প্রশ্নপত্র ফাঁসের গোপন তথ্য ফাঁস

প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:২৭

সাহস ডেস্ক

এসএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা ও শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন গ্রেপ্তার হওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী।

জবানবন্দিতে গত কয়েক বছর ধরে তারা কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন তা উঠে এসেছে। এতে উদ্ভাস ও ওমেগা নামে দুটি কোচিং সেন্টারের নামও পাওয়া গেছে।

গত ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে শহীদুল্লাহ্ হল থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসম্পাদক মহিউদ্দীন এবং অমর একুশে হলের নাট্য ও বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ জানতে পারে, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির সংঘবদ্ধ চক্র কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস করে আসছে। পরবর্তীতে এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাবির ছাত্রসহ অন্তত ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এদের মধ্যে ১৩ জন প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তির হওয়ার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলো- মহিউদ্দিন রানা, আবদুল্লাহ আল মামুন, ফারজাদ সোবহান নাফী, আনিন চৌধুরী, নাভিদ আনজুম তনয়, এনামুল হক আকাশ, নাহিদ ইফতেখার, রিফাত হোসেন, বায়জিদ, ফারদিন আহম্মেদ সাব্বির, তানভীর আহেম মল্লীক, প্রসেনজিৎ দাস ও আজিজুল হক। এর মধ্যে নাফী, আনিন ও এনামুল ছাড়া সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

তদন্ত সূত্র জানায়, আকাশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছেন। প্রশ্ন ফাঁস করতে তাকে সহযোগিতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাভিদ আনজুম তনয়, নীল ও সজীব। নীল তাকে চলতি বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিটের প্রশ্ন দেয় পরীক্ষা শুরু হওয়ার ২৬ মিনিট আগে। আর ‘ডি’ ইউনিটের প্রশ্নও নীল দেয় পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১০-১২ মিনিট পর। আর তনয় ও সজীব তাকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন দেয়। তনয় তাকে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষারও প্রশ্ন দেয়। ২০১৫ সালে তনয় শিক্ষক নিবন্ধন ও বিভিন্ন ব্যাংকের পরীক্ষার প্রশ্ন দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুন। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে মামুন বলেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতি চক্রের অন্যতম সদস্য হলেন নাভিদ আনজুম তনয়। প্রশ্ন সংগ্রহ করে তনয়। প্রশ্ন ফাঁস চক্রে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আজাদ, সজীব, রুবেল, মিজান, বাপ্পী ও আবিদ।

চলতি বছর ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারজাদ সোবহান আদালতকে জানান, মেহজাবিন অনন্যা চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডি’ ইউনিটে পরীক্ষা দেন। পরীক্ষার আগের দিন রাতে তিনি মেহজাবিন অনন্যাকে উদ্ভাস কোচিং সেন্টারের লেকচার শিটের পেছনে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সাজেশনের ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পাঠান। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর মেহজাবিন তাকে জানান, ফারজাদ প্রশ্ন–সংবলিত যে সাজেশন পাঠান তার সবকিছু ভর্তি পরীক্ষায় আসে। আনিন চৌধুরী রায়হান নামের এক মেডিকেল পরীক্ষার্থীর বাবার কাছ থেকে ১১ লাখ টাকা নেন, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন দেওয়ার কথা বলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তানভীর আহম্মেদ মল্লিক আদালতকে জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন পাওয়ার জন্য তিনি ফারজাদকে আড়াই লাখ টাকা দেন। জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র রিফাত আদালতকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগের শিক্ষার্থী ওমর আলীকে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়েছেন।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম জানান, ইন্দিরা রোডের প্রেসের কর্মচারী খান বাহাদুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিলেন। আর তার সহযোগী ছিলেন সাইফুল ইসলাম ও রকিবুল হাসান। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁস হয়।

তদন্তপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অন্তত সিআইডির অন্তত তিনজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির প্রমাণ সংরক্ষিত আছে আসামিদের মোবাইল ফোনে। যা মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়। আসামিদের মোবাইল ফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) রহস্য উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আদালতকে সিআইডি জানায়, আবদুল্লাহ আল মামুনের একটি স্যামসাং মোবাইল জব্দ করে। বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে প্রশ্ন ফাঁস করেছেন। তার মোবাইলে আছে শিক্ষার্থীর প্রবেশপত্র। আবার ছাত্রলীগ নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মহিউদ্দিন রানার মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংক এলিফ্যান্ট রোড শাখায শহিদুল্লাহ হলের তরিকুল হাসান বিকেএসপির সহকারী পরিচালক (বরখাস্ত) অলিপ বিশ্বাসের অ্যাকাউন্টে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা দেন।

আদালত ছাত্রলীগ নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন রানা, আবদুল্লাহ আল মামুন ও ইশরাক হোসেন রাফির মোবাইল ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষার অনুমতি দেন। মূলত এই তিন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তারা হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার, ইমো ও ফেসবুক মেসেঞ্জার ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতি করে। 

আদালতে এক প্রতিবেদন দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, মহিউদ্দিন ও মামুনের হোয়াটস অ্যাপে বিভিন্ন ব্যক্তির আইডিতে প্রশ্নপত্র পাঠানোর ছবি, শিক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র ও রোল নম্বর পাওয়া যায়। প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতির সংঘবদ্ধ চক্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমীর, মিজান, আজাদ, ওমেগা কোচিং সেন্টারের তন্ময়, মাইলস্টোন কলেজের সাবেক ছাত্র সুব্রত জড়িত।

জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রেপ্তার হওয়া ঢাবির ১৫ জন শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। 

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, জালিয়াতি করে যেসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, তাদের অভিভাবকদের আইনের আওতায় আনা হবে। অসাধু পন্থা অবলম্বন করে লাখ লাখ টাকা খরচ করে তাদের ছেলেমেয়েকে ভর্তি করাচ্ছেন মূলত অভিভাবকেরা। অবৈধ উপায়ে ছেলেমেয়েকে ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে অর্থ দিয়ে যে সহযোগিতা করছেন, তা অপরাধ। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেন, একজন শিক্ষার্থী যে অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠল, এর জন্য তার বাবা-মা, অভিভাবকের দায়দায়িত্ব কতটুকু, তা যদি খোঁজা যায় তাহলে সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূলে যে ব্যবস্থা, সে ব্যবস্থার অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করবে। 

সাহস২৪.কম/জুয়েনা/আল মনসুর 

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত