কবর খুঁড়ছে ওদের শিশুদের জন্যে

প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০১৮, ১২:১০

সকাল বেলা নাস্তা করে চায়ের সাথে খবরের কাগজ আর সিএনএন বিবিসি আল জাজিরা এইসব দেখতে থাকি। টেলিভিশনের দিকে মনোযোগটা সাধারণত আলগা আলগা থাকে- দিনের প্রস্তুতি, পারিবারিক আলাপ আলোচনা এইসবও চলতে থাকে একইসাথে। আজ সকালে আল জাজিরায় চোখ আটকে যায়- সারি সারি কবর খুঁড়ছে একদল মানুষ। ছোট ছোট কবর। আমি আর আমার স্ত্রী দুজনেই মনোযোগী হই। কি হয়েছে? এতো কবর!

ইয়েমেনের সাআদ প্রদেশে স্কুল বাসের উপর বোমা হামলা করেছে সৌদি আরব দুদিন আগে- ২৯টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

এই ইয়েমেনী লোকগুলি কবর খুঁড়ছে ওদের শিশুদের জন্যে, ওদের মৃত শিশুদের জন্যে। শিশুদের জন্যে কবর খোঁড়া- এর চেয়ে কঠিন কাজ আর কি হতে পারে আমাকে বলতে পারেন? একজন নয় দুজন নয়- উনত্রিশজন পিতা ওদের শিশুর মৃতদেহ বয়ে নিয়ে গিয়ে কবরে নামাবে। একজন পিতার জন্যে তার নিজের সন্তানের মৃতদেহ কবরে নামানোর চেয়ে হৃদয়বিদারক কাজ আর কি হতে পারে বলতে পারেন? যে শিশুটিকে একটি ছোট আঘাত থেকে রক্ষার জন্যে হাসতে হাসতে নিজের জীবন দিতে পারি- সেই শিশুটির মৃতদেহ!

আপনার যদি সন্তান থাকে, তাইলে আপনি বুঝতে পারবেন ব্যাথায় কতো তীব্র এই ব্যাথা। বুঝতে পারবে মৃত্যুর চেয়েও কতো অধিক করুণ একটি শিশুর মৃত্যু। সৌদি আরব নামক রাষ্ট্রটি উনত্রিশটি শিশুকে মেরে ফেলেছে প্লেন থেকে বোমা মেরে। স্কুল বাসে এইসব শিশুরা হয়তো তখন গাইছিল, খেলছিল, হা হা হি হি করে হাসছিল। পৃথিবীর পবিত্রতম স্থানগুলির চেয়েও পবিত্র ছিল শিশুদের বহন করা ঐ বাসটি। কতো বড় নৃশংস শয়তান পাষণ্ড হলে কেউ ছোট ছোট বাচ্চাদের বাসে বোমা ফেলতে পারে!

একজন পিতাকে টেলিভিশনের লোকের ইন্টারভিউ করছে। কথা বলতে পারছে না লোকটি। শক্ত মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক- চেহারা দেখলেই বুঝা যায় জীবনের কঠিন পথ মোকাবেলা করার শক্তি ওর আছে। কিন্তু শিশু পুত্রের মৃত্যু? চিৎকার করে কাঁদছে লোকটি। ওর এগারো বছরে বাচ্চাটা ছিল সেই বাসে। একজন শক্ত পুরুষের চোখের জল বড় কঠিন জিনিস গো ভাই। চোখের জন্যে বিলাপ করতে করতে পিতাটি কি বলছিল আরবিতে তার আক্ষরিক অনুবাদ আমি করতে পারবো না- কিন্তু ওর প্রতিটা শব্দে প্রতিটা আর্তনাদে প্রতি ফোঁটা চোখের জলে নিজের বুকে নিজের মুষ্টি ঠুকে করা প্রতিটা আঘাতে কি যন্ত্রণা আছে তার অনেকটাই আমি আমার বুকের গভীরে অনুবাদ করতে পারি অনায়াসে।

আমি জানি ওর ভাষা, সকল পিতাই জানে আরেকজন পিতার শোকের ভাষা। কোন শিশু তো আর ধর্ম রাষ্ট্র জাত পাত এইসব কিছু নিয়েই জন্মে না। প্রতিটি শিশুই মানুব শিশু। সেরকম প্রতিটি পিতাও সেরকম। বাপের হৃদয়ের কোন জাত হয় না ধর্ম হয়না। কোন পিতা আছে এই পৃথিবীতে যে আরেকজন পিতার চোখের জল পড়তে পারে না?

ফেসবুকে নিউজফিড জুড়ে আপনাদের পোষ্ট দেখি। ব্যক্তিগত সুখ দুঃখের পোষ্ট, ষড়যন্ত্র, গুজব আজব তাজ্জব সব পোষ্ট, প্রতিবাদ অনুবাদ এইসবও দেখি। বিকল্প নাই বিকল্প নাই বলে চীৎকার করছেন একদল সেইসবও দেখি। একজন হিরো আর একজন দৃশ্যমান উপসহকারি পরিচালক নিয়ে একটি দল- ওদের নানাপ্রকার গুরুগম্ভীর 'বিপ্লবী' পোষ্ট দেখি। কবিদের হাহুতাশ ফটোগ্রাফারদের কেরামতি দেখি। না, এগুলিকেও তুচ্ছ করি না। এসবেরও গুরুত্ব আছে। কিন্তু আবার মনে হয় কি হবে এইসবে! কার জন্যে? কিসের জন্যে? এই যে আমেরিকার সাথে মিলে সৌদি আরব এতোগুলি শিশু মেরে ফেললো, তার কি হবে? আজ মেরেছে, কাল আবার মারবে, পরশু আবার আবার আবার মারবে।

কবে বন্ধ হবে? কবে আপনার বুঝবেন যে এইসব রাষ্ট্র আইন পুলিশ যুদ্ধ যুদ্ধাস্ত্র সীমান্ত সার্বভৌমত্ব নামক ফালতু বাত এইসব সব কিছুই অর্থহীন? কবে বুঝবেন যে এইসব সবকিছুই তুলে দিতে হবে? এই সবকিছুই তুলে দিতে হবে, তবেই না এই বিশ্ব শিশুর বাসযোগ্য হবে। কবে বুঝবেন?

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত