দুপক্ষে তুমুল যুদ্ধ।

এর মধ্যেই মানিক ও আরও কয়েকজন সেতু ধ্বংস করেছিলেন। পরে মানিকও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তাঁরা সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলা করছিলেন। যুদ্ধ চলতে থাকে। তখন রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টা। এমন সময় পাকিস্তানিদের ছোড়া মর্টারের তপ্ত স্প্লিন্টার এসে আঘাত করে তাঁর গায়ে। তাঁর শরীরটা সঙ্গে সঙ্গে কুঁকড়ে গেল। নিমেষেই শহীদ হলেন মানিক। সেদিন শহীদ মানিকের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তাঁর সহযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হটাতে বাধ্য করে।

শহীদ রেজাউল করিম মানিকের বাবার নাম মো. ওয়াজেদ আলী। তিনি আইনজীবী ছিলেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৪৭ সালের পর তিনি ঢাকায় আসেন। মা রাজিয়া বেগম। মানিক তাঁদের একমাত্র পুত্রসন্তান। একমাত্র মেয়ে বিলকিস রহমান। মানিকের বাবা-মা বসবাস করতেন ঢাকার মগবাজারের হাসনাবাদ কলোনিতে।

শহীদ মানিক সমাহিত আছেন আজিমপুর কবরস্থানে।

মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য শহীদ রেজাউল করিম মানিককে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করা হয়েছে।

ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুদিন থাকতে নেই।

সূত্র - শহীদ মানিকের বোন বিলকিস রহমান।

শাওন মাহমুদ এর ফেসবুক থেকে 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত