কর্নেল তাহের হত্যা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিয়োগান্ত নাটক ও বানানো বিচার

প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০১৮, ১৪:৪৭

২১ জুলাই কর্নেল আবু তাহের ফাঁসির মঞ্চে প্রাণটি হারিয়েছিলেন। ১৯৭৫ পরবর্তী খেলায় তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতার বলি হয়েছিলেন কর্নেল আবু তাহের।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুন করে তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী খন্দকার মোস্তাককে শিখন্ডি বানিয়ে সরকার চালাচ্ছিল। বেশীরভাগ আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা মোস্তাক সরকারের সাথে ছিলেন, এমনকি সংসদও চালু ছিল। যাঁরা খন্দকার মোস্তাকের সাথে থাকেননি সে সমস্ত নেতাদের কারাগারে ঠাঁই হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। যে সমস্ত মেজরদের হটিয়ে তিনি ক্ষমতা দখল করেন, সে সমস্ত মেজরদের নাটের গুরু খন্দকার মোস্তাককে তিনি রাষ্টপতি পদে রেখেই নিজে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন জেনারেল জিয়াকে বন্দী করে। খালেদ মোশাররফই তৎকালীন সময়ে সংসদ ভেঙে দেন। জেলখানায় চার নেতার হত্যাকান্ডটিও ঘটেছিল খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা গ্রহণের সময়টিতেই। জেল অভ্যন্তরে বাংলাদেশ সেনা কর্মকর্তারা নির্বিঘ্নে ঢুকে পৃথিবীর ইতিহাসের বিরলতম ঘটনাটি ঘটিয়েছিল, জেলখানার অভ্যন্তরে জাতির মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করা চার নেতাকে হত্যা করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই খুনী সদস্যরা নির্বিঘ্নেই দেশ ছেড়েছিলেন খালেদ মোশাররফের প্রত্যক্ষ সহায়তায়।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের ক্যুদ্যেতা ও পাল্টা ক্যুদ্যেতার খেলায় জাসদ ও কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ৭ নভেম্বর ক্যুদ্যতা সংগঠিত করে জিয়াকে মুক্ত করে ক্ষমতা হাতে নেবার চেষ্টা করে। জেনারেল জিয়া বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সমস্ত দাবি দাওয়া মেনে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে, ক্ষমতা সংহত করেই জাসদ নেতৃবৃন্দ ও কর্নেল তাহেরর উপর খড়গহস্ত হন। দৃশ্যত কর্নেল আবু তাহের, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও জাসদের ক্ষমতা গ্রহণের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল মুক্ত জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা ও পাকিস্তানপন্থী অফিসারদের প্রত্যক্ষ তৎপরতার ফলে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে জেনারেল জিয়া জাসদ নেতৃবৃন্দ ও কর্নেল তাহেরকে বন্দী করেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জন্ম নেয় বিশ্বাসঘাতকতার এক নজিরবিহীন গল্প। জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার খেসারত দিয়েছেন কর্নেল আবু তাহের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সামরিক আদালতের প্রহসনের রায়ে নিজের জীবন ফাঁসিকাষ্ঠে বিলিয়ে দিয়ে। সামরিক আদালতে প্রহসনের রায়ে তাঁকে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত করেছিল তৎকাল সামরিক আদালত। রায় দেবার পরে আইনটিতে সংস্কার আনে তৎকালীন সামরিক জান্তা ফাঁসি কার্যকর করার জন্য।

জাতির জন্য যা হতাশাজনক তা হলো জান্তা সরকারের অধীনে দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন একজন সর্বোচ্চ আদালতের। তাঁর নির্দেশেই সামরিক আদালতটি গঠিত হয়েছিল। আমাদের দূর্ভাগ্য এই যে আমরা অবলোকন করলাম একজন বিচারপতি দেশ চালাচ্ছেন সামরিক আইনের বদৌলতে, যিনি সংবিধান ও আইনের শাসন বলবৎ রাখার জন্য শপথ নিয়েছেন! 

একই সাথে ভূতের মত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাত ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজ মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে হাঁটতে শুরু করে তৎকালীল সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়া। জান্তা জিয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় একটি রাজনৈতিক দল খুলেন, একই সাথে তিনি প্রহসনের নির্বাচন করে সেনাপ্রধান ও রাষ্টপতি বনে যান। তার আগে অবশ্য তিনি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ আবু সায়েমকে হটিয়ে নিজেই প্রধান সামরিক প্রশাসক বনে গিয়েছিলেন। জান্তা জিয়ার নবঘটিত সংসদে আইন বানানো হয়েছিল ৭৫ সালের ক্যুদ্যেতা ও খুনের সাথে জড়িত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সূর্যসন্তানদের বিচার করা যাবে না।

আজ আমরা দেখি ৭৫ সালের ৭ নভেম্বর পালন করে জান্তা জিয়ার দল বিএনপি, জামাত, চরের পীর চরমোনাইয়ের দল, চৈনিকপন্থী বামেরা। তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে ৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মহোদয়েরা আপনারা কোন আঁতুড়ঘরে ছিলেন?

কর্নেল তাহের, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও জাসদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে আপাত দৃষ্টিতে কিন্তু এর রেশ ঠিকই রয়ে গিয়েছে। যুদ্ধে কর্নেল তাহের যোগ দিয়েছিলে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে, সাথে ছিলেন আরও দুজন সেনা সদস্য ক্যাপ্টেন দেলোয়ার আর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী। রণাঙ্গনে ফিরে কর্নেল তাহের ১১ সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে একটি পা হারান। যুদ্ধে শেষে তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে যোগ দিয়ে ঔপনিবেশকতা সেনা সংস্কৃতির অবসান ঘটান। আজন্ম বিপ্লবী চিন্তা চেতনার একজন সৈনিক কর্নেল তাহের নিজ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করে গেছেন। সে চেষ্টা আজকের দর্পণে ভুল মনে হতে পারে, অপ্রাসঙ্গিকও মনে হতে পারে কারও কারও কাছে। ৭৫ এর বিয়োগান্তক পরিস্থিতিতে এর বিকল্পও বা কি ছিল? হাত ঘুটিয়ে বসে থাকা? অতীত দিনের যুদ্ধ জয়ের জাবর কাটা? ক্ষমতা দখল করে দেশকে পরিবর্তনের ধারায় নিতে পারেননি কর্নেল তাহের তৎকালীন জাসদ নেতৃবৃন্দ। তাঁরা ব্যর্থ হয়েছিলেন বটে, তবে নিজের জীবন বিপন্ন করে তাঁরা ঐতিহাসিক দায় মোচনের চেষ্টা করেছিলেন, যখন অন্যারা সুবিধা প্রাপ্তির খেলায় নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান করছিলেন।

কর্নেল তাহেরকে সামরিক আদালতে প্রহসনের রায়ে ফাঁসি দেয়া হয়েছে মর্মে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে দীর্ঘ ৩৪ বছর পর গোপন বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কর্নেল তাহেরের ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার হোসেন, কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের এবং সামরিক আদালতের বিচারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ ২০১০ সালের আগস্টে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ আগস্ট আদালত তাহেরের বিচারের জন্য সামরিক আইনের মাধ্যমে জারি করা আদেশ এবং এর আওতায় গোপন বিচার ও ফাঁসি কার্যকর করাকে কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এছাড়া ২০১১ সালের শুরুতে ওই সময় গোপন বিচারের মুখোমুখি অন্য ছয় জনও হাইকোর্টে পৃথক তিনটি রিট করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত রুল জারি করেন। এই ছয় জন হলেন হাসানুল হক ইনু, রবিউল আলম, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জিয়াউদ্দিন, হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, করপোরাল শামসুল হক ও আবদুল মজিদ।

রিটটি গ্রহণ করে সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন কর্নেল তাহেরসহ অন্যদের বিচার ছিলো লোক দেখানো ও প্রহসনের নাটক। এটা কোনো বিচার হয়নি। তাই বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন, বিচার-প্রক্রিয়া ও সাজা ছিল অবৈধ। বিচার ও সাজা বাতিল করা হলো। আদালত অভিমতে বলেছেন, ওই বিচার প্রথম থেকেই অবৈধ, আর পুরো বিচারটি ছিল একটি বিয়োগান্ত নাটক ও বানানো বিচার।

বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে রায়ে বলা হয়, তাহেরের তথাকথিত বিচার ও ফাঁসি দেওয়ার ঘটনা ঠান্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড। ওই বিচার ও হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ছিলেন জিয়াউর রহমান। একই সঙ্গে তাহেরকে শহীদের মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি কথিত ওই সামরিক আদালতের বিচারকের বিরুদ্ধে খুনের মামলা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আমরা আশা করবো সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৭৫ পরবর্তী ক্যুদ্যেতা ও পাল্টা ক্যুদ্যেতার সাথে জড়িত প্রতটি ঘটনার একটি নিরপেক্ষ ও ন্যায়ানুগ তদন্ত চালিয়ে ঘটনার সাথে জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। খুন ও খুনের রাজনীতি বৈধতা দেয়ার যে সংস্কৃতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে যে বা যারাই জড়িয়েছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিজেদের স্বার্থেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উদ্যোগী হবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ