বিপদসংকুল এক বনপ্রান্তরে বাওয়ালীদের জীবন

প্রকাশ : ২৩ মে ২০১৯, ০২:১৬

ছবি: জাহিদুল হক | ডয়েচ এভেল

বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মন্ডিত ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট (লোনা পানির জঙ্গল) সুন্দরবন। বনের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার মানুষ অনেকটা প্রাণ হাতে নিয়ে জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন বনে ঢোকেন। বাঘ, সাপ, নানা ধরনের কীটপতঙ্গ এবং জলে কুমীর ও হাঙ্গরের সাথে লড়াই করে তাদের বেঁচে থাকতে হয়। এছাড়া সুন্দরবনের সর্বত্র রয়েছে বিভিন্ন নামে গড়ে উঠা বনদস্যু বাহিনীর মুক্তিপণের দাবীতে অপহরণ আতঙ্ক।

বাওয়ালি সুন্দরবনের কাঠকাটা শ্রমিক। কাঠ কাটার সময় বনের হিংস্র জন্তুর আক্রমণ ও অন্যান্য দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা বাউলদের (বনদেবীর সাধনাকারী) সাহায্য নেয় বলে তাদের নাম হয়েছে বাওয়ালি। লোকবিশ্বাস অনুসারে বাউলেরা বাঘ-বাঁধা মন্ত্র জানে। তারা গন্ডি কেটে বাঘ বন্দি করে কিংবা মন্ত্র পড়ে বাঘের মুখ বন্ধ করে দেয়।

বৃহত্তর বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা এবং খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের লোকেরা বংশানুক্রমে এই পেশার সঙ্গে জড়িত। তবে স্বরূপকাঠি উপজেলার বর্ষাকাঠি, সোহাগদল, বলদিয়া, সুঠিয়াকাঠি, বলিহারি ও জগন্নাথকাঠির লোকেরাই এ পেশায় অধিক অভিজ্ঞ। বর্ষাকাঠির বাওয়ালিরা সুন্দরবনের প্রাচীন বাওয়ালিদের বংশধর বলে জানা যায়। 

বাওয়ালিরা বিস্তৃত বনভূমি থেকে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া প্রভৃতি কাঠ সংগ্রহ করে। ঠিকাদাররা ২০-১০০ একর পর্যন্ত বিস্তৃত ঘের নিলামে কিনে চুক্তির ভিত্তিতে কাঠ কাটার জন্য এদের নিয়োগ করে। সুন্দরবনের বর্ষপঞ্জি এবং প্রশাসনিক কর্মপদ্ধতি অনুসারে বাওয়ালিদের জীবন পরিচালিত হয়।

কাঠ কাটার পারমিট (অনুমতি পত্র) সম্পন্ন হয় বর্ষাকালে। আষাঢ় মাসের মধ্যে সরকারী বনকর্মীগণ কর্তনযোগ্য কাঠের পরিমাণ নির্দিষ্ট করেন এবং গাছের কান্ডে নাম্বার দিয়ে ঐসব গাছ চিহ্নিত করে থাকে। এরপর বাওয়ালিরা ছয় জন, আট জন বা দশ-বারো জন মিলে একজন সরদারের অধীনে গাছ কাটা শুরু করে। শীত মওসুম, বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুন্দরবনে এই কাঠ কাটার মৌসুম চলে।

কাঠ কাটার সময় বাওয়ালিরা টোঙ্গ ঘরে বাস করে। বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাটি থেকে প্রায় ছয় ফুট ওপরে এই টোঙ্গ ঘর তৈরি করা হয়। টোঙ্গ ঘর এক তৃতীয়াংশে থাকে রান্নার ব্যবস্থা। তারা যে কাঠ কাটে তা ওখান থেকে চলে যায় খুলনার সহ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন কারখানায়। তাছাড়া সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী গ্রাম অঞ্চলেও এ কাঠের চাহিদা রয়েছে।

সুন্দরবনে বাওয়ালিরা বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে। তারা বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাতে যেমন টোঙ্গ ঘর বাস করে, তেমনি কুমির-হাঙ্গরের ভয়ে ডিঙি নৌকায় চড়ে ঘটিতে পানি ঢেলে গোসল করে। তারা দৈনন্দিন কাজের জন্য খালের নোনা পানি ব্যবহার করে। রান্না ও খাওয়ার জন্য মিঠা পানি সংগ্রহ করে রাখে। কাঠ কাটতে যাবার সময় তারা প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে যায় এবং নদী থেকে মাছ শিকার করে খায়।

নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এই তিন মাস বাওয়ালিরা গোলপাতা কাটে। গোলপাতা ঘর ছাওয়া এবং পাটি বোনা সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। এ সময় তারা জলদস্যুদের ভয়ে বড় বড় নৌকায় দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে। জীবনের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাওয়ালিরা সুন্দরবনে এক দ্বীপান্তরের জীবন যাপন করে। সারা দিন কাজের পর সন্ধ্যাবেলায় তারা সুর করে গাজীকালু-চম্পাবতী, বনবিবির জহুরনামা, মনসামঙ্গল ও রায়মঙ্গল-এর বাঘ ও সাপের উপাখ্যান পাঠ করে চিত্তবিনোদন করে।

গাজী-কালু-চম্পাবতীর পুথিতে গাজীর বাঘবাহিনী কালু রায়ের কুমির বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে। এই কাহিনীর নায়ক দক্ষিণ রায় ও গাজীকালু বাওয়ালিদের মনে সাহস জোগায়। 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত