আহা, ওদের জীবন কতো'ই না রঙিন (ভিডিও)

প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০১৮, ১১:৫৯

আচ্ছা, ছেলে গুলো কি বেঁচে আছে এখনো?
বেঁচে থাকলে ওরা এখন কোথায়? কিংবা ওদের অবস্থা'ই বা এখন কেমন?

২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ান এক সাংবাদিক একটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন; নাম হচ্ছে- "দ্যা ওয়ার্ল্ড'স মোস্ট ডেঞ্জারাস জার্নি", অর্থাৎ পৃথিবীর সব চাইতে ভয়ংকর ভ্রমণ।

অবৈধ উপায়ে সীমান্ত পার হয়ে যারা আমেরিকায় প্রবেশ করে, তাদের নিয়ে তিনি ওই ডকুমেন্টারি'টি বানিয়েছেন।

প্রায় ২০ জনের মতো একটি দলের সঙ্গে তিনিও রওনা হয়েছিলেন অবৈধ উপায়ে সীমান্ত পার হবার অভিজ্ঞতা মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য।

ওই ২০ জনের দলে আফ্রিকার কিছু দেশের লোকজন ছিল, সেই সঙ্গে নেপাল এবং বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষজনও ছিল। ইংরেজিতে বানানো সেই ডকুমেন্টারি'তে আমি বেশ কয়েকজন'কে বাংলায় কথা বলতে শুনেছি।

তো এই দলটির সদস্যরা নানান দেশ পার হয়ে কলোম্বিয়াতে এসে পৌঁছানর পর ওই সাংবাদিক এদের সঙ্গে যুক্ত হন। কলোম্বিয়া থেকে পায়ে হেঁটে বন-জঙ্গল পার হয়ে তাদের পৌঁছাতে হবে পানামা। পানামা থেকে যেতে হবে কোস্টারিকা; সেখান থেকে নিকারাগুয়া পার হয়ে এরপর হন্ডুরাস, গুয়েতেমালা পার হয়ে মেক্সিকো! এরপর সেখনা থেকে আমেরিকা!

এ এক কঠিন পথ! শুধু মাত্র কলোম্বিয়ার জঙ্গল পার হবার যেই ভিডিও চিত্র ওই সাংবাদিক ধারণ করেছেন, সেটা দেখেই আমার ভয় লেগেছে।

জনমানবহীন জঙ্গল পার হতে হবে, সেখানে রয়েছে ডেঙ্গু মশা থেকে শুরু করে নানান সব ভাইরাস ছড়ানো পোকা-মাকড়। এক নাগাড়ে সাত- আট ঘণ্টা হাঁটতে হবে; হাঁটতে না পারলে পুরো দল আপনাকে ছেঁড়ে চলে যাবে!

এছাড়া জঙ্গলের মাঝে ক্যানেল রয়েছে, সেই খাল পার হতে হবে গাছের ভাঙা ডাল-পালা দিয়ে বানানো সেতু দিয়ে! এ এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা!

চলতি পথে এর আগে যারা সীমান্ত পার হতে গিয়ে মারা গিয়েছে, তাদের কঙ্কাল!

আমার তো ঘরে বসে এই ডকুমেন্টারি দেখেই ভয় লেগেছে! তবে শেষ পর্যন্ত এই দলটি অবশ্য পানামা সীমান্তে পৌঁছাতে পেরেছে। পানামার সীমান্তরক্ষী বাহিনী অবশ্য পুরো দলটি'কে পানামায় ঢুকতে দেয়নি। তাদের আবার কলোম্বিয়া সীমান্তে পাঠিয়ে দিয়েছে।

ওই সাংবাদিক আর তার সহকর্মীর যেহেতু বৈধ পাসপোর্ট ছিল, যেই পাসপোর্ট দিয়ে বিনা ভিসায় পানামায় ঢুকা যায়, তাই পানামার নিরাপত্তা বাহিনী কেবল ওদের দুজন'কে ঢুকতে দিয়েছে।

এই ডকুমেন্টারি'র একদম শেষে ওই সাংবাদিক বলেছেন
- আমার ঠিক জানা নেই, এই দলটির মানুষ গুলো এখন কোথায় আছে। আমি কয়েকজনের ই-মেইল এড্রেস নিয়েছিলাম। অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে অনেকবার মেইল করেছি, তাদের খোঁজ নেয়ার জন্য। কিন্তু কোন উত্তর পাইনি।

এই দলে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি ছিল। দেখতে শুনতে বেশ মার্জিত এবং চমৎকারই মনে হচ্ছিলো। এই মানুষ গুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে কেন বিদেশে যেতে চায় আমার ঠিক জানা নেই।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত দেশে এদের কারো অর্থনৈতিক অবস্থাই খুব একটা খারাপ না। আমি ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। বাংলাদেশ থেকে যারা বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় অবৈধ পথে যাবার চেষ্টা করে; এদের সবার দেশে আর্থিক অবস্থা মোটামুটি বেশ ভালো।

তাছাড়া দালালদের তো একটা মোটা অংকের টাকা দিতে। নইলে তো আপনি যেতে পারবেন না। এতো টাকা খরচ করে জীবনের ঝুঁকি কেন নিতে হবে?

যেই টাকা খরচ করে বিদেশ পাড়ি দেয় এই মানুষ গুলো, সেই টাকা দিয়ে দেশে কিছু করলে ক্ষতি কি?

দূর থেকে ইউরোপ-আমেরিকার জীবন মনে হয় কতো আলো-ঝলমলে রঙিন। আসলে কি তাই?

ইউরোপ আমেরিকাতে যেই সব বাংলাদেশিরা থাকে তারা কি সবাই মহা আনন্দে আছে? দূর থেকেই আসলে শুধু মনে হয় কতো আনন্দেই না আছে।

গিয়ে দেখেন, দিন রাত কাজ করতে হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য। এরপরও হয়ত যেই টাকা রোজগার করছে, তাতে হচ্ছে না; দেশে পাঠাতে হবে! এক শিফটের জায়গায় দুই শিফট কাজ করছে! ভালো করে নিঃশ্বাস নেবার সময় নেই!

অর্থ উপার্জন করতে হবে, সেটেল হতে হবে, দেশে টাকা পাঠাতে হবে, সফল হতে হবে; এই যে চাপ, সেটা অনেকে সহ্যও করতে পারে না। এমনকি এর জন্য অনেকে মানসিক সমস্যায়ও আক্রান্ত হয়।

ঘরে ফিরে এসে ছোট একটা রুমে চার-পাঁচজন মিলে কোন ভাবে জীবন পার করছে। আর কোথাও খেতে গিয়ে কিংবা ঘুরতে গিয়ে রঙিন আলো-ঝলমলে একটা জায়গায় সেলফি তুলে ফেইসবুকে দিচ্ছে; আর আপনি ভাবছেন- আহা, ওদের জীবন কতো'ই না রঙিন। আর আমি দেশে বসে ধূসর জীবন কাটাচ্ছি।

আর বিদেশে অনেক দিন থেকে সেটেল হবেন? তাতেও সমস্যার খুব একটা সমাধান হবে না।

আপনি এবং আপনার পরের প্রজন্মের বাচ্চারা যারা বিদেশে জন্মাবে; তাদেরকে এরা ফরেনারই মনে করবে। আমেরিকান কিংবা ইউরোপিয়ান মনে করবে না।

আপনি মনে করছেন- আমি না হয় আমেরিকান হতে পারেনি কিংবা ইউরোপিয়ান হতে পারেনি; আমার বাচ্চা তো এই দেশে জন্মেছে, স্কুলে যাচ্ছে। আমি ওকে আমেরিকান কিংবা ইউরোপিয়ান হিসেবে বড় করবো।

কিন্তু ওই বাচ্চাই যখন আপনার বাসার বাইরে যাবে- লোকজন তাকে বাংলাদেশি কিংবা বিদেশি হিসেবেই চিনবে জানবে।

খুব বেশি দূর যেতে হবে না। জার্মানির ফুটবল খেলোয়াড় ওজিলের কথা মনে আছে তো?

জার্মানির পক্ষে বিশ্বকাপ জিতেও কোন ফায়দা হয়নি। এই বেচারকে জার্মানরা কতো ভাবেই না বিদেশী বলে অপমান করার চেষ্টা করেছে। শেষমেশ জাতীয় দলে না খেলার'ই সিদ্ধান্ত নিয়েছে!

চাইনিজ বাবা-মা'র ঘরে জন্ম নেয়া এক চাইনিজ আমেরিকান এইতো কয়েকদিন আগে আমেরিকার হয়ে উইন্টার অলিম্পিকে গোল্ড জিতেছে; আর আমেরিকান সংবাদ মাধ্যম গুলো সংবাদের শিরোনাম করেছে- একজন ইমিগ্রেন্টের আমেরিকার হয়ে স্বর্ণ পদক লাভ!

ওই মেয়ে শেষমেশ মনের দুঃখে লিখেছে- আমি জন্মালাম আমেরিকায়, বড় হলাম আমেরিকায়, মনে প্রানে আমি একজন আমেরিকান, আমেরিকার হয়ে অলিম্পিকে স্বর্ণ পদক পর্যন্ত জয়লাভ করলাম; আর আমার পরিচয় কিনা হলো- ইমিগ্রেন্ট, আমেরিকান না!

এই হচ্ছে অবস্থা। দেশে থেকে মনে হয় মানুষজন কি মহা আনন্দে'ই না আছে ইউরোপ-আমেরিকায়!

যারা অনেক দিন ধরে বিদেশ থাকছে, তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, দেখবেন তারা বলবে- সুযোগ থাকলে আমি বাংলাদেশেই ফেরত যাবো।

হাজারো সমস্যা থাকতে পারে নিজের দেশে। তবে নিজ দেশে থাকার যেই আনন্দ, সেই আনন্দ পৃথিবীর আর কোন দেশে আপনি পাবেন না।

যারা দীর্ঘদিন বিদেশে থাকে, তারা সবাই এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তারা নিজেরাও সেটা খুব ভালো করে জানে। তাদের বাদ বাকী জীবন কেটে যায় এটা ভাবতে ভাবতে- একদিন আমি দেশে ফেরত যাবো, দেশের সেই পুরনো জীবনকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করবো।

আপনারা যারা বিদেশে বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে যাওয়ার জন্য একরকম মরিয়া হয়ে আছেন; হাজার বার ভেবে সিদ্ধান্ত নিন।

দূর থেকে আলো-ঝলমলে ইউরোপ-আমেরিকার অন্ধকার দিক'টি আপনাদের দেখা হয়নি। কারণ সেই অন্ধকার দিকটি কেউ দেখাতে চায়না। বাস্তব কিন্তু এখানে রঙিন নয় বরং ধূসর।

বিদেশে যাওয়ার জন্য "দ্যা ওয়ার্ল্ড'স মোস্ট ডেঞ্জারাস জার্নি", কিংবা পৃথিবীর সব চাইতে ভয়ংকর জার্নি করার দরকার নেই; তার চাইতে নিজের দেশে থাকুন। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনায় বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ভালো থাকুন কিংবা চেষ্টা করুন ভালো থাকার। বিদেশ যাওয়াই সমাধান নয়।

তখন শুরু হবে আরেক যুদ্ধ, যেই যুদ্ধে জয়ী হওয়া বড্ড বেশি'ই কঠিন। কারণ যুদ্ধটা একাই করতে হয় একাকীত্ব'কে সঙ্গী করে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত