উসাইন বোল্ট

কিংবদন্তিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা

প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০১৬, ১৪:০৯

২১ আগস্ট, ১৯৮৬ সালে জ্যামাইকার ছোট্ট শহর ট্রিলনি পারিশের শেরউড কনটেন্ট এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন এক শিশু। শিশুটির জন্মের সময়েই দুশ্চিন্তায় পড়ে ছিলো তার মা জেনিফার, কারন শিশুটির যেদিন পৃথিবীর আলো দেখার কথা সেদিন শিশুটি জন্ম নিলেন না। গুনেগুনে দশদিন পর জন্ম নিলেন শিশুটি। সেই একবারই শিশুটি তার মাকে টেনশনে ফেলে দিয়েছিলো। তারপর থেকে সেই শিশুটি আর দেরী করেননি বরং তার দ্রুততায় চমকে গেছে পুরো পৃথিবী। দিনেদিনে বড় হতে থাকে আর সাথেসাথে গর্বে উজ্জল করতে থাকে বাবা মায়ের মুখ। যেই ছেলেটি একদিন দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী এথলেটিক হিসেবে সবাইকে ছাপিয়ে যাবে সে হয়তো আরেকটু শক্তি সঞ্চয়ের জন্য, আরেকটু প্রস্তুত হয়ে আসার জন্য দশদিন সময় বেশি নিতেই পারে।

বলছি অ্যাথলেটিক্সে দুনিয়ার কিংবদন্তি গতিদানব খ্যাত পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন মানুষ উসাইন বোল্টের কথা। শেরউড কনটেন্টেই বাবা ওয়েলেসলি, মা জেনিফার বোল্ট, ভাই সাদেকি ও বোন শেরিনকে নিয়ে পরিবারের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। উসাইন বোল্টের বাবা ছিলেন সামান্য মুদি দোকানদার। বাবার সাথে মাও দোকান চালাতে সাহায্য করতেন। একসময় উসাইন বোল্টকেও চাল-ডাল বিক্রি করতে হয়েছিল বাবা-মায়ের সাথে। এই মুদি দোকান থেকে যা আয় হতো তা দিয়েই কোনোরকমে চলতো তাদের সংসার।

তার মা জেনিফার বলছেন, উসাইনের বয়স যখন তিন সপ্তাহ তখন থেকেই তিনি টের পেতে শুরু করেছিলেন যে বড় কিছু একটা করার জন্যই তার ছেলের জন্ম হয়েছে। বাবা ওয়েলেস্‌লি বোল্ট জানাচ্ছেন, উসাইন হারতে চাইতেন না। ছেলেবেলায় তিনি যখন জ্যামাইকার পাড়ার মাঠে দৌঁড়াতেন তখন অন্যদের সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গেলে তিনি কান্নাকাটি করতেন। বোল্ট পরাজয় মানতে পারতেন না। আজকের বোল্টের সৃষ্টি হয়েছে সেই পরাজয় না মানার জেদ থেকেই।

জেনিফার বলেন, পাঁচ বছর বয়স থেকে উসাইন স্কুলের বন্ধুদের সাথে রেস করতেন, এবং প্রতিবারই জিততেন। ভাই সাদিকি এবং বোন শেরিন বলছেন, ছোটবেলা থেকেই উসাইন ছিলেন খুবই হাসিখুশি এক ছেলে। তবে উইলিয়াম নিব হাই স্কুলে পড়ার সময় উসাইন বোল্টের আকর্ষণ ছিল ক্রিকেটের প্রতি। ছোট বেলায় ভাইয়ের সঙ্গে গ্রামের রাস্তায় ক্রিকেট ও ফুটবল খেলে সময় কাটত বোল্টের। এই দুটি খেলার প্রতিই বোল্টের ভালো লাগা রয়েছে। সে সময় তিনি ক্রিকেট ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারতেন না। একসময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে খেলারও স্বপ্ন দেখতেন তিনি। অতীতে জ্যামাইকার অনেক মাঠেই ব্যাট-প্যাড পরে ক্রিকেট খেলতে দেখা গেছে তাঁকে। ক্রিকেট কিংবা ফুটবল যে কোনো খেলার মাধ্যমেই হোক সারাক্ষণ দৌড়ের উপরেই থাকতেন তিনি। প্রাইমারি শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভর্তি হলেন ওয়েলডেসিয়া প্রাইমারি স্কুলে। সেই স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্প্রিন্ট ট্র্যাসকে ১ম পা পড়ে বোল্টের এবং শুরুতেই বাজিমাত করেন বোল্ট। ১০০ মিটারে স্কুলের সেরা দৌড়বিদ হন তিনি।

সেই দৌড় প্রতিযোগিতায় বোল্টের স্কুলের পিটি শিক্ষক লর্না থর্পই প্রথম উসাইনকে অ্যাথলেটিক্সে আসার জন্য উপদেশ দেন।

শিক্ষক লর্না থর্প বলেন, আমি তাকে বলেছিলাম, ভাল করে ট্রেনিং শুরু করো। তোমার লম্বা পায়ের ভেতর সোনার খনি লুকানো আছে।

উসাইন বোল্টের জীবনের ওপর এই শিক্ষকের বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে। উসাইন নিজেও সেটি স্বীকার করেছেন বহুবার। শিক্ষক লর্না থর্প সম্পর্কে বোল্ট বলেন, তিনি ছিলেন মায়ের মতো। স্কুলে পড়ার সময় তিনি সব সময় আমার খোঁজখবর রাখতেন। স্কুলের ভেতরে কি স্কুলের বাইরে। সব সময় চাইতেন আমি যেন অ্যাথলেটিক্সে আমার মনোযোগ ধরে রাখি। ফলে আমার জীবনে তার বড় ভূমিকা রয়েছে।

তার অনুপ্রেরণায় দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন বোল্ট। বোল্টকে দেখে অলিম্পিকের সাবেক এক স্প্রিন্টারও বোল্টকে পরামর্শ দেন অ্যাথলেটিক্স এর মনোযোগ দেওয়ার জন্য।

জ্যামাইকার হয়ে ক্যারিবীয় অঞ্চলের ইভেন্টে প্রথম অংশ নেন ২০০১ সালে। প্রথমবার অংশ নিয়েই ২০০ ও ৪০০ মিটারে জিতে নেন রুপা। একই বছর হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ মিটারে অংশ নেন। কিন্তু ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হলেও তখন পর্যন্ত ক্যারিয়ার সেরা টাইমিং (২১ দশমিক ৭৩ সে.) করেন। উসাইন বোল্টের জীবনে প্রথমবারের মতো খ্যাতি আসে যখন তার বয়স মাত্র ১৫। ২০০২ সালে জ্যামাইকাতে বিশ্ব জুনিয়ার চ্যাম্পিয়নশিপে এই কিশোর স্বর্ণপদক জয় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সে সময় তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা সবাই ছিল তার চেয়ে অন্তত চার বছর বড়। সেই ইভেন্টের পর থেকে উসাইন বোল্টকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

পেছনে না তাকিয়ে গতকাল অবধি দৌড়ে গেছেন দুনিয়ার তাবৎ দৌড়বিদদেরকে পেছনে ফেলে। গতকাল অবধি বলার কারন এবারের ২০১৬ রিও ডি জেনিরো অলিম্পিকের আসরে নিজের ৩০তম জন্মদিনের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে বোল্ট আরও এক অর্জনের পালক যোগ করলেন মুকুটে। জিতে নিলেন অলিম্পিকে নিজের নবম সোনা। টানা তৃতীয়বারের মতো অলিম্পিক অ্যাথলেটিকসের ১০০ মিটার দৌড়ের সোনা জিতে তৈরি করলেন এক অনন্য রেকর্ড। মনে হয় যেনো নিজের জন্মদিনে নিজেকেই নিজে উপহার দিলেন পৃথিবীর সবচেয় সেরা হওয়ার অনন্য গৌরব।

পাশাপাশি এবারের রিও ডি জেনিরো অলিম্পিকই হচ্ছে বোল্টের শেষ অলিম্পিক। বোল্টকে আর কখনো দেখা যাবে না অলিম্পিকে দৌড়াতে। বোল্ট অবশ্য আগামী বছর লন্ডনের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ পর্যন্ত আছেন। সত্যিকারের বিদায় এখনো তাই কিছুদিন বাকি।

বোল্ট বলেন ‘আমি জানতাম একদিন না একদিন শেষ তো হবেই। আমি অবশ্যই এই দর্শক, এই উন্মাদনা মিস করব। মিস করব এই প্রতিযোগিতাকে। মিশ্র একটা অনুভূতি হচ্ছে। তবে আমার ক্যারিয়ারটা অসাধারণ তো ছিলই। এখন জীবনের নতুন লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে যা যা করতে চেয়েছি, সবই তো করেছি। যতদিন খেলেছি নিজেকে উজাড় করে খেলেছি। সব সময়ই সর্বোচ্চটা চেয়েছি, কখনোই তৃপ্ত থাকিনি’।

বোল্টের বিদায়ে বোল্টের মতোই বুকের ভেতর চাপা কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছে তার অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী। যদিও বোল্টের যা অর্জন তাতে বিদায় শব্দটা বোল্টের সাথে বড্ড বেমানান। অলিম্পিক ইতিহাস কখনোই ভুলতে পারবেনা উসাইন বোল্টের জাদুকরী দৌড়।

বিশ্ব এথলেটকে সমৃদ্ধ করে সাফল্যের এক মহাকাব্যের রচয়িতা উসাইন বোল্টের জন্য জন্মদিনে অনেক অনেক ভালবাসা।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত