‘নির্বিকার থাকা দাসত্বের নামান্তর’

প্রকাশ : ০১ মে ২০১৬, ১৭:৪৮

বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা, সাংবাদিক-সম্পাদক ও প্রকাশক শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের ফেসবুকের পাতায় একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে চাপান-উতোর চলছে সমানে।

ইমরান তাঁর স্ট্যাটাসে যা বলেছিলেন ‘৮১ বছর বয়সী প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। শফিক রেহমানের রাজনৈতিক আদর্শের সাথে আমি একমত নই। ভিন্নমতের হলেই তাকে দমন করার যে নোংরা রাজনৈতিক অপকৌশল, এর একটা অবসান চাই।’

আরও যা বলেছেন ‘দেশে যখন একের পর এক মানুষ খুন হচ্ছে, লেখক-প্রকাশক-বিদেশি থেকে শুরু করে মসজিদ-মন্দিরে ঢুকে মুয়াজ্জিন-পুরোহিতকে হত্যা করা হচ্ছে তখন খুনীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে অপহরণের বায়বীয় অভিযোগে এমন একজন প্রবীণ সাংবাদিককে গ্রেপ্তার সত্যিই হতাশাজনক।’

কথা হচ্ছে শফিক রেহমানের গ্রেপ্তারে ইমরান উদ্বেগ জানাতে পারেন কিনা? যে শফিক রেহমান দিনের পর দিন শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে সমানে বাজে মন্তব্য করেছে। এ দেশের সেরা সন্তানদের হত্যাকারী রাজাকার নিজামী, কাদের মোল্লা ও মুজাহিদ গংদের পক্ষে সাফাই গেয়েছে এবং যুব্ধপরাধী চক্রের বিচারের বিরোধিতা করেছে। তাঁর পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং গ্রেপ্তারের বিরোধীতা করা এক কিনা? যে কায়দায় শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এটার বিরোধীতা করা যায় কিনা?

ডিবি পুলিশ শফিক রেহমানকে ধরতে গিয়েছে একটি টেলিভিশন চ্যানেল’এর সাংবাদিক পরিচয়ে। প্রথমে পুলিশ কতৃক অস্বীকার করে মিনমিন কন্ঠে পুলিশ স্বীকার করে নিয়েছে পুলিশ তা করতে পারে। অভিযোগ যখন গুরুতর তখন কৌশলের কি প্রয়োজন? পুলিশের কাছে অকাট্য প্রমাণ আছে বলে পুলিশ দাবি করছে, শফিক রেহমান জয় হত্যা ও অপহরণের সাথে জড়িত। তখন পুলিশ স্মার্টলি শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করলেই কোন প্রশ্ন উঠতো না। পুলিশ রাষ্ট্রের নাগরিককে ধোঁকা দিতে পারে কিনা? এ ধোঁকা হজম করা যায় কিনা? বিনা ওয়ারেন্টে একজনকে গ্রেপ্তার এবং যথাযথ কারণ না দর্শিয়ে গ্রেপ্তারের বিরোধীতা করায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে হবে কেন? আমার সাথে রাজনৈতিক মতপার্থক্য আছে বলে! একই আচরণ আমাদের সাথে করা হলে আমরা এটি মানবো কি? অতীতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরাও বহন করতে হবে? এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টানোর আবেদন করা কি অন্যায়?

হ্যাঁ, ইমরান এইচ সরকার আরও রকটি শব্দ প্রয়োগ করেছেন ‘বায়বীয় অভিযোগ’। অভিযোগটি বায়বীয় কিনা সেটিতো তদন্ত ও তদন্তের গতি প্রকৃতি দেখেই বলা যেতো, এতো দ্রুত এ শব্দে প্রতিক্রিয়া অনেককেই আহত করেছে। প্রধানমন্ত্রীর পরিবার অতীতে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। তাঁর ছেলের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব বাড়তি উদ্বেগ থাকবে, থাকাটাই স্বাভাবিক। তাঁদের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ভাবেই আবেগের ঝাঁপি খুলে নিয়ে মাটিতে গড়াবে, এবং গড়িয়েছেও ত্বরিতগতিতে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তারে ইমরান এইচ সরকারের প্রতিক্রিয়া আমাদের অনেকের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে যায় না। সেখানে ইমরান প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কতটা রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েছে তা মূল্যায়ন করবে ভবিষ্যৎ। তাঁর এ প্রতিক্রিয়া মাঠে গড়াতে না গড়াতেই বিস্ফোরণ ঘটেছে। নির্মোহ এবং নৈর্ব্যক্তিকভাবে কেউ বিশ্লেষণ করেনি। মোটা দাগে রাজনৈতিক ডামাডোল বাজিয়েই বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মীও বিরুদ্ধ পক্ষের বিরুপ সমালোচনা ইমরানকে ছাপিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত পারিবারিক বলয়েও হাত বাড়িয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যিনি একই সাথে তাঁর মায়ের তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা। মধ্যপ্রাচ্য বাদ দিলে কোন গণতান্ত্রিক দেশে এমন উদাহরণ নাই যিনি প্রধানমন্ত্র্রীর পুত্র এবং মায়ের উপদেষ্টা! এ ঘটনার সাথে যিনি আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িত তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখার মত হয়েছে। তিনি তাঁর স্ট্যাটাসে যা লিখেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস আমাকে অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্রে শফিক রেহমানের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা উদ্ঘাটন করেছে। তারা এ বিষয়ে প্রমাণাদি আমাদের সরকারের কাছে দিয়েছে। তাকে এই প্রমাণের ভিত্তিতেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি এর চেয়ে বেশি কিছু প্রকাশ করতে পারছি না। কিন্তু এই প্রমাণ দ্ব্যর্থহীন এবং অখণ্ডনীয়।

আমি আশাই করেছিলাম বিএনপি এটা নিয়ে মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে। যদিও আমি আশ্চর্য হয়েছি ইমরান সরকারের বিষয়ে। সম্ভবত শেষ পর্যন্ত তার আসল চেহারাটা উন্মোচিত হলো। এটা দেখে মনে হচ্ছে, সে আমাদের বেশির ভাগ সুশীলের মতোই, আরেকটা সুবিধাবাদী এবং মিথ্যাবাদী। হয়তো বিএনপি তাকে পয়সা দিয়েছে। কে জানে? যেভাবেই হোক, আমি তার প্রতি সব শ্রদ্ধা হারিয়েছি। তাকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে আমাদের সরকারের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

আমি আমার সকল বন্ধু এবং ভক্তদের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, যারা তাকে অনুসরণ করেন, তারা তাকে ফেসবুক থেকে আনফলো/আনফ্রেন্ড করুন। সে একজন অপরাধীর হয়ে কথা বলছে, যে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল।’

ইমরান বিএনপি থেকে টাকা পয়সা নিয়েছে এবং মিথ্যাবাদী! চমৎকার অভিযোগ দাঁড় করিয়েছেন জনাব জয়। এর স্বপক্ষে কোন প্রমানাদি তিনি দাখিল করেননি অভিযোগ উত্থাপন করেই তিনি খালাস। প্রমাণের দায় তিনি নেননি। প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাইরে জয় যেতে পারেরননি, চেনা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথেই তিনি হেঁটেছেন। জয়’এর মুরীদানরা তাঁকে যতটা উঁচুতে তুলে ধরেন, তিনি ততটা উপরে নন আসলে প্রচলিত রাজনীতির মতই বামণ!

ক্ষিপ্ত হয়েছেন বাম রাজনীতি থেকে ডানপন্থী বনে যাওয়া নূহ-উল আলম লেনিন। লেনিন লিখেছেন- ইমরান এখন ‘জাতির বিবেকের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। দেশের সকল ইস্যুতেই ইমরানের এখন মতামত দেওয়া, সক্রিয় ভূমিকা পালন করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। গণজাগরণ মঞ্চের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও তার পুরনো রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আনুগত্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা এবং ‘বনসাই’য়ে পরিণত হওয়া তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চকে সরকারবিরোধী মঞ্চে পরিণত করে ইমরান ও তার সহযোগীরা যে ইতোমধ্যে সার্কাসের ক্লাউনে পরিণত হয়েছে, সম্ভবত এই কাণ্ডজ্ঞানটুকুও তারা হারিয়ে ফেলেছে। ইমরানের এককালের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছ থেকেই শুনেছি, ইমরান কেবল বামদের নয়, দেশি-বিদেশি নানা সন্দেহভাজন শক্তি, সংস্থা ও ব্যক্তির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছেন। তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই তার লক্ষ্য।

‘ভিন্নমতের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তার ‘আত্মাহুতি’ দেওয়ার অঙ্গীকার বাংলাদেশের একটি প্রবচনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে।’

একজন বাম রাজনৈতিক কর্মীর ডানপন্থীতে রুপান্তরীত ভাঁড়ের প্রতিক্রিয়া দেখার মত। যিনি গণজাগরন মঞ্চকে খণ্ডিত করার চেষ্টা করে সফল হননি। টেলিফোন করে ধমকেছেন তাঁর পুরোনো রাজনৈতিক সহকর্মীদের। ধমক দিয়েছেন ফেলে আসা কর্মী উদীচী’এর সংগঠকদের মঞ্চের সাথে না জড়াতে। আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন, জাতে উঠেছেন দেশের সবাইকে বাপের ভৃত্য বলে মনে করেন।

পরস্পরের চাপান উতোর খেলায় যাপা পড়তে যাচ্ছে ইমরানের স্ট্যাটাসের দ্বিতীয় অংশ যেখানে তিনি লিখেছেন ‘দেশে যখন একের পর এক মানুষ খুন হচ্ছে, লেখক-প্রকাশক-বিদেশি থেকে শুরু করে মসজিদ-মন্দিরে ঢুকে মুয়াজ্জিন-পুরোহিতকে হত্যা করা হচ্ছে তখন খুনীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিটি বেমালুম চেপে যেতে যাই।’ রাষ্ট্রযন্ত্র এ খেলাটি জনগণের যাথে চালিয়ে যেতে চায়। আমাকে বাদ দিয়ে তোমার কোন মঙ্গল নাই, আমাতেই তোমার মুক্তি, আমা বিনে তোমার কোন গতি নাই, আমাতেই তোমার মোক্ষধাম ও লাভালাভ ঘটিবে!

নূহ-উল আলম লেনিনদের ভাষায় সব ব্যাপারেই কেন ইমরান ও ব্লগাররা কথা বলবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মাঝে মধ্যে ব্লগারদের টেনে আনছেন কোন কারণ ছাড়াই অপ্রাসংগিকভাবে। ব্লগাররা ক্ষমতাসীনদের চুরি, নৈরাজ্য, লুটপাট নিয়ে ক্রমাগত লিখে চলেছেন এটি হজম করা কঠিন। ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, শেয়ার বাজার লুট, নানান রকম উন্নয়ন বাজেটের ব্যয় ধরিত্রীর মধ্যে সর্বোচ্চ, সর্বোপরি দেশের রিজার্ভের ডলার লুট, এবং আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি, সেনানিবাসের ভেতরে একজন তরুণী হত্যা, এগুলো নিয়ে কথা বলা যাবে না। ব্লগাররা মাটির দিকে তাকিয়ে জ্বী জাঁহাপনা বলে তালিয়া বাজাবে। একের পর এক সহকর্মী খুন হবে আর ইমরান নির্বিকার থাকবে এবং এটি আশা করা হবে! ক্ষমতাসীনরা একটি নিয়ন্ত্রিত ব্লগার সমাজ চান। চেষ্টাও করেছেন জনাব নূহ-উল আলম লেনিন গং সবাইকে বাক বাকুম ডাকাতে। সবাই কী ডাকে? নির্বিকার থাকা দাসত্বের নামান্তর।

লেখক: রাজনীতিবিদ

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

লেখকদের নামঃ