পল্লীর প্রতি অধিক মনোযোগ সময়ের দাবি

প্রকাশ : ১৫ এপ্রিল ২০১৮, ১৯:০৪

আমাদের শাসনতন্ত্র বলছে, পল্লী ও শহর অঞ্চলের মধ্যকার বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আগে থেকেই পল্লী ও শহরের বৈষম্যের বিষয়টি আমরা দেখে আসছি। অধিকারের প্রশ্নে যে বঞ্চনা পূর্ব ও পশ্চিমের ছিলো আজও তা আমরা লালন করে চলেছি। জন্মের পর থেকে গত প্রায় ৪৭ বছরে শাসনতন্ত্রীয় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়ে ওঠেনি। এর মূল কারণ একটাই- পল্লী ও পল্লীর জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলা। ভোগবাদীতায় রাজনীতির আর আমলাতন্ত্রের অবগাহন; রাজনীতির চরম ব্যর্থতা।

সাম্প্রতিক সময়ে আমলাতন্ত্র রাজনীতির তুলনায় সুবিধার বিচারে বেশ এগিয়েছে। রাজনীতির অংশীদার না হয়েও নীতি বাস্তবায়নের পরিবর্তে রাষ্ট্র-সরকার পরিচালনা স্বাদ নিচ্ছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা কিংবা সরকার প্রধানের উপদেষ্টার ভূমিকায় সরাসরি পরিচালকমণ্ডলী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাছাড়া বিভিন্ন সময় ও ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে জনগণের কাছে রাজনীতিকদের জবাবদিহিতা (একেবারেই নিম্নহার) করতে হলেও তারা জবাবদিহিতার উর্দ্ধে; প্রত্যাশাও যেন অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়ে। এমনকি কর্মজীবনে তাদের কর্তৃত্ব-দায়িত্বাধীনে অনেক পরিবর্তনের সুযোগ কাজে না লাগিয়েও তারা আস্থাভাজন, তত্ত্ব দেওয়ারও সুযোগ পান, বিনা প্রশ্নে আমরা সেসব তত্ত্বকথা মেনে নিই। আর হালআমলে রাজনীতির গতি প্রকৃতি নির্ধারণে তাদের অবদানতো সর্বজন বিদিত। ফলে রাজনীতির সংস্কার কিংবা উন্নয়নের স্বার্থে সংস্কারের রাজনীতি সুদূর পরাহত। গরীব দেশে (উন্নয়নশীল) এরাই ডায়মন্ড নেকলেস (হিরা খচিত হার); আন্তর্জাতিকতায়! রাজনীতির সাথে এর চির বৈরিতা সত্বেও নাগরিক সমাজ তত্ত্ব তাদের আন্তর্জাতিকতায় ক্ষমতায়িত করেছে। রাজনীতি এখানে অসহায়; চিরায়ত বিরাজনীতিকরণের ধারায় এরা সদা অগ্রসরমান, এলিট থেকে সুপার এলিটে। রাজনীতি পরাজিত বিধায় শাসনতন্ত্র পরাস্ত, তুষ্টতায় ডান-বামের বিপরীতে মধ্যপন্থাও কাজে আসেনি; আমরা মডারেটকালে ধাবমান!

এ অবস্থায় শাসনতান্ত্রিক অঙ্গিকার নাকাল। সমস্যাগুলো আড়ালের নিমিত্তে বেছে নিয়েছি অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল তারপর উন্নত হওয়ার প্রবণতাকে, যেখানে শহরই একমাত্র সূচক। কেননা শহরে অভ্যুত্থান হলে রক্ষা নেই; ক্ষমতার মোহ’ই তো রাজনীতির দর্শন। অসমতা-বঞ্চনাময় পল্লীর চির চেনা রূপ দেখতে আমরা ভয় পাই। শহরের মাঝে আড়ম্বরতা সৃষ্টি করে চলি অবিরাম, অথচ আড়ম্বরতার আধার গ্রামগুলোতে অনাড়ম্বরতার বোধ চাপিয়ে দিতে দিতে তাকে করে তুলছি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তাই যদি না হবে, তাহলে মৌলমানবিক চাহিদার বাস্তবায়ন শহরে অগ্রসর হলেও গ্রামে অধপতিত হয় কিভাবে? স্বাস্থ্য সূচকে দেখা যায়, শহরের তুলনায় পল্লী/গ্রামের প্রত্যাশিত আয়ুস্কাল কম। ২০১৩ সালের হিসেবে পল্লী এলাকার প্রত্যাশিত আয়ুস্কাল যেখানে ৬৬.২ বছর সেখানে শহরে তা ৬৮.২ বছর (২০১৩) হয় কি করে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৫)? অর্থাৎ পল্লীবাসীর জন্য এমন কিছু করতে পারিনি যে, আমাদের প্রত্যাশায় শহর আর পল্লী সমানভাবে ধরা দেবে।

আমরা ক্রমশ উন্নত হচ্ছি, এই ৪৭ বছরে পল্লী আর শহর কি সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে? না। দারিদ্র্য কমে আসার হারেও শহর ও পল্লীর পার্থক্য দূর করা যায়নি। শহরে ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে প্রতিবছর ৫.৫৯% হারে দারিদ্র্য কমলেও, গ্রামে কমেছে ৪.২৮% হারে, আবার খানার মাসিক নামিক (Nominal) আয় ২০১০ সালের হিসেবে পল্লীর আয় যেখানে ৯৬৪৮ সেখানে শহরের আয় ১৬৪৭৭ টাকা (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৫)। শুধুমাত্র আয়ের হিসেব থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের পল্লীর মানুষ তাদের মৌলমানিবিক প্রয়োজন কতটা মেটাতে পারবে।

আমাদের গ্রাম শহরের জন্য ভর্তুকি প্রদানের প্রধানতম খাত। ব্যক্তি পুঁজি বিনিয়োগের সর্ববৃহৎ কৃষিখাত যেন শুধুমাত্র শহর উন্নয়নের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে! বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তোলার মহান কারিগর পল্লীর কৃষক হলেও অন্যান্য সকল বঞ্চনার সাথে স্বীকৃতি প্রাপ্তি থেকেও তারা বঞ্চিত-রিজার্ভের কৃতিত্ব আমাদের শহুরে ব্যবসায়ীদের বিশেষ করে গার্মেন্ট মালিকদের। কিন্তু একটি বারও বিবেচনায় আসে না, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান ব্যয়ের খাত খাদ্য আমদানি এবং কৃষক উৎপাদন করেছে বলেই তা জমেছে। আর গার্মেন্টের আয় যে কতবড় শুভঙ্করের ফাঁকি তা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এছাড়াও গ্রামীণ মানুষের শ্রম শহরের বিত্ত বৈভব আর বাসনা প্রতিনিয়তেই বাড়িয়ে চলেছে। শ্রমের প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটি খাতই শহরের এই প্রবণতাকে টিকিয়ে রেখেছে, যা শহরের জন্য পল্লীবাসীর ভর্তুকি।

পরিসংখ্যানের বাইরে সাদা চোখেই দেখা যায়, শিক্ষা আর বিনোদনে প্রাপ্তিতে গ্রামের অবস্থা কি? কত সংখ্যক মানুষ শিক্ষায় টিকে থাকতে পারে? বাংলাদেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আর ৭৬টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কোথায়? গ্রামের কত জন শিক্ষার্থী সেখানে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে? ঘুষ-দুর্নীতি আর চোষন-তোষণে শহরের এলিট-সুপার এলিটরা নিজের প্রজন্মকে গড়ে তুলছেন। কিন্তু কৃষক-মজুর কি পারছেন? অথচ এরাই স্বাধীনতা এনেছেন, অর্থনীতি বিনির্মাণ করছেন, যাদের জন্য দুঃস্বপ্নের পদ্মাসেতুর বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে নতুন আঙ্গিকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে। অপরদিকে পল্লীবাসীর বিনোদন কোথায় বলতে পারবে কেউ? তথাকথিত গণতন্ত্র উত্তরণ পর্বে যতটুকু ছিলো তার সবটাই এখন নির্বাসনে। চিরায়ত সংস্কৃতির যে নির্মল বিনোদন আয়োজন বাঙালির জীবনধারায় আষ্টেপৃষ্ঠে লেগেছিলো তা শুধুই স্মৃতি। শহুরে কর্পোরেট সংস্কৃতি আর রাষ্ট্র-ধর্মাচার এই নির্মলতাকে গ্রাস করেছে। পহেলা বৈশাখের আয়োজন তাই গ্রামীণ ফোন পহেলা বৈশাখ কিংবা অমুক ফোন-কোলা চৈত্র সংক্রান্তি-ভুভুজেলার মাতম, উৎসব আয়োজনের অনুমতির নামে ভানুমতির খেল, নিয়ন্ত্রণের বাড়াবাড়িতে উৎসব আয়োজন আর উপভোগে রাষ্ট্রীয় সংকোচননীতি- সবকিছু পল্লী কিংবা দারিদ্র্য পিড়িত পল্লীর অভিবাসী মানুষের বিনোদনের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আর পরিষেবা খাতে পল্লীবাসীর প্রাপ্যতা নাই বা উল্লেখ করলাম। এতে শুধু লেখার কলেবর বাড়বে।

সবদিক থেকেই পল্লীবাসীর বঞ্চনার শেষ নেই-শেষের চেষ্টা যে চলছে- এমনটিও বলা যায় না। তবে উন্নয়নের ধারায় পল্লী এবং শহরের সংযোগ বেড়েছে বলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা গেলেও সেই সংযোগ প্রকারন্তরে শহরকেই সমৃদ্ধ করেছে এবং করে চলেছে। আর তাই সমতাভিত্তিক উন্নয়নে চাকুরি-অবকাঠামো-পরিষেবার সুষম বণ্টনের জন্য যে কোনো নামেই হোক পল্লীর প্রতি অধিক মনোযোগ সময়ের দাবি। আর এতেই কেবল গ্রাম থেকে আমলা তৈরির হারানোসুর পুনুরুদ্ধার হবে, কামলা তৈরির গ্রামীণ কারখানায় সংস্কার আসবে, গড়ে উঠবে প্রতিনিধিত্বশীল নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া এবং বৈষম্য কমানোর শাসনতান্ত্রিক অঙ্গিকার বাস্তবায়িত হবে।

সাহস২৪.কম/রিয়াজ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ