ছেলেটা আত্মহত্যা করেনি, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে

প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১০:৪৬

ছেলেটা মরেই গেলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেটা আত্মহত্যা করেছে। কারণ হিসেবে জানা গেছে- তাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করত।

তো কেন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত? কারণ এই ছেলের রেজাল্ট খারাপ ছিলো সেই সঙ্গে সে দেখতে ভালো না। অর্থাৎ কালো- হ্যাংলা-পাতলা!

এই ছেলের রেজাল্ট খারাপ হবার কারণে শিক্ষক’রা নাকি ক্লাস রুমেই অনেকের সামনে তাকে অপমান করেছে! ছেলে শেষমেশ ডিপার্টমেন্ট পরিবর্তন করতে চেয়েছিলো; এই জন্যও নাকি তাকে অপমানিত হতে হয়েছে। শিক্ষকরা ভালো ব্যাবহার করেনি, এমনকি তার বন্ধু-বান্ধবরাও নাকি হলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো। এতো সব চাপ সহ্য করতে না পেরে এই ছেলে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে।

এই ছেলে তো আত্মহত্যা করে পার পেয়ে গেছে; এই রকম কত ছাত্র-ছাত্রী যে ত্যাদের শিক্ষক এবং বন্ধু বান্ধবদের অবহেলার কারণে আত্মহত্যা করতে গিয়েও করতে পারছে না; তার কোন হিসেব নেই।

এক অবাক করা শিক্ষা ব্যবস্থা আর সমাজ আমরা তৈরি করে রেখেছি!

আমি নিজে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, আমাদের শিক্ষকরা যেই সব ছাত্র-ছাত্রীদের রেজাল্ট ভালো, কেবল তাদেরকেই মানুষ মনে করতো, অন্যদের মানুষ মনে করত কিনা সেই নিয়ে আমার সন্দেহ আছে! ছাত্র মনে করা তো অনেক দুরের ব্যাপার! অথচ শিক্ষকের কাজ হচ্ছে সবার কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেয়া। আমি প্রথম যখন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম, সেখানকার প্রোগ্রাম হেড আমাদের বলেছিলেন

-তোমারা কে ভালো ছাত্র-কে খারাপ ছাত্র, কার গ্রেড কেমন হবে, সেটা নিয়ে আমাদের মোটেই কোন মাথা ব্যাথা নেই। তোমরা কে কই থেকে এসছ, কে দেখতে কেমন, এই নিয়েও আমাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তোমরা সবাই এখন আমাদের ছাত্র। তাই সবাই আমাদের কাছে সমান।

আমি কখনো দেখিনি কেউ ভালো ছাত্র কিংবা কারো গায়ের চামড়া সাদা বলে কেউ আলাদা সুবিধা পাচ্ছে।

আমি নিজে এখন ইউরোপের দুই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি। দুটো ডিপার্টমেন্টের হেডও আমি। নানান দেশ থেকে ছাত্র-ছাত্রী পড়তে আসে। আমার মনে হয় না, আমি কোন দিন কারো সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেছি কিংবা কাউকে বলেছি- তোমার তো রেজাল্ট ভালো না, তুমি আবার কিসের ছাত্র!

আমি বরং উল্টো বলে বেড়াই, রেজাল্ট দিয়ে কি হবে! তার চাইতে বরং ঠিক থাক মতো কিছু জানতে পারলেই তো চলছে। আমার ডিপার্টমেন্টে যেই সব ছেলে-পেলে গুলো পড়ালেখায় খানিক পিছিয়ে আছে, আমি নিজ থেকেই তাদের সঙ্গে আলাদা করে সময় কাটাই। যাতে তাদের পরিস্থিতি বুঝে সেই অনুযায়ী উৎসাহ দেয়া যায়।

আর কেউ আফ্রিকা থেকে এসছে কিংবা কেউ ইউরোপ থেকে এসছে, কারো গায়ের রঙ কালো, কারো গায়ের রঙ ফর্সা সেই জন্য আলাদা সুবিধা পাবে? প্রশ্ন’ই আসে না।

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা যায়গায় ছেলেটার গায়ের রঙ সামান্য কালো আর হ্যাংলা-পাতলা বলে তাকে কিনা প্রতিনিয়ত অপমান সহ্য করতে হয়েছে! তো, হলে তার অন্য বন্ধুরা কেন তাকে এভাবে অপমান করত? কারণ এই সব শিক্ষা এরা তো এদের শিক্ষকদের কাছ থেকেই পেয়েছে।

এই ছেলেটাকে নিয়ে তো তার শিক্ষকরা ক্লাসেই হাসাহাসি করেছে ! তো ছাত্ররা তো এইসবই শিখবে!

ছাত্র-শিক্ষক যে চমৎকার বন্ধু হতে পারে, সেটা আমাদের সমাজ শেখায় না। আমাদের সমাজ শেখায় কিভাবে দূরত্ব তৈরি করতে হয় এবং সেই দূরত্ব তৈরি করা হয় অন্যকে ছোট করার মাধ্যমে। এই ছেলেটা ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমি সব সময় বলে এসছি- আমার ধারনা আমরা বাংলাদেশিরা অন্যকে ছোট করার অদ্ভুত এক ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছি! অন্যকে ছোট করেই আমরা জগতের সকল মজা এবং আনন্দ উপভোগ করি!

আমাদের শিক্ষকরা কিভাবে যে শিক্ষক হয়ে গিয়েছেন, আমার ঠিক জানা নেই। ছাত্রদের এরা উৎসাহ দিতে জানে না, ছাত্র-ছাত্রীরা উল্টো তাদের ভয় পায়। অথচ আমার এখানে যে কেউ আমার সঙ্গে যখন তখন কথা বলার সুযোগ পায়। আমাদের শিক্ষক’রাই তো ঠিক নেই। এরা কি করে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছেন! কিংবা যেই শিক্ষা দিচ্ছেন, সেটা কি আদৌ সঠিক শিক্ষা!

সমস্যা তো মুলে! ছেলেটা আসলে আত্মহত্যা করেনি, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত