প্রতিরোধ করুন থ্যালাসেমিয়া

প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৮, ১২:১২

সাহস ডেস্ক

৮ মে প্রতি বছর ঘটা করেই আমাদের দেশসহ সারাবিশ্বে পালন করা হয় বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া একটি জন্মগত রক্তরোগ, যা কি-না শিশুরা পারিবারিকভাবে পেয়ে থাকে। যেসব সমাজে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে বিয়ে-শাদি বেশি প্রচলিত, সেসব সমাজে থ্যালাসেমিয়ার মতো বংশগত রোগ-বালাই বেশি। বাবা-মা এ রোগের বাহক হলে তাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মাতে পারে। যারা থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক তাদের কোনো উপসর্গ নেই। তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ ভাগ অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি নারী-পুরুষ নিজের অজান্তে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। আমাদের দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মায়। কিন্তু জন্মের পরপরই এ রোগটি ধরা পড়ে না। শিশুর বয়স এক বছরের বেশি হলে বাবা-মা লক্ষ্য করেন শিশুটি ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে শিশুর দুর্বলতা। আর যখনই শিশু বিশেষজ্ঞ রক্ত পরীক্ষা করে শিশুটিকে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশু হিসেবে চিহ্নিত করেন, তখনই বাবা-মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।  

থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুর যেসব সমস্যা হয় 
থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের শরীরে রক্তের মূল্যবান উপাদান হিমোগ্গ্নোবিন ঠিকমতো তৈরি হয় না। বয়স এক বা দুই বছর হলে শিশুর রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে। শিশুর স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে শরীরের দরকারি অঙ্গ যেমন- প্লীহা, যকৃৎ বড় হয়ে যায় এবং কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে। মুখমণ্ডলের হাড়ের অস্থিমজ্জা বিকৃত হওয়ার কারণে শিশুর চেহারা বিশেষ রূপ ধারণ করে, যা দেখে চিকিৎসক সহজেই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে চিহ্নিত করতে পারেন। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে অন্যের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়া রোগের একমাত্র চিকিৎসা, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সব সময় সফল নয়। 

থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি-না তা যেভাবে জানা যায় 
থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহকের কোনো লক্ষণ থাকে না। তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। তাদের শরীরে রক্তের হিমোগ্গ্নোবিনের মাত্রা সামান্য কম থাকে। তাদের সাধারণত রক্ত গ্রহণ করতে হয় না। তবে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক নারী গর্ভবতী হলে রক্তের হিমোগ্গ্নোবিন বেশি কমে যেতে পারে। যে কারণে কারও কারও গর্ভাবস্থায় দুই-এক ব্যাগ রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হতে পারে। যে কোনো মানুষের রক্তের সিবিসি পরীক্ষা করে শনাক্ত করা যায় যে, সে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি-না। এ পরীক্ষায় শনাক্ত হলে তখন হিমোগ্গ্নোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস নামের আর একটি পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় সে ব্যক্তি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি-না। সিবিসি পরীক্ষা করাতে ১০০-১৫০ টাকা, আর হিমোগ্গ্নোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস পরীক্ষা করাতে ৫০০-৭০০ টাকা লাগে। 

স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলেও সুস্থ শিশুর নিশ্চয়তা 
স্বামী এবং স্ত্রী দু’জনই যদি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হন, তবে শতকরা ২৫ ভাগ ক্ষেত্রে তাদের সন্তান থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে, ৫০ ভাগ বাহক হিসেবে এবং ২৫ ভাগ সুস্থ শিশু হিসেবে জন্ম নিতে পারে। তাই সন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে মাতৃজঠরে বাচ্চার ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয় তাদের একমাত্র ভরসা। মায়ের গর্ভে বাচ্চার বয়স যখন ১২ থেকে ১৫ সপ্তাহ, তখন প্রাথমিক গর্ভফুল থেকে কোষকলা সংগ্রহ বা গর্ভের বাচ্চার চারপাশের পানি সংগ্রহের মাধ্যমে বাচ্চার ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়। এই ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করে গর্ভের বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া রোগ আছে কি-না তা শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়। এ সময় বাচ্চার আকার থাকে দেড় থেকে দুই ইঞ্চির মতো। কাজেই সুস্থ বাচ্চা পাওয়া-না পাওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বাবা-মা গর্ভাবস্থা চালিয়ে যাওয়ার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। মাতৃজঠরে ভ্রূণের ডিএনএ পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় এখন দেশেই হচ্ছে, যা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় মইলফলক। গর্ভবতী মাকে এ জন্য আর বিদেশ যেতে হচ্ছে না।  

প্রতিরোধের উপায় 
একটু সচেতন হলেই আমরা এ রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী বা বাচ্চা নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রী থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি-না, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে যেমন- সাইপ্রাস ১৯৭৩ সালে, বাহরাইন ১৯৮৫, ইরান ২০০৪, সৌদি আরব ২০০৪ এবং সর্বশেষ পাকিস্তান ২০১৩ সালে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর বা বাচ্চা নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রীর থ্যালাসেমিয়া আছে কি-না তা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে থ্যালাসেমিয়া রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতে রক্তের ভাণ্ডার প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া আনুষঙ্গিক খরচ বহন করতে গিয়েও আর্থিক দৈন্যতা ও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে হয় লাখো বাবা-মাকে। সুতরাং আসুন আমাদের প্রজন্মকে সুস্থ জীবন উপহারের ব্রত নিয়ে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের সামাজিক আন্দোলনে শামিল হই।
সূত্র: ডিএমপি নিউজ

লেখক: ডা.রেজাউল করিম কাজল, সহযোগী অধ্যাপক, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত