বিশ্ব হাতি দিবস

প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০১৮, ১০:৫৬

১.
আজ বিশ্ব হাতি দিবস। প্রতি বছর ১২ আগস্ট বিশ্ব হাতি দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে পালিত হয়। শ্বেত হস্তিদের ভয় পেলেও বিশালদেহি প্রাণি হাতিদের আমি ভালোবাসি। নানা কারণেই ভালোবাসি। তবে ভুপেন হাজারিকার অসাধারণ গান, ‘তোমরা গেলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধু রে…’শোনার পর থেকেই আমার হাতি প্রেম বেড়ে যায়, গভীর হয়। তবে শুরুতেই স্বীকার করতেই হবে, আমাদের হাতেই বন্য প্রাণির ভবিষ্যৎ। স্থলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে হাতিই সবচেয়ে বড়। একটা সময় পৃথিবীজুড়ে কয়েক শ’প্রজাতির হাতির বিচরণ থাকলেও কমতে কমতে তা এখন নেমে এসেছে মাত্র চারটিতে। এর মধ্যে দুটি আবার বিলুপ্তপ্রায়। ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরি’বচনটি আর হরিণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই, হাতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হাতির দামি দাঁতই তার নিধনের প্রধান শত্রু হিসেবে আলোচিত। সুতরাং আসুন হাতিকে ভালোবাসি, ভালোবাসি প্রকৃতিকে, প্রাণি জগতকেও। মানুষ হিসেবে আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই জীব বৈচিত্র্য এবং প্রাণিকূল রক্ষায় আরো মনোযোগি হওয়া জরুরি, আন্তরিক প্রেম বাড়ানো প্রয়োজন।

২.
হাতি দিবস নিয়ে হাতিদের মনে কোন অনুরনণ হয় কি না সেটা জানা না হলেও তাদের নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার মনে পড়ছে মহাসংকটাপন্ন প্রাণী হাতি নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতার কথাও। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের উপস্থাপনায় ও পরিচালনায় ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড থেকে শিক্ষামূলক ‘সোনালি দরোজা’ টিভি অনুষ্ঠানের জন্য আমরা নির্মাণ করেছিলাম হাতি নিয়ে প্রায় ১৫ মিনিটের বিশেষ তথ্যচিত্র। সেই অনুষ্ঠানের একজন নেপথ্য কুশীলব হিসেবে হাতি বিষয়ে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয় তখন। আবারো নিত্য নতুন জ্ঞানের প্রতি সদা উৎসাহী করে তোলা প্রিয় মানুষ, শিক্ষক সায়ীদ স্যারের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করছি। স্যারের সাথে হাতি নিয়ে গবেষণার সময় বিবিসির ডেভিড অ্যাটেনবরোর অসাধারণ তথ্যচিত্রটিও দেখারও সুযোগ হয়। তখনই দু’ধরনের হাতির কথা জানতে পারি। আফ্রিকান হাতি এবং এশীয় হাতি। খুব আগ্রহ ও আনন্দ নিয়ে সেই তথ্যচিত্রটি আমরা নির্মাণ করেছিলাম ১৯৯৮ সালে। পরে বিটিভিতে সেটি প্রচারিতও হয়েছিলো। ছায়ানটের পাঠচক্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক ফখরুল আলম স্যারের প্রখ্যাত ইংরেজ কথাসাহিত্যিক জর্জ অরওয়েলের ‘শ্যুটিং অ্যান এলিফেন্ট’ রচনা পাঠ আলোচনার শব্দমালাও কানে ভেসে আসছে। আবার, ‘হাতি মেরা সাথি’ নামে স্কুল জীবনে ভিডিওতে একটি হিন্দি সিনেমা দেখে আনন্দ পেয়েছিলাম, সেটির কথাও মনে পড়ছে। আর অন্ধের হাতি দর্শনের মজার মজার গল্প তো আমাদের প্রায় সবারই কম বেশি জানা।

৩.
আমরা পত্রিকা খুললেই মাঝে মাঝে দেখি মানুষ-হাতির বিরোধের খবর। কারণ হিসেবে জানা যায়, হাতির চলাচলের পথ রুদ্ধ হওয়া এবং হাতির আবাসস্থল কৃষিকাজের জন্য বেদখল হওয়ার কারণে মানুষ-হাতির বিরোধ সংঘটিত হচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক চারণভূমি ও হাতিবান্ধব বনাঞ্চল না থাকায় হাতি তার খাবারের জন্য ফসলের মাঠে ও মজুদ করা খাদ্যশস্যের জন্য ঘরবাড়িতে হানা দিচ্ছে । বন ধ্বংস করে কৃষি জমির বিস্তার, নগরায়নসহ নানা কারণে অনেকটাই অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে হাতি। বন বিভাগের তথ্যে এমনটাই জানা যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী হাতির সংখ্যা ২৩০ থেকে ২৪০টির মত। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন বনাঞ্চলে কম-বেশি দুশোর মতো বন্য হাতি আছে, সিলেট অঞ্চলে যেসব হাতির দল ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নিয়মিত ঘোরাঘুরি করে, তাদের সংখ্যা ১০০-১৫০। একদিকে যেমন হাতির জন্য উপযুক্ত পরিবেশের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে প্রায়ই হাতির আক্রমণে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। আবার মানুষের হাতেও মারা পড়ছে হাতি। এমনই প্রেক্ষাপটে আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব হাতি দিবস। আর অতি সম্প্রতি জামালপুরে ভারত থেকে আসা হাতিটি উদ্ধারে ব্যর্থতায় হস্তি বিশারদদের দক্ষতা, যোগ্যতার প্রশ্নবিদ্ধতার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের প্রচলিত জ্ঞানের সমন্বিত সাফল্যের কথাও স্মরণ করছি।

৪.
এক নজরে হাতি নিয়ে অজানা কিছু কথা জানার চেষ্টা করা যাক। বিশালদেহী হাতিকে দূর থেকে দেখতে যেমন ভয় লাগে, পিঠে উঠে ঘুরে বেড়াতে ততটাই মজা লাগে। এত্ত বড় প্রাণীকেও মানুষ কীভাবে পোষ মানিয়ে নিয়েছে। বিশাল এই প্রাণী সম্পর্কে অনেক মজার বিষয় আছে, যেগুলো জানাটা মজারই বটে। পৃথিবীতে দুই ধরনের হাতি দেখা যায়। এশিয়ান হাতি এবং আফ্রিকান হাতি। আফ্রিকান এই হাতির মধ্যে আবার রকমফের রয়েছে। একটি আফ্রিকান ফরেস্ট এলিফ্যান্ট আর একটি আফ্রিকান বুশ এলিফ্যান্ট। কিন্তু কিভাবে বুঝব কোনটি আফ্রিকান আর কোনটি এশিয়ান! এটা অনেক সহজ। আফ্রিকান হাতির পুরুষ এবং মহিলা উভয় প্রজাতিরই দাঁত থাকে। এশিয়ান হাতির মধ্যে কেবল পুরুষ হাতিরই দাঁত থাকে। হাতির বড় বড় দাঁত রয়েছে। এ দাঁতগুলো তারা খাবার কাজে লাগায় না! তারা এ দাঁত ব্যবহার করে আক্রমণ করতে, মাটিতে গর্ত খুঁড়তে আর খাবার খুঁজে বের করতে। মনে হরা হয়, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে হাতিই হয়তো সবচেয়ে বড়। না, সবচেয়ে বড় প্রাণী বা সবচেয়ে বড় স্তন্যপায়ী প্রাণী হলো নীল তিমি। অনেক কম বয়সে হাতি বাবা-মা হয়ে যায়। মাত্র ১২ বছর বয়সে সে সন্তান ধারণ করতে পারে। কিন্তু বাচ্চার অনেকটা সময় কাটে মায়ের পেটে। তাদের বাচ্চা মায়ের পেটে থাকে ২২ মাস। একটি হাতির বাচ্চা মানুষ শিশুর চেয়ে প্রায় আড়াইগুণ বেশি সময় মায়ের পেটে কাটায়।একটি প্রাপ্তবয়ষ্ক হাতি দিনে প্রায় ২১০ লিটার পানি পান করে। মজার বিষয় হলো- তারা শুকনো জায়গাতেও পানি পান করতে পারে। তারা শুঁড় ব্যবহার করে মাটিতে গর্ত করে মাটির নিচের পানি বের করে এনে পান করে। খুব গরমেও হাতি থাকে একদম ঠাণ্ডা। এর কারণ হলো- তার লম্বা কানের নিচে থাকা রক্তের নালিকার একটি জটিল বিন্যাসে এ কাজটি হয়ে থাকে। এই নালিকা সারাক্ষণ রক্ত চলাচল করিয়ে হাতির দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাকৃতিকভাবে হাতির কোনো শত্রু নেই। তবে গভীর জঙ্গলে মাঝে মধ্যে শক্তিশালী সিংহরা দুর্বল আর বাচ্চা হাতি শিকার করে। হাতির আসল শত্রু কিছু মানুষ, যারা দাঁতের লোভে হাতিকে মেরে ফেলে। আবার কেউ কেউ সরাসরি হাতিকে মারে না বটে, তবে জঙ্গল কেটে সাফ করে ফেলে। এর ফলে হাতি তার বাসস্থান এবং খাদ্যের সংকটে পড়ে। এ দুইয়ের অভাবে তারা মরে যায়।হাতি তার শুঁড় দিয়ে যে কোনো বস্তুর আকার, আকৃতি বা তাপমাত্রা বুঝে ফেলতে পারে। এ ছাড়া শুঁড় দিয়ে সে খাবার আর পানি নিজের মুখে নিয়ে নেয় খাওয়ার জন্য।হাতির শুঁড় প্রায় ২ মিটার লম্বা হয়। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, হাতির শুঁড়ে প্রায় এক লাখ পেশি আছে। কিন্তু কোনো হাড় নেই। তাই তো হাতি যেভাবে খুশি তার শুঁড়কে আঁকিয়ে বাঁকিয়ে যা খুশি কাজ করতে পারে। স্ত্রী হাতি সারাজীবন দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। এদিকে পুরুষ হাতি ১৩ বছর বয়সে দল ছেড়ে চলে যায় এবং বাকি জীবন একাই বসবাস করে। তার ওজন বেশি হলেও সে কিন্তু সাঁতার কাটতে পারে। ডুবুরিরা যেভাবে একটা পাইপের সাহায্যে নিঃশ্বাস নেয়, ঠিক তেমনি সাঁতরানোর সময় ওদের শুঁড়ের মাথাটা থাকে পানির ওপরে। শুঁড়টাই যে হাতির নাক। তাই তার ডুবে যাওয়ার ভয় নেই।হাতি তৃণভোজী প্রাণী।দিনের একটা বড় সময় ধরে তারা খাবার সংগ্রহ করে। কখনও কখনও দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টা ধরেই তারা পাতা, ডাল, মূল জোগাড় করে খাওয়ার জন্য।

৫.
দ্রুতগতিতে মানুষ বাড়ছে। বসতি স্থাপনে উজাড় হচ্ছে বন-জঙ্গল। এছাড়া মানুষ প্রয়োজনীয় রসদ জোগাড় করতে বনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়াতে বন্যপ্রাণীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বনে বন্যপ্রাণীর খাদ্য সংকটের কারণে তারা লোকালয়ে ঢুকছে। ফলে মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণীর সংঘর্ষ বাড়ছে। প্রায়ই বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর হয়ে আসে হাতির সাথে, বাঘের সাথে মানুষের সংঘর্ষ প্রাণহানির কথা। আসলে বন্যপ্রাণীর চলাচলে মানুষ বাধা সৃষ্টি করছে বসতবাড়ি স্থাপন করে। ফলে অনেক বন্যপ্রাণী আজ অস্তিত্ব সংকটে। যেমন হাতির কথাই ধরা যাক। ডাঙার সবচেয়ে বড় প্রাণী বলা হয় হাতিকে। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এদের বিচরণ করতে দেখা যায়। এরা এখন ‘মহা সংকটাপন্ন’ প্রাণীর তালিকায়। গবেষণায় দেখা গেছে, হাতির চলাচলের পথ রুদ্ধ হওয়া এবং হাতির আবাসস্থল কৃষিকাজের জন্য বেদখল হওয়ার কারণে মানুষ-হাতির বিরোধ সংঘটিত হচ্ছে। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক চারণভূমি ও হাতিবান্ধব বনাঞ্চল না থাকায় হাতি তার খাবারের জন্য ফসলের মাঠে ও মজুদ করা খাদ্যশস্যের জন্য ঘরবাড়িতে হানা দিচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্রমাগত অবক্ষয়ের কারণে মানুষ ও হাতির মধ্যে চলমান বিরোধ সম্পূর্ণ নিরসন করা সম্ভব নয়। শুধু উপযুক্ত কৌশলের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যাটির ব্যাপকতা অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

৬.
শেরপুরের নালিতাবাড়ির বন কর্মকর্তা মোঃ হাবিবুল্লাহ বলেন, হাতির নিজস্ব বিচরণ ক্ষেত্রের ভেতরে লোকজন ঘরবাড়ী তৈরি করলে তখন হাতি সেগুলো ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। তখনই কেবল মানুষের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। এছাড়া হাতি মানুষকে কখনো আক্রমণ করে না। আলো বা শব্দ থেকে অনেকসময় হাতির মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়। তখন তারা মানুষকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয় বলেও জানান এই বন কর্মকর্তা। হাতি একটি আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। কলাগাছ, বাঁশ ইত্যাদি হাতির খাবার। হাতি যাতে লোকালয়ে না আসে সেজন্য হাতির খাদ্যাভাব দূর করতে এসব গাছের বাগান করা বা বনাঞ্চল সংরক্ষণ করা জরুরি বলে উল্লেখ করেন মোঃ হাবিবুল্লাহ।

৭.
আশংকা প্রকাশ করে বন্য প্রাণি বিশারদগণ বলছেন, বিলুপ্ত হবে হাতিও! বিশাল দেহের ডাইনোসর পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। ডাইনোসরের পর এখনো টিকে থাকা হবে। স্থলচরদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাণী হাতিও এখন বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কায়। এই নিয়ে বিশ্ব আলোচনা শুরু হয়েছে। শঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রাণী বিশ্লেষকরা। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতি বছর যে হারে হাতি কমছে, তাতে ১০ বছর পর চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও এই প্রাণীর অস্তিত্ব থাকবে না। একশ’ বছর আগে আফ্রিকায় মোট এক কোটি হাতি ছিল। এখন সেখানে মাত্র সাড়ে চার থেকে সাত লাখের মতো হাতি টিকে আছে। এশিয়ায় আছে মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ হাজার হাতি। গত দশ বছরে সারা বিশ্ব থেকে হাতি কমেছে ৬২ ভাগ!

৮.
আন্তর্জাতিক হাতি দিবস উপলক্ষে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন প্রাণী বিশ্লেষকরা। সেখানে হাতি বিলুপ্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, হাতির দাঁত বেশ মূল্যবান হওয়ায় সন্ত্রাসী চক্র হাতি শিকার করে বাণ্যিজ্য করছে। এই দাঁতের লোভে আফ্রিকার জঙ্গল থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে একশ’টি হাতি মারা হয়। হাতির দাঁত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় চীনে। গত জুলাই মাসে জুরিখ বিমানবন্দরে ২৬২ কিলোগ্রাম ওজনের হাতির দাঁতসহ ধরা পড়ে এক চীনা নাগরিক। প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অবৈধ ব্যবসা হাতির দাঁতের কেনাবেচা। মাদক এবং মানবপাচারের পরই এর স্থান। অনেক য্দ্ধু-দাঙ্গা-হাঙ্গামার পেছনেও ভূমিকার রাখে হাতির দাঁত। আফ্রিকা অঞ্চলের জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অস্ত্র কেনে হাতির দাঁতের বিনিময়ে! এছাড়াও হাতির বিলুপ্তির পেছনে জঙ্গল কমে যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখছেন প্রাণী বিশ্লেষকরা। 

৯.
শান্তনু ঘোষের ‘হস্তীপুরাণ’ গ্রন্থের আলোচনায় শীলাঞ্জন ভট্টাচার্য লিখছেন, ‘আধুনিক গবেষণা বলছে, হাতিদের পূর্বপুরুষ ছিল আজকের জলবাসী স্তন্যপায়ী ডুগং, ম্যানাটিদের মতো প্রাণীর কোনও পূর্বপুরুষ, এবং তারা একসময় জলবাসী ছিল। আবার, সেই পূর্বপুরুষদের পূর্বপুরুষরা ছিল ডাঙার অধিবাসী। ডাঙা ছেড়ে জল, জল থেকে আবার ডাঙায়- এরকম ব্যাপার বিবর্তনের যাত্রায় হাতিদের মতো আর কেউ দেখাতে পারেনি। আফ্রিকাতেই হাতিদের আদি বাড়ি, সেখানেই আজকের আফ্রিকান হাতি আর এশীয় হাতির পূর্বপুরুষদের পরিবার ভিন্ন হয়েছিল তিন-চার কোটি বছর আগে। আজকের এশীয় বা ভারতীয় হাতিদের পূর্বপুরুষরা আফ্রিকা থেকে চলে এসেছিল তার কিছুকাল পরেই।’

১০.
শীলাঞ্জন ভট্টাচার্য আরো লিখছেন, ‘ভারতীয় সভ্যতার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে হাতি, সেই সিন্ধু সভ্যতার আদিকাল বা তারও আগে থেকে। প্রাগৈতিহাসিক মানবগোষ্ঠীর চিত্রশিল্পীরা হাতিকে এঁকেছেন ভারতের গুহার দেওয়ালে। মধ্য এশিয়ার ঊষর প্রান্তর থেকে এসে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী মানুষ, তথাকথিত আর্যরা যখন পঞ্চনদের দেশে গেড়ে বসল, তখন তাদের দেবতাদের যিনি রাজা, সেই ইন্দ্রদেব ঘোড়ায় টানা রথ থেকে নেমে হস্তীতে আসীন হলেন। ঋগ্বেদের যুগে হাতির উল্লেখ সামান্য, কেননা, সে সময় আর্যরা হাতির সঙ্গে তেমন পরিচিত হয়নি। হাতি তাদের বর্ণনায় ‘মৃগহস্তহীন’- হাতযুক্ত চতুষ্পদ! অথচ, সিন্ধুসভ্যতার বাসিন্দাদের কাছে হাতি অতি পরিচিত, খুব সম্ভবত তাদের পোষ মানিয়ে রীতিমতো কাজে লাগানো শুরু হয়ে গিয়েছে। আর্যরা বিজিতদের কাছ থেকে অনেক কিছুর মতোই হাতিকে পোষ মানানোর ও তাকে কাজে লাগানোর ব্যাপারটা শিখে নিয়েছিল। অথর্ববেদের সময় দেখা যাচ্ছে, তারা হাতি নামক জন্তুটির সঙ্গে ভালভাবেই পরিচিত হয়েছে। আরও পরে, ইন্দ্রের বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐরাবত- কালো, জলদগর্ভ, মৌসুমি মেঘের কল্পরূপ। আর, ইন্দ্র বজ্র-বৃষ্টির দেবতা। প্রাক্-বৌদ্ধযুগ থেকেই হাতি আরও ব্যাপকভাবে প্রজননশক্তির রূপক। যেমন, ভবিষ্যতের বুদ্ধ স্বর্গ থেকে শ্বেতহস্তী রূপে নেমে এসে রাজরানি মায়াদেবীর স্বপ্নে তাঁর গর্ভে জাত হন। একই সঙ্গে বাস্তবে ভারতের নাগরিক জীবনে, রাজকার্যে, যুদ্ধে হাতি হয়ে দাঁড়ায় অপরিহার্য। ভারতীয়দের কাছে এখন হাতি অতিপরিচিত প্রাণী। সাধারণ বিদেশি, বিশেষত ইউরোপীয় মানসে, আজও ভারত বলতে বোঝায় সেই দেশ, যেখানে রাজপথে মোটরগাড়ির পাশাপাশি পোষা হাতি হেঁটে যায়! আজও হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে নীলগিরির জঙ্গল, পুবের অসম-অরুণাচল থেকে পশ্চিমে সহ্যাদ্রির বনভূমি দাপিয়ে বেড়ায় হাতির দল। হাতির বদলে বাঘকে ভারতের জাতীয় পশু ঘোষণা করায় হস্তীপ্রেমীদের ক্ষোভ আছে। আবার উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষের দখলে চলে যাওয়া বনভূমিতে সঙ্কুচিত বনাঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসে হাতিদের তাণ্ডব এখন অহরহ সংবাদের শিরোনামে। ডাঙায় বসবাসকারী সর্ববৃহত্ প্রাণীটি অতএব এক আকর্ষক ও প্রয়োজনীয় চর্চার বিষয়।’

১১.
প্রাণিজগতে হাতিকে চিহ্নিত করা হয় চিত্তাকর্ষক স্মৃতিভাণ্ডারের আধার হিসেবে। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে আবহাওয়াবিদ হিসেবেও হাতির সুখ্যাতি বাড়ছে। কারণ গবেষণা জানান দিচ্ছে, ১৫০ মাইল দূরে থেকেও হাতিই কেবল ঝড়ের পূর্বাভাস দিতে পারে! জার্নাল পপস্কিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বড় কানের কারণে ঝড় সম্বন্ধে আগে থেকে জানার এ সুবিধা পেয়ে থাকে তারা। লম্বা সময় চালানো এক গবেষণার শুরুতেই বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, বর্ষাকাল শুরুর প্রাক্কালে হাতিরা দলে দলে তাদের অবস্থান বদলে ফেলে। এ অবস্থান বদল কেবল একবারের জন্য ঘটে না। ঝড়ের পূর্বাভাস বুঝতে পারা মাত্রই তারা তাদের নতুন অবস্থানও পরিবর্তন করে। এভাবে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আফ্রিকার হাতিরা নিজেদের ডেরা ছেড়ে দিয়ে নতুন নতুন স্থানে অবস্থান করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, কানের আকৃতি বড় হওয়ায় খুবই ক্ষুদ্র তরঙ্গের শব্দও সহজেই শুনতে পায় হাতি। এ কারণে ঝড় সম্বন্ধেও আগেভাগে জানতে পারে তারা। হাতির এ ক্ষমতা সাধারণ প্রযুক্তির চেয়ে বেশি কার্যকর বলেই ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। এ জন্য হাতি শিকারিদের থামাতে জোরেশোরে প্রচারে নামারও ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা।

(তথ্যসূত্র: বিভিন্ন পত্রিকা, দেশ, ডয়েচে ভেলে, ডেইলি মেইল, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত