শিশুদের নজরুল

প্রকাশ : ২৫ মে ২০১৬, ১১:৩৩

সাহস ডেস্ক

অনেক দুঃখে পাওয়া সন্তান বলে ছোটবেলায় তার নাম রাখা হয়েছিলো দুখু মিয়া। তার জীবনের সাথেও এই নামটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। সেই ছোট্ট দুখু মিয়া বড়ো হয়ে অনেক বড় কবি হয়েছিলেন। তবে এমনটি যে হবে সে লক্ষণ দেখা গিয়েছিলো সেই ছোটবেলাতেই। বুঝতেই পারছো কার কথা বলছি। তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ২৫ মে (বাংলা ১১ জৈষ্ঠ্য) তার জন্মদিন।

তোমরা কখনো কবির লড়াই দেখেছ? না না ঢাল-তলোয়ার বা রাইফেল নিয়ে লড়াই নয়। এ লড়াই কলমের। এ লড়াই ছন্দের। অনেক আগে গ্রামে গ্রামে এমন লড়াই হতো। এখনো যে হয় না তা নয়। তবে আগের মতো হয় না। দিনক্ষণ ঠিক করে একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত করা হয় দু’ জন কবিকে। দুই কবি সেই অনুষ্ঠানে মুখে মুখে কবিতা রচনা করে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। একে অন্যকে ঘায়েল করার এই লড়াই রেসলিং বা বক্সিংয়ের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। তবে এই লড়াইয়ে কেউ গায়ের জোর খাটায় না।

কারণ এখানে গায়ের জোরের চেয়ে বুদ্ধি আর মেধার জোরই বেশি প্রয়োজন। যেমন দরকার উপস্থিত বুদ্ধি, তেমনি দরকার ভাষা জ্ঞান, ছন্দ জ্ঞান আর কবিতার মিল দেয়ার ক্ষমতা। বুদ্ধিমান, ধর্ম, ইতিহাস ইত্যাদিতে জ্ঞানবান লোক ছাড়া কবিদের এই লড়াইয়ে কেউ অংশ নেয় না। কিন্তু ১২ বছরের এক ছেলে এই নিয়ম উল্টে দিয়েছিল। কেন জানো? বয়স কম হলেও সেই ছেলেটির ধর্ম, ইতিহাস, ভাষা, ছন্দ আর কবিতায় মিল দেয়া সম্পর্কে ছিল পাক্কা ধারণা। কবিদের কঠিন লড়াইয়ে নামতে একেবারেই ভয় ছিল না তার।

এক দিনের ঘটনা। এক বুড়ো কবিয়ালের সাথে তার লড়াই শুরু হলো। বুড়ো তো আচ্ছা খুশি। যাক, ছোকরাকে আজ ধোলাই করা যাবে। কিন্তু বুড়ো তাকে ধোলাই করবে কী, নিজেই ধোলাই হয়ে গেল। পুচকে কবি তার বুড়ো প্রতিদ্বন্দ্বিকে লক্ষ্য করে বলল-

ওরে ছড়াদার, ওরে ‘দ্যাট’ পাল্লাদার

মস্তবড় ‘ম্যাড’

চেহারাটাও মানকি লাইক

দেখতে ভারী ‘ক্যাড’

‘মানকি’ লড়বে বাবরকা সাথ

ইয়ে বড় তাজ্জব বাত

জানে না ও ছোট্ট হলেও

হামভি ‘লায়ন ল্যাড’।

যাকে তুমি ছোট ভাবছ সে ছোট হলেও সাধারণ ‘ল্যাড’ অর্থাৎ বালক নয়। সে লায়ন ল্যাড। মানে বুঝতে পারছ তো? ‘লায়ন ল্যাড’ মানে সিংহের বাচ্চা। তার মানে পুচকে কবি নিজেকে সিংহের বাচ্চার মতো সাহসী দাবী করছে! প্রতিপক্ষকে সে তুলনা করল ‘মানকি’ অর্থাৎ বানরের সাথে আর নিজেকে তুলনা করল বাবরের সাথে। বাবর কে জানো তো? হ্যাঁ, মোগল বাদশা বাবরের কথাই বলছে। তিনি শুধু এক অসাধারণ বীরই ছিলেন না, অসাধারণ শক্তিমান মানুষও ছিলেন। শোনা যায় দুই বগলে দু’জন বড় মানুষকে নিয়ে তিনি দিব্যি পাঁচিলের ওপর দিয়ে দৌড়াতে পারতেন। ছোট্ট কবিয়াল নিজেকে সেই বাবরের সাথে তুলনা করল। বোঝা গেল ইতিহাস তার ভালোই জানা আছে।

আচ্ছা, এতোক্ষণ যে লায়ন ল্যাড মানে সিংহের মতো সাহসী পুঁচকে কবির কথা বললাম তাকে তোমরা চিনতে পেরেছ তো? ঠিক ধরেছো, সিংহের মতো সাহসী এই পুঁচকে কবি ছিলেন আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম যাকে আমরা বিদ্রোহী কবি হিসেবেই বেশি চিনি। সেই ছোটবেলা থেকেই তার ডিকশনারিতে ‘ভয়’ বলে কোনো শব্দ ছিল না। ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পেত না এমন লোক খুব কমই ছিল। ভেবো না এই দলে নজরুলও ছিল। বরং সেই ছিল একমাত্র সাহসী ছেলে যে ব্রিটিশদের মুখের উপর বলে দিলো ‘ভারত ছাড়ো।’

এই যে এতো সাহস যার বুকে তার জন্ম কোথায় জানো? পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। সালটা ছিল বাংলা ১৩০৬ এর ১১ জ্যৈষ্ঠ। তার বাবার নাম ফকির আহমদ, মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। ফকির আহমদের ছিল তিন ছেলে আর এক মেয়ে। প্রথম সন্তানের জন্মের পর তার পরপর চারটি সন্তানের মৃত্যু হয়। এর পর নজরুলের জন্ম। অনেক দুঃখে পাওয়া সন্তান বলে নজরুলের নাম রাখা হলো দুখু মিয়া। নজরুলের জীবনের দুঃখের সাথে এই নাম অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। নজরুলের যখন আট বছর বয়স তখন তাঁর বাবা মারা গেলেন। এমনিতেই তাদের বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না তার উপর বাবা মারা যাওয়ায় ভীষণ বিপদে পড়ে গেল তার পুরো পরিবার। নজরুলের বাবা দরগায় খাদেমগিরি করতেন।

গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন। পাড়ায় মিলাদ পড়াতেন। এ সব করে করে যে সামান্য পয়সা রোজগার হতো, তাই দিয়ে তাদের সংসার চলত। জমি-জায়গা তাদের কিছুই ছিল না।

বাবা মারা যাওয়ার পর কিশোর দুখু মিয়া আসানসোলের এক কয়লা খনিতে কাজ জুটিয়ে নেয়। কিন্তু অতটুকু ছেলে বেশি আয় করতে পারে না। যা করে তা দিয়ে সংসার চলে না। তা ছাড়া কাজ করতে গেলে তার পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যায়। নজরুল তাই গ্রামে এসে পাড়ার মক্তবে পড়ালেখা শুরু করে। বছর দুই পরে মক্তবের পরীক্ষায় পাসও করল সে।

নজরুল ছিল অসম্ভব মেধাবী। যে ক্লাসে পড়ত সেই ক্লাসের ছাত্রদের অনায়াসে পড়াতে পারত সে। তার হাতের লেখা যেমন সুন্দর, তেমনি সুন্দর তার পড়ার ভঙ্গি। যেমন সুন্দর করে সে বাংলা পড়ত, তেমন সুন্দর করে পড়ত আরবি। নামকরা ক্বারীরা তার আরবি পড়া শুনে অবাক হতেন। গ্রামের অশিক্ষিত লোক তাই নজরুলকে একটা খুদে পণ্ডিত ভাবলেন। আর এতে নজরুলের লাভ হলো। সে গ্রামের মক্তবের মাস্টার হয়ে গেল। সবাই ভাবল, এতে নজরুলের দুই পয়সা আয় হবে। এই আয় দিয়ে হয়তো তাদের সংসারও চলে যাবে।

বাবার সাথে থেকে থেকে নজরুল ওই বয়সে ইসলামি চালচলনটিও ভালো রপ্ত করে নিয়েছিল। নামাজ-রোজা থেকে শুরু করে আজান দেয়া সব কিছুতেই ছিল পাক্কা। গ্রামের লোকে তাই একই সাথে তাকে মসজিদের মোয়াজ্জিন আর ইমাম বানিয়ে দিল। নজরুলের বয়স তখন এগারো। যা হোক, এই কাজে নজরুলের মন ভরে না। হাজার হোক শিশু তো। দুনিয়াকে জানার তার দারুণ কৌতূহল। তার মধ্যে ছিল এক বিরাট কাব্য সঙ্গীত প্রতিভা। এক দিন নজরুলের সেই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ এলো। তার দূর সম্পর্কের চাচা মুন্সী বজলে করিম ছিলেন গ্রাম্য কবি। তিনি বাংলার সাথে আরবি-ফারসি মিলিয়ে গজল লিখতেন। তার দেখাদেখি পদ মিলাতে গিয়ে দেখেন নজরুলও গান লিখতে পারে। নজরুলের ছিল ভীষণ পড়ার নেশা।

বাংলা পড়তে শেখার সাথে সাথে পাঠ্যবই ছাড়াও নানা রকম পুঁথির বই পড়ে শেষ করল সে। রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে জঙ্গনামা, লাইলী-মজনু, মুসলমানের সব রকম পুঁথি পড়ে সে প্রায় কণ্ঠস্থ করে ফেলল। এমন স্মৃতিশক্তি তার, একবার পড়লে আর কিছুই ভোলে না। এমন বিদ্যা নিয়ে মাত্র বারো বছর বয়সেই এক ক্ষুদে কবি হয়ে উঠল সে। চাচার মতো করে লিখে ফেলল এক গজল।

নামাজ পড়ো মিয়া

ওগো নামাজ পড়ো মিয়া

সবার সাথে জমায়েতে

মসজিদেতে গিয়া।

ক্ষুদে কবি গজলে নামাজ শিক্ষা দেয়। কিন্তু এতে যে তার সংসারের অভাব যায় না। বাড়ির সবাইকে প্রায় উপবাস থাকতে হয়। এসব আর সহ্য হয় না তার। পোষমানা জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাই সে পাগল হয়ে ওঠে। গ্রামে ছিল এক যাত্রাগানের দল। বর্ধমান অঞ্চলে এই যাত্রা গানের নাম ছিল লেটো গান। নজরুল এই লেটো গানে যোগ দিলো। আসলে নামাজ রোজার শাসনে শিশু মানুষের মন বন্ধ থাকতে চাইত না। অথচ আল্লাহর ধ্যান করতে হলে দেহ-মন-প্রাণের মনোযোগ দরকার। কিন্তু অত অল্প বয়সে তার সে মনোযোগ আসবে কেমন করে? তাই লেটোর দলে ঢুকে আরম্ভ করল গান বাজনা।

লেটোর দলে যোগ দিয়ে নজরুলের দুই পয়সা আয় বাড়ল বটে, কিন্তু সংসার চালানোর মতো নয়। নজরুল এবার পাড়ি দিলো আসানসোল শহরে। সেখানে এক রুটির দোকানে এক টাকা বেতনের চাকরি পেল। এক টাকা খুব সামান্য ভেবো না। কিন্তু তা হলেও নজরুল তো রুটির দোকানে চাকরি করার জন্য আসেনি। বিরাট এই দুনিয়ায় সে এসেছে বিরাট কিছু করতে। এক দিন হঠাৎই রফিজ উল্লাহ নামে এক দারোগার সাথে তার পরিচয় হয়ে গেল।

তার বাড়ি মোমেনশাহী (ময়মনসিংহ) জেলার ত্রিশাল গ্রামে। পড়াশোনা করবে বলে নজরুল তার সাথে ত্রিশালে এলো। এখানে এসে পড়ালেখা শুরু করলেও পরিবেশের সাথে খুব বেশি দিন খাপ খাওয়াতে পারেনি। এক বছর পর ফিরে গেল বর্ধমানে। ভর্তি হলো রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণীতে। এটা ৯১৫ সালের কথা। ক্লাস টেন অব্দি এখানে পড়ল সে। কিন্তু মেট্রিক দেওয়ার আগেই বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। নজরুল কী আর ঘরে বসে থাকে। সে যোগ দিল লড়াইয়ে। যুদ্ধ থেকে ফিরে কবিতা রচনায় মন দিল সে। অচিরেই তুমুল জনপ্রিয় কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠল সে।

নজরুলের নাম নিলেই চলে আসে ‘বিদ্রোহী’ শব্দটি। তার অনেক কবিতার মধ্যেই ফুটে উঠেছে শোষণের বিরুদ্ধে দৃঢ় উচ্চারণ। কঠিন-কোমলে মেশানো এই কবি যে কবিতা লিখে বাঙালির হৃদয়ে চিরদিনের জন্য ঠাঁই করে নেয় সেই কবিতাটির নাম ‘বিদ্রোহী।’ দীর্ঘ এই কবিতা এতোই খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে তার নামের আগে ‘বিদ্রোহী’ শব্দটিই বসে যায়। তোমাদের জন্য তার বিখ্যাত লেখার মধ্যে অন্যতম হলো ‘ভোর হলো দোর খোল’,খুকী ও কাঠবেড়ালী, খোকার সাধ, সংকল্প, লিচু চোর ইত্যাদি। তার লেখা বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, সর্বহারা,ভাঙ্গার গান, ফণীমনসা, জিঞ্জির, প্রলয় শিখা, চক্রবাক, দোলনচাঁপা ইত্যাদি।

বাংলাদেশের জাতীয় এই কবি মারা যান ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র।  হয়তো তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি কিন্তু তিনি আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন তা অমর হয়ে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত