বাঙালির প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০১৭, ১৫:১৫

বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আপনাদের একটি হৃদয়ের কথা বলি। এই ভদ্রলোককে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসি কেননা তিনি আমাদেরকে ভালবেসেছিলেন। এই ব্যাপারটি আপনারা তরুণরা কতোটুকু অনুভব করেন আমি জানিনা- কেননা বাঙালির অর্থনৈতিক অবস্থা এখন বেশ ভালো, আমরা টেস্ট ক্রিকেট খেলি, ঢাকা শহরে কোটি টাকা দামের গাড়ী হেলায় বিচরণ করে, বাংলাদেশের বাজেট এখন লক্ষ কোটি টাকার হয়, বাঙালির প্রোটিন ইনটেক বেড়েছে, মানুষ না খেয়ে থাকেনা, ঢাকা শহরে আপনি খালি পায়ে খালি গায়ে মানুষ দেখবেন না, বাঙালির গড় উচ্চতা, গড় ওজন, গড় আয়ু সবই বেড়েছে। আপনারা অনেকেই সেই ‘দুখিনী বাংলার’ লাঞ্ছিত বঞ্চিত সময় দেখেননি।

বঙ্গবন্ধু সেই অবহেলিত লাঞ্ছিত বঞ্চিত বাঙালিকেই ভালবেসেছিলেন। ভালবেসেছিলেন কেন বলছি- বিশেষ ভাবে এই শব্দটি ‘ভালোবাসা’- কেন বলছি? কেননা বঙ্গবন্ধুর সাথে বাঙালির যে সম্পর্ক সেটাকে আপনি ভালোবাসা বা প্রেম ছাড়া আর কিছুই বলতে পারবেন না। আপনি যখন কাউকে ভালবাসেন তখন কি হয়? যাকে ভালবাসবেন তাকে মনে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম মানুষ। তার কোন ত্রুটি আপনাকে ভালোবাসা থেকে বিরত রাখতে পারবে না। সদ্য প্রেমে পড়েছে যে কিশোরীটি, ওকে বলে দেখেন তো যে তোমার প্রেমিকের গা থেকে পাঁঠার গন্ধ আসে! দেখেন সে কি জবাব দেয়। ঐ পাঁঠার গন্ধওয়ালা যুবকের প্রতি তার আকর্ষণ মোটেই কমবে না, উল্টা আপনার প্রতি তার ভক্তি কমে যাবে।

বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রেম ছিল এইরকম। বাঙালির প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়। বাঙালির প্রতি তাঁর আস্থা ছিল অবিচল। বাঙালির প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল অগাধ। বাঙালিকে তিনি দেখতে চাইতেন সর্বত্র সব ক্ষেত্রে পৃথিবীর সবার আগে। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে এদেশের অগ্রণী সব শিল্পী, সাহিত্যিক, খেলোয়াড় এদের কাছে যদি গল্প শুনতে চান, দেখবেন এঁরা সকলেই একটা কথা বলবেন- বঙ্গবন্ধু গুণ লোকদের শ্রদ্ধা করতেন এবং চাইতেন যে তাঁরা তাঁদের কাজ দিয়ে পৃথিবীর সবখানে দেশকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করুক।

শিল্পী শাহাবুদ্দিনের গল্পটা আপনারা হয়তো জানেন। আমি নিজেই অনেকবার লিখেছি। যুদ্ধ ফেরত শাহাবুদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেছেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বলছেন, প্যারিস যা, প্যারিসে গিয়ে ভাল করে ছবি আকার শিখ। পিকাসোর চেয়ে বড় শিল্পী হতে হবে, পারবি না? পৃথিবীকে দেখিয়ে দে, বাঙালি সব পারে।

দশই জানুয়ারির বক্তৃতাটা শোনেন। লম্বা বিমান ভ্রমণ করে মাত্র দেশের মাটিতে পা রেখেছেন নেতা। তাঁর শরীরটাও ভালো ছিল না। লাখো মানুষ জড়ো হয়েছে- নেতাকে দেখবে, সদ্যস্বাধীন দেশের জনতা। ওদের সামনে বক্তৃতা দিতে উঠলেন, তাঁর চোখে জল ঝরছে অঝোর ধারায়। সে জলে ভিজতে ভিজতে বঙ্গবন্ধু ভেজা গলায় অহংকার করে বলছেন, কবিগুরু বেঁচে থাকলে বলতাম, কবিগুরু, তুমি দেখে যাও, আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। কি প্রগাঢ় ভালোবাসা থাকলে একজন নেতা তাঁর জনতাকে নিয়ে এরকম অহংকারী হতে পারেন! এবং বাঙালির প্রতি ওঁর সে কি বিশ্বাস! কখনো কেউ তাঁকে বিশ্বাস করাতে পারেনি যে কোন বাঙালি তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারে। শেষ নিঃশ্বাসটি ত্যাগ করার সময়ও এই বাঙালির প্রতি এই বিশ্বাস অটুট ছিল।

পণ্ডিতরা কি বলবেন- উগ্র জাতীয়তাবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি! আপনাদের কথা ঠিক কি ভুল সে নিয়ে আলোচনা করবো না। আমি শুধু জানি বাঙালিকে এই লোকটি চেয়ে বেশী কেউ ভালোবাসেনি, বাঙালিকে এই লোকটির চেয়ে বেশী কেউ শ্রদ্ধা করেনি, বাঙালির জন্যে এই লোকটির চেয়ে বেশী কেউ কাঁদেনি। খৃস্টের কথা মনে পড়ে- পৃথিবীর সকল মানুষের পাপ নিজের কাঁধে নিয়ে ক্রুশে বিদ্ধ হয়েছিলেন এই দেবোম্মাদ যুবক। বাঙালির শত জনমের পাপ বুকে নিয়ে চলে গেছেন এই একটি দীর্ঘদেহী মানুষটি, যার পরনে ছিল সফেদ পাঞ্জাবী, হাতে বাঁকানো পাইপ।

আপনি আমি ওঁকে কি দেব? ওঁকে সম্মান দেখানোর সেই যোগ্যতা আপনার আছে? বুদ্ধি হবার পর থেকে জেনেছি, আমি কেবল তোমাকে ভালোবাসতে পারি, আর ভালোবেসে একটুখানি কাঁদতে পারি। আর কি!

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত