বাহিনী পোষার জন্য টিআর-কাবিখার বরাদ্দ

প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০১৬, ২০:৪১

টিআর-কাবিখা কি এতই খারাপ জিনিষ যে লুটেপুটে খাওয়ার সংবাদ মিডিয়ায় আসলে সাংসদরা ডুবে যান?

টিআর-কাবিখা’র লুটপাট নতুন কোনো বিষয় নয়। এটি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। তবে মফস্বলে দলীয় নেতৃবৃন্দের কাছে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি সরকারের আমল থেকে। তবে এর আগেও এ সকল ত্রাণ লুটপাটের ঘটনা চলেছে, যদিও তা জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী অল্প সংখ্যক নেতাকর্মীরা করতেন। ফলে এ বিষয়ে তেমন প্রচার ছিলোনা।

শুধুমাত্র একমুখি অভিযোগের ফলে, যে বিষয়টি একেবারে আড়ালে চলে গেছে তা হলো, এর সাথে সরকারি কর্মকর্তারাও যে ব্যাপকভাবে যুক্ত তা কেউ বলছেন না। যদি বিষয়টি এমন হয় যে, ‘যখন এটি নিশ্চিতভাবেই আমাদের (সাংসদ) ওপর চেপেছে তখন অন্যকাউকে না জড়ানোই ভালো, পাছে আরও অনেক সত্য কথা বেড়িয়ে আসে‘। যদি এমনটি হয় তাহলে ভিন্ন বিষয়।

জাতীয় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বিনীতভাবে প্রশ্ন করতে চাই, আপনারা কি বলতে পারবেন, যখন নিজ নির্বাচনী এলাকায় যান কিংবা সেখানে আপনার যারা ঘনিষ্ঠজন আছেন, তারা যখন ঢাকায় আসেন তখন পকেটে করে টিআর-কাবিখা’র প্রকল্প বানিয়ে আপনার কাছে আনেন না?

জানি এটি অস্বীকার করতে পারবেন না, অন্য কোনো ব্যাখ্যা হয়তো দিতে পারবেন। কিন্তু টিআর-কাবিখা’র ব্যবস্থাপনা মফস্বলে যেভাবে হয় তার ধারণা কারো নেই এমনটি ভাবা কিন্তু বোকামী। এ সংক্রান্ত কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি-

১) প্রকল্প কমিটিতে দলীয় লোকজনকে ঢোকানো হয়, যাতে তারা সেখান থেকে লভ্যাংশ হিসেবে কিছু একটা পায়। এমনও দেখা গেছে, প্রকল্প কমিটিতে এমন একজনকে রাখা হয়েছে তিনি হয়তো প্রকল্পের সরাসরি সুবিধাভোগী নন। তাহলে কেন তাকে সেখানে রাখা হলো? স্থানীয় পদবীধারী নেতা হিসেবে? এই তৎপরতাটি মফস্বলে গণ্যমান্য ব্যক্তির ধারণা পাল্টিয়ে দিয়েছে। সেখানে গণ্যমান্য বলতে বোঝায় সরকারি দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীকে।

২) প্রকল্পগুলো সম্পূর্ণ সাংসদের এখতিয়ারভুক্ত। শুধুমাত্র নেতা-কর্মীদের পক্ষে রাখতেই টিআর-কাবিখার অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার হয়। দেখা গেছে, প্রত্যেক এলাকায় নির্বাচনের আগে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। এই বিভক্তির একভাগের নামকরণ হয় ‘টিআর খাওয়া’ গ্রুপ আর অপরটি ‘টিআর না খাওয়া’ গ্রুপ। এই না খাওয়া গ্রুপ যখন বলে, ‘ভোট টিআর যারা খেয়েছে তারাই যেন দেয়’-তখন এই গ্রুপকে ম্যানেজ করার জন্য সাংসদরা যার পর নেই তদ্বির করেন। তাহলে এমনটি কেন ঘটে?

৩) খাদ্য গুদাম থেকে টিআর-কাবিখা‘র যে চাল বা গম পাওয়া যায় তা খুবই নিম্নমানের। সরকার এটি যে দামে ক্রয় করে, বাজারে বিক্রয়কালে তার অর্ধেক দাম পাওয়াও দুঃসাধ্য। কম মূল্যে এই চাল বা গম এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ক্রয় করে মজুদ করেন। পরে সরকারিভাবে মজুদের উদ্দেশ্যে চাল-গম ক্রয়কালে ব্যবসায়ীরা সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে গুদামে সরবরাহের ‘স্লিপ’ ক্রয় করে পুরোনো্ চাল-গমের সাথে কিছু পরিমাণে নতুন চাল-গম মিশিয়ে গুদামে সরবরাহ করেন। এই প্রথায় রাজনীতিকরা কৃষক বনে যাওয়ারও সুযোগ পান। এগুলো অস্বীকার করার উপায় আছে কি?

৪) টিআর-কাবিখা যে লুটপাটের তার একটি বড় দৃষ্টান্ত হলো ২০০৯ সালে যখন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হলো তখন চেয়াম্যান-সাংসদ মতপার্থক্য চরম আকার ধারণ করে। কেউ কারো ছায়া মারাতে চান না। সরকারি কর্মকর্তারাও উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে চরম ক্ষমতার মালিক সাংসদ ছাড়া কিছু বোঝেন না। এতে মনঃক্ষুন্ন চেয়াম্যানদের সন্তুষ্ট করার জন্য অর্থাৎ চেয়ারম্যান বাহিনী পোষার জন্য তাদেরকে টিআর-কাবিখার বিশেষ বরাদ্দ চালু করা হয়। চেয়াম্যানরা এই বরাদ্দ দিয়ে যে নিজের বাহিনী পুষছেন তা কি অসত্য?

৫) উপজেলা পরিষদের তিনজন কর্মকর্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যারা হলেন, ১. উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার, ২. প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও), ৩. উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এদের নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। এই সম্পর্কের পেছনে যা আছে তা হলো- অবকাঠামো খাতের দুর্নীতির ভাগবাটোয়ারা এবং টিআর-কাবিখা খাতের বখরা। লক্ষ্য করলে দেখা যায় সাংসদের সাথে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরোধ দেখা দিলেও এই তিন কর্মকর্তার সাথে তার বিরোধ হয় না। এই যে মধুময়তা তার পিছনে কিন্তু একটি বাটোয়ারার সম্পর্ক রয়েছে।

৬) মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়ায় টিআর-কাবিখা লুটপাটের সংবাদ দেখা যায়। মজার বিষয় হলো এই সংবাদগুলো তখনই আসে যখন সংশ্লিষ্টরা ভাগ বঞ্চিত হন। এমনকি স্থানীয় মাস্তানরাও এই প্রকল্প কমিটির কাছ থেকে বখরা আদায় করে থাকে। অর্থাৎ যার যতটুকু ক্ষমতা সে ততটুকুই কাজে লাগিয়ে সুবিধা নেন-আর এটি সম্ভব কেবল দুর্নীতিযুক্ত খাতেই।

৭) এটি যে চরম দুর্নীতিময় খাত তার আরও একটি বড় প্রমাণ রাজনীতিকরা পরস্পর বিপরীতি মেরুর অধিবাসীদের সবসময় চোর সাব্যস্ত করেন। কিন্তু এই খাতের বেলায় মুখে কলুপ এঁটে রাখেন। কারণ এখানে দুর্নীতির পর্যায় এতটা প্রবল যে, এটি নিয়ে যদি টানা-হেঁচড়া হয় তাহলে কোনো সাংসদই রেহাই পাবেন না।
অনুসন্ধান করলে এমন আরও অনেক পর্যবেক্ষণ পাওয়া যাবে।

অতিসম্প্রতি ‘টিআর-কাবিখা’ বিষয়ক তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে যত প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল তাতে হতাশই হলাম। ভেবেছিলাম যে কোনো ভাবে বা কারণেই বিষয়টির অবতারণা হোক না কেন এই খাতের যে লুটপাট তা বন্ধ হবে। কিন্তু আশার গুড়ে বালি!! বরং বেশি হতাশ হয়েছি তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার ও ক্ষমা চাওয়া নিয়ে। বিষয়টি কি এমন যে, তিনিও এমন প্রকল্পের সুবিধাভোগী হয়েছেন যা অন্যদের কাছে প্রকাশিত? আর ভুতের মুখে রাম নাম আসলে প্রতিপক্ষ ছাড়বে কেন?

তবে এটিও স্বীকার করতে হবে, অনেক সাংসদ-মন্ত্রী-স্থানীয় নেতাকর্মী টিআর-কাবিখা’র যথাযথ ব্যবহার করেন। কিন্তু তারা পুরোপুরি সফল হতে পারেন না (৩নং পয়েন্টে বর্ণিত পর্যবেক্ষণের কারণে)। যারা যথাযথ ব্যবহার করেন তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। এরপরও বলতেই হবে, টিআর-কাবিখা পদ্ধতিটি সর্বাংশে দুর্নীতিযুক্ত।
প্রত্যাশা করি, টিআর-কাবিখার দুর্নীতিমুক্ত সাংসদরা বিষয়টি আবার আলোচনায় নিয়ে আসবেন এবং এই পদ্ধতিটি বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলবেন। এতে দুর্নীতির একটি বিশালযজ্ঞ রুখে দেওয়া সম্ভব হবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত